মহিলাদের বিবাহ-উত্তর পদবি পরিবর্তন।
মহিলাদের বিবাহ-উত্তর পদবি পরিবর্তন: ‘এমনটা হয়েই থাকে’ ধরনের আপাত মানসিক স্বাছন্দ্যের যুক্তি মেনে চলে প্রায় সব বৈবাহিক সম্পর্ক। ভাবখানা— পদবি পরিবর্তন না করার কারণই বা কী?
একটি মেয়ে, আবাল্য আকৈশোর একটি নাম, পদবিকে নিয়ে বেড়ে উঠল। তার সঙ্গে যুক্ত তার পিতৃপরিচয়, পারিবারিক উত্তরাধিকারের চিহ্ন। এবং তার শিক্ষাগত যোগ্যতার শংসাপত্রে লেখা তার নাম পদবি। শুধুমাত্র, আর একটি নতুন সম্পর্কের জন্য, শিক্ষাপ্রসূত এবং আইনগত সব অস্তিত্বকেই বদলে ফেলতে হবে আপাদমস্তক!
তথাকথিত প্রথম বিশ্বেও সমান সত্য এই প্রথা। সমীক্ষা বলে ইংল্যান্ডের ৯০% মহিলা এই প্রথার অনুসারী। ১৮-৩০ বছর বয়সিদের মধ্যেও এর প্রচলন ৮৫%। বিবিসি-র সমীক্ষায় আমেরিকার ৭০% মহিলা বিবাহের পরে পদবি পরিবর্তনে বিশ্বাসী। একমাত্র গ্রিসে ১৯৮৩ থেকে মহিলাদের পদবি পরিবর্তনের বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন হয়— বাকি ইউরোপের প্রায় সব দেশেই প্রচলিত এই প্রথা। কিন্তু, নারী জাগরণের ইতিহাস পদবি পরিবর্তনের বিষয়ে কী বলে?
আগে মহিলাদের পদবি ব্যবহারের চল ছিল না বললেই চলে। দেবী, দাসী বা রানি ব্যবহারই ছিল যথেষ্ট, যদি আদৌ নাম ব্যবহারের প্রয়োজন হয়। শিক্ষা, শংসাপত্র বা আইনি প্রয়োজন সব ক্ষেত্রেই তাঁদের ‘নেই মানুষ’ করে রাখা। পদবি দূরস্থান, অনেক ক্ষেত্রে নামটুকুও তো মনে রাখত না কেউ। এই প্রথাকে ‘টেকনোনিমি’, অর্থাৎ অন্যের সঙ্গে সম্পর্কের সূত্রে নামকরণের প্রচলন বলে চিহ্নিত করে সমাজবিজ্ঞান। অমুকের মেয়ে, তমুকের স্ত্রী, বড় মেজো সেজো বৌ, পুত্র বা কন্যার নামে মা-র নাম ইত্যাদির অছিলায় নারীর পরিচয়কে মেঘে ঢেকে রাখত সমাজ।
প্রথাগত শিক্ষার আলোয় আসা শুরু হলে মেয়েদের নির্দিষ্ট ভাবে নামের দরকার হল। তাই কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়, চন্দ্রমুখী বসু, অবলা বসুর নাম সামনে এল। ‘পাশ’ দিলেন তাঁরা, তাই শংসাপত্রেরও প্রয়োজন। কাদম্বিনী বিবাহপূর্বে ছিলেন কাদম্বিনী বসু, দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিবাহসূত্রে তাঁর গঙ্গোপাধ্যায় পদবি লাভ। দুর্গামোহন দাসের কন্যা অবলা দাস নামে ভর্তি হন মাদ্রাজের মেডিক্যাল কলেজে। জগদীশচন্দ্র বসুর সঙ্গে বিবাহের পর তাঁর নাম হয় অবলা বসু। তাই পদবির অধিকার রাখা হয় না তাঁদেরও।
যে বাড়িতে মেয়েরা প্রথম ঘোড়া চড়লেন, বাড়ির বাইরে এলেন; গল্প, প্রবন্ধে ঝলমল করে উঠল অন্দরমহল, সেই বাড়িতেও কি মেয়েরা পেলেন সমান অধিকার? কেন ‘ঠাকুর’ পদবি ব্যবহৃত হয় না কাদম্বরী, জ্ঞানদানন্দিনী, মৃণালিনী, সরলা দেবী চৌধুরাণীর নামের পাশে? হয়তো প্রথাগত শিক্ষার জগতে পদার্পণ করা, না করা দিয়ে উত্তর খাড়া করা যায়। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও প্রশ্ন ওঠে শিক্ষা, পেশার প্রয়োজন না থাকলে পারিবারিক নাম বা পদবির উত্তরাধিকারেও অধিকার নেই? এ কেমন প্রহসন?
ইতিহাসের পাতায় চোখে পড়ে, ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাই, রানী দুর্গাবতী বা অহল্যাবাই— পারিবারিক উত্তরাধিকারের অংশ রাজপদবি ব্যবহার করেননি বা করতে পারেননি কেউই। সত্যি যদি রাজপদবিতে, রাজ-উত্তরাধিকারে নারীর অধিকার স্বীকার করত তৎকালীন প্রথা বা আইন, লক্ষ্মীবাইকে নাবালক পুত্রকে সিংহাসনে বসাতে বাধ্য না করা হত, কে জানে ভারতের ইতিহাস ভিন্ন পথে বইত কি না?
এই বৈষম্যের অন্ধকার ইতিহাসে আলোর বিন্দু প্রভাবতীগুপ্ত। সময়কাল ৩৯০ খ্রিস্টাব্দ, কাদম্বিনীদের থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে।
প্রভাবতীগুপ্ত গুপ্তবংশের তৃতীয় রাজা, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের কন্যা। প্রভাবতীর বিয়ে হয় বাকাটক সাম্রাজ্যের রাজা দ্বিতীয় রুদ্রসেনের সঙ্গে। তিন পুত্রের জন্মের কিছু দিন পরেই মারা যান রাজা রুদ্রসেন। সবাই অনুমান করেন রাজপরিবারের প্রথা অনুযায়ী নাবালক রাজপুত্রকে সিংহাসনে বসিয়ে রাজ্যশাসন করবেন কোনও রাজপুরুষ, অথবা রুদ্রসেনের ভাইয়েরা কেউ সিংহাসনের দায়িত্ব নেবেন।
ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত নিয়ে ছেলেকে সামনে রেখে সিংহাসনে বসেন প্রভাবতী। এবং নতুন শাসনের সব আদেশ, সব সিলমোহর, সব মুদ্রায় তাঁর নাম, পিতার পদবি-সহ প্রভাবতীগুপ্ত। গোত্রও পরিবর্তন করেননি তিনি। পুত্র সাবালক হলে, তার রাজ্যাভিষেকের পরেও সংযুক্ত শাসক হয়ে থেকে যান নিজেও। আইন প্রণয়ন, জমির বিলি বন্দোবস্ততে তাঁর নাম, সই, সিলমোহরের গুরুত্ব প্রতিষ্ঠিত থাকে।
সাহসটা আমাদেরও করতে হবে। ‘গোত্র বদল হয়েই তো যাচ্ছে, পদবিতে কী-ই বা আসে যায়’ ধরনের যুক্তির আড়ালে অনেকগুলো প্রবঞ্চনার মুখোশ লুকিয়ে থাকতে পারে। আইনি প্রবঞ্চনা, হক কেড়ে নেওয়ার সুচিন্তিত কৌশল।
আমাদের প্রত্যেকের নিজস্ব এক রাজত্ব, সিংহাসনে অধিকার আছে। শিক্ষার, আইনি অধিকারের, স্বাধীনতার, সম্মানের। সিলমোহর সুরক্ষিত করার লড়াই, প্রভাবতীর মতো আমাদেরও।