দুই বালিকার কথা। এক জন সারা বিশ্ব ঘুরে কথা বলছেন, সবাই টিভিতে দেখছেন, পত্রিকায় পড়ছেন। আর এক জনের অতি সংক্ষিপ্ত দু’টি বাক্য শুনেছিলাম। এক বালিকা বিশ্ব পরিচিতা, অন্য জন নিতান্ত প্রান্তিক। প্রথম জন পৃথিবীর অন্যতম ধনী দেশের মেয়ে, যে দেশ মানব উন্নয়ন সূচকেও একেবারে শীর্ষ কয়েকটি দেশের একটি। ঈশ্বরকে স্বর্গ দেখাতে বললে তিনি সম্ভবত ইউরোপের সেই দেশটিকেই দেখিয়ে দেবেন। জীবনের সব সুবিধা, দূষণহীন পরিবেশের দেশের বাসিন্দা এক বিদ্যালয়-বালিকা এক দিন একাই প্রতিবাদ শুরু করে দিল সমগ্র বিশ্বের পরিবেশ ধ্বংসের বিরুদ্ধে। সে দেশের সংসদের সামনে প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাবি তুলল: তার দেশ জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করতে কার্বন নিঃসরণ কমাক। সে কোনও বিস্ময়-মেধাসম্পন্ন বালিকা নয়, জলবায়ু বা পরিবেশ সম্পর্কে কোনও বিশেষ জ্ঞানের অধিকারীও নয়— তবু তার পর যা হল, তা ইতিহাস বা ইতিহাস গড়ে তোলা হল। একে আমরা এখন বলব উত্তর বালিকা।
আর সেই প্রান্তিক বালিকা থাকে পশ্চিম মেদিনীপুরে ওড়িশার সীমান্তবর্তী জঙ্গল-ঘেরা এক গ্রামে। সেখানে হাতি আসে প্রায়শই, গ্রামের লোকেরা মাটির হাতি বানিয়ে হাতির পুজো করে আর সেই মাটির হাতিরা দাঁড়িয়ে থাকে জঙ্গলের গাছের নীচে। হাজার গাছগাছালি, পাখি, বুনো খরগোশ, কত কী আছে সেই গ্রামে, গ্রামের জঙ্গলে। এ সবকে বলে জীববৈচিত্র। সেই গ্রামের মেয়েদের বিদ্যালয়ে যাওয়া হয়েছিল পরিবেশ সচেতনতার কাজে। বিদ্যালয়ের সামনে এসে দাঁড়াল গোটা দুয়েক ঝকঝকে গাড়ি। তা থেকে কলকাতার মানুষেরা নেমে পরিবেশের ক্লাস নিলেন। গ্রামের জীববৈচিত্রের খুব প্রশংসা করে বললেন যে, গ্রামের এই বিভিন্ন রকমের গাছপালা, লতাগুল্ম, পশুপাখি, সব কিছুর নাম লিখে একটা খাতা বানাতে হবে, যাকে বলে বায়োডাইভার্সিটি রেজিস্টার। রাজ্যের সর্বত্র এ ভাবে এই খাতা তৈরি করা হবে। এ সব ছোটখাটো ভাষণের পর একটি ছাত্রী— সেই প্রান্তিক বালিকা— উঠে দাঁড়ায়। বনবাসী এই অঞ্চলের বেশির ভাগ ছাত্রীর মাতৃভাষা বাংলা নয়, ফলে সাজিয়ে গুছিয়ে কথা বলা তাদের একটু অসুবিধা বইকি। তবু প্রান্তিক বালিকা দাঁড়িয়ে উঠে মৃদু কণ্ঠে বলেছিল, “আচ্ছা, আপনাদের কলকাতায় এ সব আছে?” উত্তর এল, না। বালিকা আরও মৃদু কণ্ঠে বলেছিল, “তা হলে…।”
এই প্রান্তিক বালিকা, আমরা তাকে বলব দক্ষিণ বালিকা, অতি সংক্ষিপ্ত দু’টি বাক্যে আসলে বলেছিল যে, তা হলে কলকাতায় জীববৈচিত্র নেই, কিন্তু আপনারা তো আমাদের চেয়ে অনেক ভাল আছেন। গাড়ি করে এলেন, ইস্কুলকে কত জিনিস দিলেন। তা হলে আমরা গরিবরা কেন জীববৈচিত্র নিয়ে মাথা ঘামাব? আপনারা বাড়ি করবেন সল্ট লেকে বা নিউ টাউনে, শালবনীতে নয়। জীবন উপভোগ করে বাঁচবেন গ্রামের লোকের থেকে বেশি দিন। এ ভাবেই দেড় শতকে শিল্প বিপ্লবের ফলে ভীষণ জীববৈচিত্র ধ্বংসের পরও ব্রিটেন বা ইউরোপের মানুষেরা সবচেয়ে ভাল আছেন।
এত সব বালিকাসংবাদের কারণ হল একটা কল্পনা— এই দুই বালিকা পরস্পরের মুখোমুখি হলে কী কথা বলবেন? মুখোমখি হওয়ার একটা অবস্থাও তৈরি হয়েছে বইকি। গত দশক তিনেক ধরে, পরিবেশ ও বিশ্ব উষ্ণায়নের মাতামাতিতে, কয়লা এখন ইউরোপে একটি অশ্লীল শব্দ। যদিও আজকের উন্নত ব্রিটেন ও ইউরোপ গড়ে উঠেছে কয়লা জ্বালিয়ে উৎপাদিত শক্তির জোরেই। উন্নয়নের প্রধান শর্তই হচ্ছে শক্তির জোগান। অবশ্যই সময়ের সঙ্গে এক কালের প্রয়োজনীয় বস্তুকে ত্যাগ করতে হয়। আমার মা জীবনে মুক্তির স্বাদ পেয়েছিলেন কোনও নারী আন্দোলনে নয়, বাড়িতে বিদ্যুৎ আসা ও পরে একটা রেফ্রিজারেটর ঢোকার পর। সারা দিন রান্নাবান্নার জালে জড়ানো মা এ বার সময় পেলেন কাগজ পড়ার, বই পড়ার, গান শোনার। জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের কারিগর ছিল রেফ্রিজারেটরে ব্যবহৃত ফ্রিয়ন নামক এক নিরাপদ রাসায়নিক, যা ঠান্ডা করার কাজটি করে। কয়েক দশক পর সুদূর আকাশে দূষণ ঘটানোর অভিযোগে সেই রাসায়নিককে বিদায় করে অন্য রাসায়নিক আনা হয়েছে। বিদ্যুতের জোগানদার কয়লাও বিসর্জন দেওয়া যায়, কিন্তু তার উপযুক্ত প্রতিস্থাপক আগে প্রয়োজন।
কয়লার দূষণকে গালমন্দ করে পৃথিবীর সব দেশেই কয়লা বন্ধের জোর অভিযান চালাচ্ছে ধনী দেশের মাতব্বরেরা। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশের কাছে কয়লাই অর্থনৈতিক বাস্তবোপযোগী শক্তির উৎস। গত নভেম্বরে জলবায়ু পরিবর্তনের ২৭তম আন্তর্জাতিক সম্মেলনেও কয়লা ব্যবহার বন্ধের জন্য সব দেশের প্রতিশ্রুতি আদায় করে ছেড়েছে আয়োজকেরা। যদিও চিনের মতো গুরুত্বপূর্ণ দেশ প্রতিশ্রুতিও দিয়ে যাচ্ছে, আবার কয়লার ব্যবহারে যথেচ্ছ বৃদ্ধিও ঘটাচ্ছে— নইলে তার উন্নয়নের ঘোড়া থমকে দাঁড়াবে। কিন্তু হঠাৎই চাকা ঘুরেছে। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে জ্বালানি সমস্যায় ইউরোপ আবার কয়লায় ফিরছে। জার্মানি নতুন কয়লা খনি সম্প্রসারণের কাজ শুরু করেছে, তার কয়লা জ্বালিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে। কয়েক দশক পর ব্রিটেন আবার নতুন কয়লা খনির কাজ শুরু করেছে। সুতরাং প্রয়োজনে কয়লা একেবারে ফেলনা নয়।
উত্তর বালিকা পৌঁছে গিয়েছে সেই খনি পার্শ্ববর্তী জার্মানির লুয়েতজ়েরাথ গ্রামে, বিরোধিতা করছে কয়লা খনির ও ব্যবহারের। কয়লা মানে দূষণ, উষ্ণায়ন, পরিবেশ ধ্বংস। ধরুন উত্তর বালিকা পৌঁছে গেল পশ্চিমবঙ্গের ডেউচা পাঁচামিতে। তা হলে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম কয়লার সংগ্রহ এই ডেউচা পাঁচামির খনির কী হবে? আসুন আমরা পশ্চিম মেদিনীপুরের বনবাসী দক্ষিণ বালিকাকে নিয়ে আসি আলোচনার জন্য। কোথাও জঙ্গল, কোথাও পাথর খাদান, পাথর ভাঙার কল, লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাক। একটু দূরে ডেউচার মনসা মন্দিরের চাতালে দুই বালিকা বসুক। দক্ষিণ বালিকা প্রথমে মনে করিয়ে দেবে যে, উত্তর বালিকার দেশ সুইডেনের জনপ্রতি বিদ্যুতের ব্যবহারের পরিমাণ বছরে ১২,০০০ কিলোওয়াট-ঘণ্টা। আর ভারতে জনপ্রতি বিদ্যুতের ব্যবহারের পরিমাণ বছরে ১২০০ কিলোওয়াট-ঘণ্টা। দক্ষিণ বালিকার নিজের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে তা বছরে ৬০০ কিলোওয়াট-ঘণ্টা। অর্থাৎ, দু’জনে একই ছাদের তলায় বসার আগে সমতা আনতে হলে পশ্চিমবঙ্গে কুড়িগুণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের ১০ কোটি লোকের বছরে জনপ্রতি আরও ১১৪০০ কিলোওয়াট-ঘণ্টা বিদ্যুৎ জোগাতে হলে ১ লক্ষ ৫০ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। মানে ফরাক্কা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের (২১০০ মেগাওয়াট) মতো ৭০টির বেশি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র চাই। আর এর জন্য চাই কয়লা, যা দেবে ডেউচা পাঁচামি। সৌর বিদ্যুৎ, বায়ু শক্তির কথা বলতে পারেন, কিন্তু সে সব এখনও বিপুল ও ধারাবাহিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত নয়। দক্ষিণ বালিকার সব চাই কালকেই, তবেই তার প্রত্যাশিত আয়ু ৬৫ থেকে সুইডেনের ৮২-তে পৌঁছবে। সে সমপর্যায়ে আসবে উত্তর বালিকার।
কিন্তু তা হলে পরিবেশের কী হবে? কয়লা খনিতে ধ্বংস হবে অরণ্য, অনেক গ্রাম হারিয়ে যাবে, হারিয়ে যাবে সবুজ কৃষিক্ষেত্র, হ্রাস পাবে জীববৈচিত্র। খনির কাজে দূষণ হবে, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে দূষণ হবে, পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সবই সত্যি, তবে আধুনিক প্রযুক্তির যুগে দূষণ হবে তুলনামূলক অনেক কম। শিল্প বিপ্লবের এক শতকে, যখন দূষণ পরিবেশ নিয়ে ভাবনাচিন্তা প্রায় ছিলই না, ইউরোপের জল হাওয়া মাটি সব খুব দূষিত হয়েছে, কিন্তু তখনই মানুষের স্বাস্থ্য অর্থনীতি হয়েছে উন্নত। ১৮৪০ সালে ইউরোপের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪০ বছর, ১৯৫০ সালে তা বেড়ে হয় ৭০ বছর। মানুষ তো কেবল নির্মল বায়ুতে শ্বাস নিয়ে আর প্রকৃতি জড়িয়ে ভাল ভাবে বাঁচে না, ভাল বাঁচার জন্য চাই পর্যাপ্ত খাদ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা, বাসস্থান। তাই দূষিত দিল্লি-কলকাতার লোকের স্বাস্থ্য, গড় আয়ু সবই প্রান্তিক বনবাসীদের চেয়ে ভাল। দক্ষিণ বালিকা আরও বলবে যে, খনির কাজ শুরুর আগে আমার মতো সব মানুষের পরিবারের সঠিক পুনর্বাসন চাই। খনন ও বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হবে পরিবেশসম্মত ভাবে, সরকারকে তার নিশ্চয়তা দিতে হবে।
দক্ষিণ বালিকাকে উন্নত জীবনে বাঁচতে হলে উন্নত কৃষি ও বিপুল শিল্পায়ন ছাড়া পথ নেই। সুতরাং, সে যতই কালো হোক, কয়লা এখনও আমাদের শক্তির দেবীসম।a