কমলদল খোলানোর হিসেব
Abhishek Banerjee

ক্ষমতা দখলের দৌড় কি তবে অন্যের পায়ে ভর করে

বিষয়টিকে খুব অপ্রত্যাশিত বলা চলে না। পুজোর পর থেকে রাজ্যে সিবিআই-এর তৎপরতা বাড়বে, উঁচুতলা নিয়ে টানাটানি হবে

Advertisement

দেবাশিস ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৫:১১
Share:

n বাহিনী: তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে সিবিআই প্রবেশ, কলকাতা, ২৩ ফেব্রুয়ারি। পিটিআই

পদ্ম যেন ক্রমে পাপড়ি মেলছে। নির্বাচনের দিন ঘোষণা এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। ঠিক তার আগেই সিবিআই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি পৌঁছে গেল। এর নিহিত অর্থ কোলের শিশুটিও বোঝে। সিবিআই-এর আপাতলক্ষ্য অবশ্য অভিষেকের স্ত্রী রুজিরা। তদন্তকারীদের অভিযোগ, কয়লা পাচার চক্রের টাকা বিদেশের একটি ব্যাঙ্কে রুজিরার নামে জমা পড়েছে। বাকিটা অনুচ্চারিত। তবে বিজেপি মুখর। অনেক কিছু শোনা যাচ্ছে দলের নেতাদের মুখে।

Advertisement


বিষয়টিকে খুব অপ্রত্যাশিত বলা চলে না। পুজোর পর থেকে রাজ্যে সিবিআই-এর তৎপরতা বাড়বে, উঁচুতলা নিয়ে টানাটানি হবে— এমন কথা বিজেপিমহলে যথেষ্ট চাউর ছিল। সেই ভাবেই পদ্মের মতো পরতে পরতে প্রস্ফুটিত হতে হতে ভোট যখন দরজায় এসে পড়ল, সিবিআই তখন অভিষেকের দুয়ারে। যার অর্থ, তদন্ত একেবারে রণাঙ্গনের কেন্দ্রস্থলে।


বিধিসম্মত সতর্কীকরণের জন্য অবশ্য এটাও বলে রাখা দরকার, সিবিআই-ইডি সবাই স্বাধীন তদন্তকারী সংস্থা বলে পরিগণিত। এটা তাদের ঘোষিত অবস্থান। তারা নিজেরাও সর্বদা বলে থাকে, রাজনীতির স্বার্থরক্ষা করা তাদের কাজ নয়। কিন্তু, ঘটনা-পরম্পরা রাজনীতির আবর্ত থেকে কিছুতেই বেরোতে পারছে না। অনেকেরই প্রশ্ন, এ বার তা হলে কী হবে? নির্বাচনী রাজনীতির গতি কি খানিকটা একমুখী হয়ে পড়বে? মূল্যবৃদ্ধি, উন্নয়ন, সামাজিক সুরক্ষা ইত্যাদি বিষয় থেকে শুরু করে নাগরিকত্ব, জাত-ধর্ম সব ছাপিয়ে কি এ বার শাসক তৃণমূলের বিরুদ্ধে সুকৌশলে সিবিআই তদন্তকেই প্রধান হাতিয়ার করতে চাইবে বিজেপি? তৃণমূলই বা কোন পথ নেবে?

Advertisement


সবাই বোঝেন, এই রকম ঘটনাপ্রবাহের দু’টি অভিমুখ। একটি আইনকানুন সংক্রান্ত। অন্যটি ঘোরতর রাজনৈতিক। সেটিই আসল এবং চাপও সেখানেই। কারণ, সাংসদ অভিষেক একাধারে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো তথা এ বারের ভোটে শাসক শিবিরের অন্যতম সেনাপতি। অর্থাৎ, এক ঢিল, নিশানা একাধিক! মুখে যিনি যা-ই বলুন, রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন ঘোষণার একেবারে দোরগোড়ায় এসে বিষয়টি তাই তৃণমূলের উদ্বেগ ও বিড়ম্বনা বাড়িয়ে দেওয়ার পক্ষে কম নয়।


