— প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
সহকর্মীর কন্যাসন্তান হঠাৎ ভর্তি হাসপাতালে। কী অসুখ— তাঁরা বলতে অনিচ্ছুক। জানতে পারা গেল, মেয়েটি ঋতুস্রাবের অসহ্য ব্যথায় জ্বরে আক্রান্ত। শুনে অন্য সহকর্মীও নিজের মেয়েকে নিয়ে চিন্তিত। শরীরের স্বাভাবিক এক চক্র নিয়ে এত আতঙ্ক, চিন্তার মূলে কি সমাজের মনোভাব? কোথা থেকে শুরু যুগসঞ্চিত এই মনোভাবের?
হয়তো কন্যাসন্তানের মা হওয়া থেকেই শুরু! “তোমাদের তো মেয়ে, বুঝবে না— ছেলেরা যা দুষ্টু।” অথবা “ছেলেদের যা সমস্যা, মা না করে দিলেই নয়।” উচ্চশিক্ষিত মায়েদের মুখেও এমন বিভেদমূলক উচ্চারণ!
এই বিভেদমূলক মনোবৃত্তি জন্ম দেয় সমাজমাধ্যমে ‘#বয়মম’ (ছেলের মা) প্রভৃতি ভাইরাল ট্রেন্ডের। সেখানে আলোচনা চলে ছেলের মা হওয়া কতটা আলাদা, কতটা গর্বের! দেখেশুনে অনেক মেয়ের মায়েরাই বিরক্তি সত্ত্বেও চুপ করে থাকেন। “ওর ভাই থাকলে ভাল হত।” “মেয়ে চলে যাবে, তোমাদের কে দেখবে?”— এই ধরনের মন্তব্যগুলিকে উপেক্ষাতেই যাঁরা অভ্যস্ত বরাবর।
ঋতুযন্ত্রণার তীব্রতা মাপতে, এবং তা পুরুষ গবেষকদের কাছে স্পষ্ট করতে লাক্স পেরি তৈরি করেছেন ‘পিরিয়ড পেন সিমুলেটর’। যন্ত্রটির তার মারফত ‘পিরিয়ড ক্র্যাম্প’-এর বৈজ্ঞানিক পরিমাপের সমান পেশির টান পৌঁছয় শরীরে। দেখা গিয়েছে, হৃদ্রোগের যন্ত্রণার সমপরিমাণ এই ব্যথা। মাসে পাঁচ দিন প্রায় ১৯০ কোটি মহিলা তাতে ভুক্তভোগী। যে ১৭.৬ কোটি মহিলার এন্ডোমেট্রিয়োসিস, পিসিওডি-র মতো অসুখ, তাঁদের যন্ত্রণা আরও বেশি। প্রায় ১৬০০০ পুরুষের উপর যন্ত্রটির পরীক্ষা করা হয়। কেউই কয়েক মিনিটের বেশি সইতে পারেননি। অথচ, গড়ে মাসে একটানা প্রায় ১০-১২ ঘণ্টা মহিলারা সব কাজের মধ্যেই তা সহ্য করছেন।
এত ভয়ঙ্কর শারীরিক অবস্থা! কিন্তু সেই অনুপাতে গবেষণা, ওষুধের সন্ধান নগণ্য। পুরুষদের সমস্যা নয় বলেই কি এত অবহেলা? জানা গিয়েছে, চিকিৎসার অভাবে পুরুষদের অনুপাতে মহিলারা জীবনের ২৫ শতাংশের বেশি সময় অসুস্থ থাকেন। স্ত্রীস্বাস্থ্য নিয়ে ওষুধ সংস্থাগুলির আলাদা আগ্রহ নেই। মানবদেহে ওষুধ যাচাইকালে পুরুষদের তুলনায় মাত্র এক-তৃতীয়াংশ মহিলা স্বেচ্ছাসেবীকে ডাকা হয়। ফলে হৃদ্যন্ত্রের অসুখ, ডায়াবিটিস ইত্যাদির প্রচলিত ওষুধ নারীদেহে, ঋতুচক্রে কী প্রভাব ফেলে জানাই যায় না। এমনকি কোভিড অতিমারি নারীশরীরে, ঋতুস্রাবে কী প্রভাব ফেলেছিল, সে গবেষণাই হয়নি।
সারা বিশ্বে সন্তানধারণের বয়সের প্রায় ১০% মহিলা এন্ডোমেট্রিয়োসিস, অতিরিক্ত ঋতুস্রাবের যন্ত্রণায় ভুগছেন। কিন্তু গড়ে প্রতি দশ জন আক্রান্তের মধ্যে এক জন চিকিৎসা পান। আমাদের এই তৃতীয় বিশ্বে সংখ্যাটা আরও কম।
স্যানিটারি ন্যাপকিনের সুবিধা বাড়িয়ে দারিদ্রজনিত স্ত্রীস্বাস্থ্যের সমস্যা কিছুটা সামলানো যায়, ঋতুস্রাবজনিত গবেষণার অপ্রাপ্তি ঘোচে না।
