এই মুহূর্তে জনমোহিনী নীতি গ্রহণের সুযোগ সরকারের নেই
Union Budget 2023

বাজেটে কী হতে পারে

ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিক্যাল অফিস (এনএসও) নিয়মিত যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করে, তার থেকে অর্থব্যবস্থার স্বাস্থ্যের আঁচ পাওয়া যেতে পারে।

Advertisement

বিশ্বজিৎ ধর

শেষ আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০২৩ ০৫:০৭
Share:

দেশের মোট ভোগব্যয় গত দু’বছরে খানিক বেড়েছে। প্রতীকী ছবি।

বুধবার পেশ হবে বর্তমান সরকারের পঞ্চম ও শেষ বাজেট। অনুমান করা চলে, ভোটের মুখ চেয়ে এই বাজেটে অনেক জনমোহিনী নীতি থাকতে চলেছে। রাজনীতি সরকারকে সে পথের দিকে আকর্ষণ করবে, কিন্তু ভারতীয় অর্থনীতি এখন যে অভূতপূর্ব আর্থিক সঙ্কটের মুখে দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে এমন নীতি বিপুল ঝুঁকির কারণ হতে পারে।

Advertisement

ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিক্যাল অফিস (এনএসও) নিয়মিত যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করে, তার থেকে অর্থব্যবস্থার স্বাস্থ্যের আঁচ পাওয়া যেতে পারে। এ মাসের গোড়ার দিকে ২০২২-২৩ অর্থবর্ষের জাতীয় আয়ের ফার্স্ট অ্যাডভান্স এস্টিমেটস প্রকাশ করল এনএসও। তাতে অনুমান করা হয়েছে যে, এই অর্থবর্ষে ভারতীয় অর্থব্যবস্থার বৃদ্ধির হার দাঁড়াবে ৭ শতাংশ। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের অনুমান ৬.৮ শতাংশের চেয়ে সামান্য হলেও বেশি। গোটা দুনিয়ার অর্থব্যবস্থা যখন রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ আর কোভিডের ধাক্কায় চিনের আর্থিক স্বাস্থ্যভঙ্গের জেরে কম্পমান, তখন এই বৃদ্ধির হার সরকারের কাছে সুসংবাদ।

২০১৯ সালে এই সরকার বর্তমান দফায় ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই যে সমস্যাটি ভারতীয় অর্থব্যবস্থার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, তা হল ক্রেতাদের মধ্যে চাহিদার অভাব। অতিমারির পর স্বভাবতই সমস্যাটি তীব্রতর হয়েছে। দেশের মোট ভোগব্যয় গত দু’বছরে খানিক বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু ফার্স্ট অ্যাডভান্স এস্টিমেটের অনুমান, ২০২২-২৩ অর্থবর্ষের দ্বিতীয়ার্ধে এই ভোগব্যয়ের পরিমাণ ০.২ শতাংশ কমবে। যে-হেতু রফতানির পরিমাণ কমে গিয়েছে, ফলে সব মিলিয়ে এই অর্থবর্ষের দ্বিতীয় ভাগে চাহিদায় ধাক্কা লাগার আশঙ্কা যথেষ্ট।

Advertisement

আশঙ্কা যে, আগামী কয়েক মাসে মূলত দু’টি কারণে চাহিদা সংক্রান্ত অনিশ্চয়তা চলতে থাকবে। প্রথম কারণটির উৎপত্তি শ্রম বাজারে। সেই বাজারে একই সঙ্গে দু’টি বিপরীতমুখী প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি (সিএমআইই)-র পরিসংখ্যান জানাচ্ছে যে, ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে ভারতে শহরাঞ্চলে বেকারত্বের হার দশ শতাংশের গণ্ডি অতিক্রম করে গিয়েছে, দেশে সার্বিক বেকারত্বের হারও ৮ শতাংশের ঊর্ধ্বে। একই সঙ্গে লেবার ফোর্স পার্টিসিপেশন রেট বা কর্মক্ষম বয়সে থাকা জনগোষ্ঠীর কত শতাংশ কাজ খুঁজছেন, সেই অনুপাতটি সামান্য হলেও বেড়েছে— অক্টোবরের ৩৯% থেকে তা ডিসেম্বরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০.৫ শতাংশে। চাহিদার অনিশ্চয়তার দ্বিতীয় কারণটি হল, বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থায় মন্দা পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় ভারতের রফতানি ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হারের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ভারতের নির্মাণ ক্ষেত্র ও পরিষেবা ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ধাক্কা লাগতে পারে, এবং তার ফলে আবার রফতানি ক্ষেত্রের সমস্যাটি জটিলতর হয়ে উঠতে পারে।

ভারতীয় অর্থব্যবস্থার পরিচালকদের সামনে এখন দ্বিবিধ সমস্যা— এক, রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ যাতে পুরনো কক্ষপথে ফিরে আসা যায়, সে পথে হাঁটতে হবে; এবং দুই, এ বছরের শুরু থেকে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ডেফিসিট বা চালু খাতার ঘাটতি যে ভাবে বেড়েছে, তাতে রাশ টানতে হবে। ২০২১-২২ অর্থবর্ষের শেষে চালু খাতায় ঘাটতির পরিমাণ ছিল জিডিপি-র ১.২%, তার ছ’মাসের মধ্যে সেই ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪.৪ শতাংশে। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক মাঝারি মেয়াদে যে পরিমাণ ঘাটতিকে সুস্থায়ী বলে মনে করে, তার চেয়ে অনেক বেশি।

এই অবস্থায় আসন্ন বাজেটে জনমোহিনী কোনও নীতি গ্রহণ করার অবকাশ নেই। সরকারের কর্তব্য দু’টি গুরুত্বপূর্ণ দিকে মনোনিবেশ করা। প্রথমত, কল্যাণখাতে যথেষ্ট ব্যয়বরাদ্দ নিশ্চিত করা, যাতে শ্রম বাজারে বিপুল অনিশ্চয়তার ফলে শ্রমজীবী মানুষ যে সঙ্কটে রয়েছেন, তার খানিক হলেও সুরাহা হয়; দ্বিতীয়ত, ভারতের কৃষি এবং নির্মাণ ক্ষেত্র যাতে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় যোগ্যতর হয়ে উঠতে পারে, মাঝারি মেয়াদে তার ব্যবস্থা করা। ভারতের পণ্য আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার যোগ্য হয়ে উঠলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের দাঁড়িপাল্লা আমদানির দিকে এমন বিসদৃশ ভাবে ঝুঁকে থাকবে না, চালু খাতে ঘাটতির পরিমাণও নিয়ন্ত্রণে আসবে।

কল্যাণ খাতে বরাদ্দের ক্ষেত্রে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ আইনের যথাযথ রূপায়ণের দিকে নজর দিতে হবে— মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইন, এবং জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা আইন। দেশে বেকারত্বের হার যে বিপজ্জনক স্তরে রয়েছে, কর্মসংস্থান যোজনার বরাদ্দ নির্ধারণের সময় তা মাথায় রাখতে হবে। ভারতের অভিজ্ঞতায় স্পষ্ট যে, শ্রম বাজারে অনিশ্চয়তা বা দোলাচল থাকলে বহু মানুষ গ্রামে ফিরে আসেন, গ্রামীণ অর্থব্যবস্থার উপরে নির্ভর করেন। তাতে প্রচ্ছন্ন বেকারত্ব বাড়ে। কর্মসংস্থান যোজনাকে গুরুত্ব দিলে এই শ্রমশক্তিকে যেমন কাজ দেওয়া যাবে, তেমনই গ্রামাঞ্চলের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু সম্পদও গড়ে তোলা যাবে।