ইদানীং ‘পারসেপশন’ নিয়ে প্রায়শই আমরা চর্চা করি। বিশেষত রাজনীতিতে পারসেপশন বা জনমানসে তৈরি হওয়া সাধারণ ধারণা যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে, সে সম্পর্কে বিশেষ দ্বিমত থাকার কথা নয়। ভারতের রাজনীতিতে তার নজিরও রয়েছে। এখন আলোচ্য ঘটনায় একটি পারসেপশন যদি হয় রাজ্যের শাসক নেতৃত্বকে বিপাকে ফেলার ‘সময়োচিত’ কৌশল, অন্যটি তৃণমূলের উঁচুতলা ঘিরে সংশয়-সন্দেহ-অবিশ্বাসের মেঘ জমা। এর কোনওটিই এক কথায় উড়িয়ে দেওয়ার নয়। জনগণ কখন কোনটি কী ভাবে নেয়, কে বলতে পারে!
আর এ সব অভিযোগের পুরোপুরি নিষ্পত্তিও সময়সাপেক্ষ। এতে সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি আইনি প্রক্রিয়া জড়িত থাকে। প্রমাণ বা খারিজ কিছুই তাই রাতারাতি হওয়ার সম্ভাবনা কম। ফলে ভোটের ময়দানে সবটাই হয়ে উঠবে প্রচার-নির্ভর। কারা কোন প্রচারকে কতটা ‘কাজে’ লাগাতে ‘সফল’ হবেন, সেটা সম্পূর্ণত তাঁদের নিজেদের ব্যাপার।


ঘটনা হল, নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ থেকে শুরু করে বিজেপির নেতারা অনেক আগে থেকেই অভিষেককে আক্রমণের নিশানা করে তুলেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে যে ধরনের অভিযোগ তাঁরা করেন, সিবিআই-এর এই পদক্ষেপের সঙ্গে তা সঙ্গতিপূর্ণ। তাই এ বার সিবিআই-এর ভূমিকাকে সামনে এনে বিজেপি সেই প্রচারকে নিঃসন্দেহে তুঙ্গে তোলার চেষ্টা করবে বলে ধরে নেওয়া যায়। আর যদি তা হয়, সেই ক্ষেত্রে ‘দুর্নীতি’-ই হতে পারে বিজেপির ভোট-যুদ্ধের অন্যতম অস্ত্র। উদ্দেশ্য সহজ। তৃণমূলের শীর্ষমহলকে সরাসরি ‘লক্ষ্যবস্তু’ করে আক্রমণ শানানো।


রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে বিজেপির দিক থেকে এটা সুবিধাজনক মনে করার আরও কিছু কারণ আছে। দুর্নীতির অভিযোগ এমন এক বিষয়, যেটা ‘বাজারে খাওয়াতে’ বিশেষ বেগ পেতে হয় না। অভিযোগ এবং তা প্রমাণ হওয়ার ভেদরেখাও প্রচারে উবে যায়। আর প্রতিপক্ষকে সেই প্রচারের মোকাবিলায় ব্যস্ত রাখা যায়।


সাধারণত শাসকের লড়াই হয় সরকারের কাজকর্মকে সামনে রেখে ‘ইতিবাচক’ ভিত্তিতে। বিরোধীরা নেতিবাচক কথা বলেন। কিন্তু দেখেশুনে মনে হচ্ছে, মমতাও এ ক্ষেত্রে সরাসরি কঠোর প্রতি-আক্রমণেই যেতে চাইছেন। সিবিআই, দুর্নীতি প্রভৃতি প্রসঙ্গ থেকে মোড় ঘোরানোর বদলে এটা হয়তো তাঁর কাছেও একটি রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ। বস্তুত, অভিষেকের স্ত্রীর কাছে সিবিআই যাওয়ার ঠিক আগে ওই বাড়িতে গিয়ে তিনি বোধ হয় তেমন বার্তাই দিতে চেয়েছেন।


এরই পাশাপাশি শাসকদের হাতে আছে মাদক-পাচার কাণ্ড। সেখানে পুলিশের হাতে বামাল ধৃত বিজেপির যুব নেত্রী ও তাঁর আশপাশের লোকদের কথাবার্তায় যে সব নাম ছিটকে বেরোচ্ছে, তাতে বিজেপির বড় বড় নেতার গরিমাবৃদ্ধির কোনও অবকাশ নেই। এখানে বরং কেন্দ্রীয় শাসক দলই রীতিমতো ব্যাকফুটে। তবে কেলেঙ্কারি ও দুর্নীতির বিভিন্ন অভিযোগ থেকে শুরু করে সিবিআই তদন্ত অভিষেকের বাড়ি পর্যন্ত গড়ানোর মতো বিষয়গুলি ছাড়াও তৃণমূল ভাঙিয়ে ভোটে যাওয়া বাংলায় বিজেপির ক্ষমতা দখল প্রকল্পের আর একটি কুশলী কার্যক্রম। সেটাও এখন আর গোপন নেই। যেখানে যে ভাবে হোক, এ চেষ্টা তারা ভোট পর্যন্ত চালিয়ে যাবেই।