ওষুধ সংস্থাগুলির বাজেটের মাত্র ১% বরাদ্দ মহিলাদের স্বাস্থ্যখাতে। রিপোর্ট দেখাচ্ছে, যে রোগে পুরুষরা ভোগেন, সেখানে অর্থের জোগান স্ত্রীরোগের চেয়ে প্রায় ৮০% বেশি। মহিলাদের বেশি হয় এমন অসুখে (যেমন অটোইমিউন ডিসঅর্ডার) রোগ নির্ণয়েই লাগছে প্রায় ১০ বছরের বেশি। এতে নতুন ওষুধের সম্ভাবনা কমছে।
‘মেডিক্যাল গ্যাসলাইটিং’-এর সমস্যাও প্রখর। অর্থাৎ, সমস্যায় কর্ণপাত না করেই চিকিৎসাকর্মীরা বলেন: মনের ভ্রম, মহিলা বলে ব্যথা সহ্য করতে পারছেন না, বাড়িয়ে বলছেন! ঋতুস্রাবে রক্তের জমাট বাঁধা আটকাতে ‘ওরাল অ্যান্টিকোয়াগুলেন্ট’ দিতে চান না ডাক্তাররা। পিসিওডি, থাইরয়েডের অতিরিক্ত ব্যথাও নাকি মানতে অনীহা। পলিটিক্স অব হিস্টেরেক্টমি গবেষণাপত্র মতে, ঋতুপ্রারম্ভের বছরগুলির চেয়েও বেশি অবহেলা রজঃনিবৃত্তিকালে। এই সময়ের শারীরিক, মানসিক পরিবর্তনের কথা এখন অজানা নয়। শুনছে কে?
পারমিতার একদিন ছবির সেই দৃশ্যটি মনে আছে? শাশুড়ির কষ্টের কথা তুললে পারমিতার স্বামী বলে, মায়ের সম্পর্কে এই সব শুনতে নেই। এই সুবিধাবাদী উপেক্ষা দিয়েই চলেছে বহু দিন। এখন মহিলারা উপার্জনক্ষম, তাই চিকিৎসায় সচেষ্ট। কাজে বেরোলে অনিয়মিত ঋতুস্রাব, শারীরিক কষ্ট অকস্মাৎ অসুবিধায় ফেলে যে! ক্লান্ত, অসুস্থ করে।
২০১৩-য় সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থ মামলায় জরায়ু বাদ দেওয়ার শল্যচিকিৎসা (হিস্টেরেক্টমি) নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। আদালত জানতে পারে, আগের বছরই দেশে প্রায় ৩% মহিলার হিস্টেরেক্টমি হয়েছে। ২০১৫-য় মহারাষ্ট্রের বীড়-এ প্রায় ২২০০ মহিলার হিস্টেরেক্টমি হয়। অনগ্রসর অংশের এই মহিলাদের ঋতুনিবৃত্তি-পরবর্তী চিকিৎসার ব্যয়ে নারাজ সরকারি সংস্থাগুলি জরায়ু বাদ দেওয়াই ভাল ভেবেছে। রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বিমা যোজনার অন্তর্গত বিহার, ছত্তীসগঢ়, রাজস্থানেও হিস্টেরেক্টমি অসংখ্য। অধিকাংশই সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে; রোগীরা প্রধানত দলিত, জনজাতিভুক্ত।
যখন একটু যত্নে, একটু মনোযোগেই হয়তো শারীরিক ও মানসিক কষ্ট লাঘব হতে পারত, তখন জরায়ুর মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটি সরানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়! সন্তান উৎপাদন তো পরের কথা, জরায়ু যে শরীরেরই একটি অঙ্গ! পরিবার পরিকল্পনার খাতিরে পুরুষটি কিন্তু নির্বীজকরণে রাজি হন না। উপেক্ষাকেই বানিয়ে নেন তাঁর স্ত্রীর এই অস্ত্রোপচার করানোর অস্ত্র— “ও মেয়েদের ব্যাপার।”
রাষ্ট্রের এই মানসিকতা, এই উপেক্ষার বিরুদ্ধে স্বর তুলতে যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিতে হবে আমাদের। আমাদের মা, তাঁদের মায়েদের হয়ে। আমাদের মেয়ে, তাদের মেয়েদের জন্য।
সন্ততি যেন সম্পূর্ণ ডানা দুটো মেলে উড়তে পারে— সে কারণেই।