কর্মসংস্থান যোজনার সূচনার সময়ে এই প্রকল্পটিকে দেখা হয়েছিল জনকেন্দ্রিক, চাহিদা-চালিত, স্বনির্বাচনের মাধ্যমে পরিচালিত অধিকারভিত্তিক একটি ব্যবস্থা হিসাবে, যা গ্রামাঞ্চলের মানুষকে বছরে ১০০ দিন মজুরিযুক্ত কাজের নিশ্চয়তা দেবে। এমন একটি প্রকল্প, যা গ্রামাঞ্চলে শ্রম বাজারের অনিশ্চয়তা থেকে মানুষকে নিরাপত্তা দেবে। কিন্তু, পরবর্তী সময়ে প্রকল্পটির রূপায়ণে বিভিন্ন সমস্যা সামনে আসে, যার মধ্যে অন্যতম প্রধান হল বাজেট বরাদ্দের অপ্রতুলতা। গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান দেখলেই ছবিটা স্পষ্ট হতে পারে। ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষে প্রকল্পটিতে প্রকৃত ব্যয়ের পরিমাণ ছিল প্রায় ৬২,০০০ কোটি টাকা, যা পরবর্তী বছরে পৌঁছয় ৭২,০০০ কোটি টাকায়। কোভিড-সঙ্কটের সময় পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যার সমাধানে অস্ত্র হিসাবে সরকার গ্রামীণ কর্মসংস্থান প্রকল্পকে ব্যবহার করে, এই প্রকল্পে খরচ হয় এক লক্ষ দশ হাজার কোটি টাকারও বেশি। কোভিডের ফলে তৈরি হওয়া শ্রম বাজারের সঙ্কট মেটার আগেই অবশ্য ২০২১-২২ সালের বাজেটে সরকার এই খাতে বরাদ্দ কমিয়ে ৯৮,০০০ কোটি টাকা করে; বর্তমান অর্থবর্ষের বাজেটে বরাদ্দ হয়েছিল ৭৩,০০০ কোটি টাকা— কোভিডের ঠিক আগের অর্থবর্ষে এই খাতে যা ব্যয় হয়েছিল, তার চেয়ে মাত্র ২ শতাংশ বেশি। গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা যোজনার খাতে বরাদ্দ কমানোর এই প্রবণতাটির রাশ টানা প্রয়োজন, কারণ এখন যে পরিমাণ টাকা বরাদ্দ হচ্ছে, তা দিয়ে শ্রম বাজারের বিপুল সঙ্কটের মধ্যে গরিব মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়া যাবে না।

জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা আইনের ক্ষেত্রে সমস্যা আরও বেশি। অতিমারির সময় চালু হল ‘এক দেশ এক রেশন কার্ড’ ব্যবস্থা, এই আইনের অধীনে খরচ বৃদ্ধি পেল পাঁচ গুণ। কিন্তু, গ্রামীণ কর্মসংস্থান যোজনার ক্ষেত্রেও যা ঘটেছে, এই আইনের ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটল— পরবর্তী দু’বছরে খাদ্য নিরাপত্তা আইনের অধীনে কল্যাণ প্রকল্পে বরাদ্দের পরিমাণ কমল ৬২%,— ৫.৪ লক্ষ কোটি টাকা থেকে বরাদ্দ কমে দাঁড়াল দু’লক্ষ কোটি টাকার সামান্য বেশি। সরকারের সাম্প্রতিক ঘোষণা— আগামী এক বছর দেশের আশি কোটিরও বেশি মানুষকে বিনামূল্যে রেশন দেওয়া হবে— আরও এক দফা অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। নতুন সংযুক্ত খাদ্য নিরাপত্তা প্রকল্প কার্যকর হয়েছে ২০২৩ সালের পয়লা জানুয়ারি থেকে, যার জন্য বরাদ্দ হয়েছে দু’লক্ষ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবর্ষের বাজেটে খাদ্য নিরাপত্তা আইনের জন্য যে বরাদ্দ হয়েছিল, এই নতুন স্কিমে বরাদ্দের পরিমাণ ঠিক সেটাই। কিন্তু, জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, এই নতুন যোজনার মেয়াদ এক বছর। ফলে, তার পরে জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা আইনের কী গতি হবে, সংশয় তৈরি হয়েছে তা নিয়ে। যখন দেশের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ গণবণ্টন ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল, তা নিয়ে ছেলেখেলা করা চলে না।

কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে সরকারি নীতি নিয়েও ভাবতে হবে। ক্ষেত্রগুলিকে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার যোগ্য করে তোলার লক্ষ্য নিয়েই সেই নীতি স্থির করতে হবে। ২০২০ সালে দেশের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ শিল্পক্ষেত্রে ‘ভারতের শিল্পোৎপাদনের ক্ষমতাবৃদ্ধি এবং রফতানি বৃদ্ধি’ করার উদ্দেশ্যে প্রডাকশন-লিঙ্কড ইনসেনটিভ (পিএলআই) প্রকল্প চালু হয়েছিল। আশা ছিল যে, এই নতুন তৈরি হওয়া শিল্পগুলি ভারতের আমদানি-নির্ভরতা কমাবে, বিশেষত চিন থেকে আমদানির ক্ষেত্রে। দু’বছর পরে স্পষ্ট যে, সে আশা পূর্ণ হয়নি। আমদানির পরিমাণ অভূতপূর্ব ভাবে বেড়েছে। পিএলআই ব্যবস্থায় আদৌ কাজ হবে কি না, সেই সংশয় এখন এতই গুরুতর যে, সরকারকে বিকল্প নীতির কথা ভাবতেই হবে।

সেন্টার ফর ইকনমিক স্টাডিজ় অ্যান্ড প্ল্যানিং, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement