এই দীর্ঘ রাত্রিতে যাঁরা আমাদের রিক্ত করে চলে গেলেন তাঁদের মধ্যে এক জন স্বপন মজুমদার (১৯৪৬-২০২০)। তাঁর কথা যে আমরা তেমন বলছি না, সেটা হয়তো এক সাংস্কৃতিক অমঙ্গলের সঙ্কেত। আমাদের বুধমণ্ডলীতে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এক সত্তা, জ্ঞানচর্চা আর গ্রন্থ প্রকাশনার অপার সম্ভাবনাময় সংযোগের এক রূপকার।
তুলনামূলক সাহিত্যের পাঠক ও অধ্যাপক হিসেবে তিনি তত্ত্বকে বিরল সাহসে প্রয়োগে পরিণত করেছেন, ব্যবহারিক জীবনে ও সারস্বত জগতে খাঁটি সোনার অন্বেষণ তাঁকে নিরন্তর তাড়া করে বেড়িয়েছে। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় অনেক সময়ই তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগকে রসিকতা করে বুদ্ধদেব বসুর ‘ড্রয়িং রুমের এক্সটেনশন’ বলে বর্ণনা করতেন, অর্থাৎ তাঁর এষণা ছিল নতুনতর এক সংজ্ঞা, বিস্তৃততর এক ভাষ্য। সাহিত্যের গলিঘুঁজি থেকে নথি সংগ্রহ করা, সেগুলোকে সময়গ্রন্থির প্রেক্ষিতে শ্রেণিবদ্ধ করে তালিকা প্রস্তুত করা, এক সম্পূর্ণতর ইতিহাস রচনা করা, যাকে বলা হয় এম্পিরিকাল স্টাডি অব লিটারেচার, তা তাঁকে বিশেষ ভাবে টানত। অধ্যাপক শুভা দাশগুপ্তের ভাষায়, তুলনামূলক সাহিত্যের ক্ষেত্রে, সাহিত্যিক পরিগ্রহণ ইত্যাদি চর্চার ক্ষেত্রে, এই দৃষ্টিভঙ্গির কোনও বিকল্প হয় না।
বুদ্ধদেব বসু মহাভারতের কথা-য় অন্যদের সঙ্গে তাঁর প্রতি ঋণ স্বীকার করেছেন। তাঁর ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রকাশিত বইয়ের তালিকা দেখলে চমকে উঠতে হয়। ছাত্রাবস্থা থেকেই আবু সয়ীদ আইয়ুবের সঙ্গে যোগাযোগ, যার ফল আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ, পান্থজনের সখা, পথের শেষ কোথায় (অমিয় চক্রবর্তী ও ‘সুহৃত্তমেষু’ স্বপন মজুমদারকে উৎসর্গীকৃত), টেগোর্স্ কোয়েস্ট-এর মতো ক্লাসিক। আইয়ুব ছাড়াও পাঠচর্চায় তাঁকে প্রভাবিত করেছেন তাঁর স্কটিশ চার্চ কলেজের অধ্যাপক অলোক রায়, রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত এবং শঙ্খ ঘোষ। শঙ্খের ঐতিহ্যের বিস্তার তাঁকে ও নমিতা মজুমদারকে উৎসর্গ করা।
তাঁর আগ্রহে যে সব আশ্চর্য বই প্রকাশিত হয়েছে তার মধ্যে আছে রবীন্দ্রকুমারের ঐতিহ্য ও পরম্পরা, ইংলিশ পোয়েটস অন ইন্ডিয়া অ্যান্ড আদার এসেজ়, ইস্ট ওয়েস্ট লিটরারি রিলেশনস, কালিদাস নাগের ডায়েরি ও কবির সঙ্গে একশ দিন, হরিশ ত্রিবেদীর কলোনিয়াল ট্রানজ়্যাকশনস, শঙ্খ ঘোষের কালের মাত্রা ও রবীন্দ্রনাটক, এ আমির আবরণ, শব্দ আর সত্য, ছন্দময় জীবন, ইশারা অবিরত, দামিনীর গান, শিশিরকুমার দাশের বঙ্কিমচন্দ্র: অ্যান আর্টিস্ট ইন চেনস, সাহিব্স্ অ্যান্ড মুনশিজ়, শাশ্বত মৌচাক: রবীন্দ্রনাথ ও স্পেন (শ্যামাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে), বাংলা ছোটগল্প, আত্মজীবনী, জীবনী এবং রবীন্দ্রনাথ, নরেশ গুহ সম্পাদিত কবির চিঠি কবিকে, সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা, প্রবন্ধ ও গল্পসংগ্রহ, সুশোভন সরকারের পরিবর্ধিত অন দ্য বেঙ্গল রেনেসাঁস, সুমিত সরকারের আ ক্রিটিক অন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া। বাংলায় প্রকাশ করেন ভার্জিনিয়া উলফ-এর নিজস্ব এক ঘর, পুনর্মুদ্রণ করেন লা রোশফুকোর মাক্সিম।
বইকে ভালবাসার লোক আছে, কিন্তু এগিয়ে এসে (অনেক সময়, বাড়িতে গিয়ে) ভাল বই আবিষ্কার করে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব ক’জন নিতে চান? তরুণ লেখকদের খুঁজে বার করতে পছন্দ করতেন। সর্বানন্দ চৌধুরীর গানের বইয়ে রবীন্দ্রনাথের গান, রামপ্রসাদী, সঙ্গীতবিজ্ঞান প্রবেশিকা: রবীন্দ্রপ্রসঙ্গ স্বপন মজুমদারের গ্রন্থভাবনা। কখনও হাত থেকে নিয়ে ব্যাগে ভরে পাণ্ডুলিপি নিয়ে যেতে দেখেছি। এক সময় আমার মতো আনকোরা তরুণের কাছে গভীর আত্মবিশ্বাসে কালিদাস নাগ ও রোম্যাঁ রলাঁর বিপুল চিঠিপত্রের পাণ্ডুলিপি অর্পণ করেন ফরাসি থেকে ইংরেজি অনুবাদের জন্য, এবং প্যাপিরাস থেকে প্রকাশ করেন দ্য টাওয়ার অ্যান্ড দ্য সি (১৯৯৬) নামে। টি এস এলিয়ট বিষয়ক ইংরেজি গ্রন্থটি ছাপার দায়িত্ব নেন, কারণ সর্বদা সাহেবদের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ তাঁর মনঃপূত ছিল না।
শুভ্র পাজামা-পাঞ্জাবি পরিহিত, ধারালো চেহারার, মার্জিত, স্পষ্ট উচ্চারণের মানুষটি ছিলেন বাঙালিয়ানার এক দীর্ঘকায় প্রতিনিধি। তাঁর নিজের উল্লেখযোগ্য কাজ, বাংলা সাধারণ রঙ্গমঞ্চের শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে সুবীর রায়চৌধুরীর সহ-সম্পাদক হিসেবে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ থেকে প্রথম প্রকাশিত বিলাতী যাত্রা থেকে স্বদেশী থিয়েটার (১৯৭২)। এ ছাড়া আছে বহুরূপী ১৯৪৮-১৯৮৮ (১৯৮৮) ও সাত দশকের থিয়েটার ও অন্যান্য (১৯৯৮), কমপ্যারেটিভ লিটারেচার: ইন্ডিয়ান ডাইমেনশন্স (১৯৯৭), তাঁর সম্পাদিত অবিনাশচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়ের গিরিশচন্দ্র, এবং অনূদিত গিরিশ কারনাডের দু’টি নাটক হয়বদন ও নাগমণ্ডলম। অনেকের মতে, তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ অবদান জাতীয় গ্রন্থাগার থেকে প্রকাশিত রবীন্দ্রগ্রন্থসূচি (১৯৮৮)। তাঁর বক্তৃতার এক বিরাট ভান্ডার এখনও অপ্রকাশিত।
মাত্র ২৩ বছর বয়স (১৯৬৯) থেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপনা করেছেন, কোয়েস্ট পত্রিকায় আইয়ুবের সহকারী ছিলেন, কয়েক বছর যাদবপুর জার্নাল অব কমপ্যারেটিভ লিটারেচার-এর সম্পাদক ছিলেন, বিশ্বভারতী কোয়ার্টার্লি ও রবীন্দ্রবীক্ষা-র মতো পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন, সাহিত্য অকাদেমির পূর্বাঞ্চলীয় অনুবাদ কেন্দ্রের দায়িত্ব সামলেছেন, যাদবপুরের স্কুল অব কালচারাল টেক্সটস অ্যান্ড রেকর্ডস-এর প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম-সম্পাদক ছিলেন, এক সময় ফিজি-র ভারতীয় দূতাবাসে ইন্ডিয়ান কালচারাল সেন্টার-এ অধ্যক্ষ, বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ ও রবীন্দ্র ভবনের অধ্যক্ষ ছিলেন, ভারতীয় ভাষা পরিষদ, ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, জ্ঞানপীঠ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করেছেন। কিন্তু সমস্ত কর্মকাণ্ডকে গ্রথিত করেছে এক স্থিতধী চিন্তকের আবিষ্কারতৃষ্ণা।
রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত বলতেন, “স্বপনের একটা ক্লাসিকাল মন আছে।” জীবনভাবনায় এই ক্লাসিসিজ়ম তাঁকে দিয়েছে গড়পড়তা শিক্ষিত বাঙালির থেকে আলাদা এক বিশিষ্টতা। এই ক্লাসিসিজ়মের জন্যই হয়তো তাঁর মধ্যে একটা মধুর কঠিনতার দিক ছিল, রেগে যেতে দেখেছি— একটি মনোরম রচনায় যে কথা লিখেছেন প্রতিমা ঘোষ—দেখেছি নম্র লাজুক হাস্যরসও। তাঁর বন্ধুবৃত্তে ছিলেন স্বয়ং শঙ্খ ঘোষ, শিশিরকুমার দাশ, অমিয় দেব, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও সৌরীন ভট্টাচার্য। সৌরীনবাবু রসিকতা করে বলেন, “স্বপনকে আমরা ভয় পেতাম। তাঁকে না বলে নিজের দায়িত্বে বই কিনলে ভীষণ রাগ করত! কোন কোন বই আমাদের কেনা উচিত, কোন বইয়ের খবর রাখা উচিত স্বপন আমাদের বলে দিত।” গ্রন্থনির্মাণের এই দিব্যোন্মাদ কারিগরের কাছে আমাদের ঋণের শেষ নেই।
রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধদেব বসুকে লিখেছিলেন, “ভালো লাগা জিনিসটা ফুল ফোটার মতোই রমণীয়।” স্বপন মজুমদারের ভুবন এক ভাল লাগার স্বপ্ন দিয়ে গড়া। অক্ষর তাঁর স্নায়ুকে এক অপার্থিব দীপ্তি দিয়েছিল।