এখন যেমন কানাকানিতে চোদ্দো জন সাংসদের হিসেব চলছে। যাঁদের বঁড়শিতে গেঁথে তুলতে বিজেপি ঘোলা জলে ছিপ ফেলেছে বলে প্রচার। লক্ষ্য, দলত্যাগ বিরোধী আইন মেনে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য ভাঙিয়ে লোকসভায় তৃণমূল কংগ্রেসকে ‘সাইজ়’ করে ফেলা।
এ পর্যন্ত অবশ্য লোকসভার এক জন ও রাজ্যসভার এক জন শুধু ইস্তফা দিয়েছেন। তবে বাস্তবে যা-ই হোক, ভোটের বাজারে এমন গণ-দলত্যাগের গুঞ্জন ছড়িয়ে দেওয়া হলে তাতে প্রতিপক্ষের কূট-কৌশলই পুষ্টি পায়। তর্কের তোয়াক্কা না করে এ ক্ষেত্রেও জনমনে ‘বিশ্বাস’ ক্রমশ দানা বাঁধার পরিসর পেয়ে যায় এবং তাতেও কিছুটা কার্য হাসিল হয়। বিজেপি সেই চেষ্টা জারি রেখেছে।


এর আরও একটি দিক আছে। এমন প্রচার ছড়ানো গেলে তার সঙ্গে সংশয় ও অবিশ্বাসের হাওয়ায় দলীয় সতীর্থরাও একে অপরের নজরে ‘হাইলি সাসপিশাস’ হয়ে পড়েন। অনেকেই ভেবে নেন, তাঁর পাশের ব্যক্তিটি নির্ঘাত ‘টোপ’ গিলেছেন। তাতে আখেরে ঘা খায় দলের সংহত কাঠামো। বিশেষ করে ভোটের সময় এমন হওয়া তাই যে কোনও দলের পক্ষেই সমস্যার কারণ।


সত্যি-মিথ্যে জানি না, কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেসের অন্দরে শুনতে পাওয়া যাচ্ছে, কোনও সাংসদের ‘দর’ নাকি উঠছে পঁচিশ কোটি, কারও পঞ্চাশ কোটি, কেউ আবার হেঁকেছেন একশো! যাঁদের নামে এ সব রটে, তাঁরা যে কোনও কিছুই স্বীকার করবেন না, সেটা তো স্বাভাবিক। তবে যা রটে, হয়তো তার কিছু নিশ্চয় সত্যি বটে! হতেই পারে, কেউ কেউ অঙ্ক কষছেন। নিজেদের ‘দামি’ ভেবে অনেকে মনে মনে পুলকিত হচ্ছেন! সন্দেহ নেই, হয়তো সচেতন ভাবেই কারও কারও লোভের মাত্রা এই সব সংখ্যার উচ্চারণ দিয়ে বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।


তবু, দলত্যাগের আইন বাঁচিয়ে নির্দিষ্ট সংখ্যক তৃণমূল সাংসদ এখনই, বিধানসভা ভোটের আগে, রাতারাতি দল বেঁধে বিজেপি-তে চলে যাবেন বলে মনে হয় না। কারণ, রাজ্যে তৃণমূল ক্ষমতায় ফিরলে তার ‘সুফল’ দিল্লিতে তাঁরাও ভোগ করতে পারবেন। আর যদি ফল অন্য হয়, তা হলেও আগামী তিন বছর তাঁদের সাংসদ পদ নিয়ে সমস্যার কারণ নেই।


তবে এই সব থেকে একটি বিষয় কিন্তু পরিষ্কার। ক্ষমতার দৌড়ে নামা বিজেপির বড় ভরসা অন্যের শ্রীচরণ! তা সে তদন্তকারী সংস্থাই হোক, বা দল ভাঙা তৃণমূল!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement