সঙ্গী: অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী পদে চন্দ্রবাবু নায়ডুর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ১২ জুন, বিজয়ওয়াড়া। পিটিআই।
সবাই যা ভেবেছিলেন, ততখানি মারকাটারি ফল না হলেও ভারতীয় জনতা পার্টির নেতৃত্বাধীন সরকার আবার ক্ষমতায় ফিরে এল। কিন্তু, দল সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল না। এই ফল অনেককেই অবাক করেছে। বিরোধীরাও হয়তো আশা করেননি যে, এই নির্বাচনে তাঁরা এতখানি ‘ভাল’ ফল করবেন। একটা রসিকতা বাজারে চলছে যে, এই নির্বাচনের ফল সবাইকেই খুশি করেছে— বিজেপি সরকার গড়তে পেরে খুশি; চন্দ্রবাবু নায়ডু ও নীতীশ কুমারের মতো শরিকরা সরকারের উপর চাপ বজায় রাখতে পারার ক্ষমতা অর্জন করেছেন বলে খুশি; কংগ্রেস খুশি প্রায়-নিশ্চিত বিলুপ্তির মুখ থেকে প্রবল ভাবে ফিরে আসতে পেরে; তৃণমূল কংগ্রেসের মতো আঞ্চলিক দল খুশি নিজেদের রাজ্যে বা অঞ্চলে দাপট বজায় রাখতে পেরে; আর, ভোটের ফল বেরোনোর পরে কেউ আর ইভিএম-এর দিকে আঙুল তুলছে না বলে নির্বাচন কমিশনও খুশি। সিপিএম-ও নাকি খুশি: এ বারও পশ্চিমবঙ্গে আসনসংখ্যা শূন্য মানে দল ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পেরেছে। রসিকতাটা শুনে আমার মনে হল, এ যদি ‘অচ্ছে দিন’ না হয়, তা হলে সেই রূপকথার দিনটি ঠিক কী রকম? এক নির্বাচনের ফলে কম-বেশি সবাই খুশি, এমনটা শেষ কবে দেখা গিয়েছে?
রসিকতা ত্যাগ করলে অবশ্য বোঝা যায় যে, এই ফল নিয়ে বিজেপি ততখানি খুশি নয়— এবং, সেই উদ্বেগের প্রধানতম কারণ হল উত্তরপ্রদেশ। কথায় বলে, এই রাজ্য যে দিকে ঝোঁকে, ভারতীয় রাজনীতিও সে দিকেই ঝোঁকে। ৮০টি লোকসভা আসনবিশিষ্ট রাজ্যটিতে ফল খারাপ হল কেন, সে বিষয়ে দু’টি জল্পনা অতি তীব্র— এক, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দূরত্ব তৈরি হওয়া; এবং দুই, এই নির্বাচনে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের তরফে একটু দূরত্ব বজায় রাখা, বিজেপির হয়ে জনসংযোগে ততখানি সক্রিয় না হওয়া। এই দু’টি কারণ দিয়েই উত্তরপ্রদেশে বিজেপির অপেক্ষাকৃত খারাপ ফলের সিংহভাগ ব্যাখ্যা করা যায়।
সাধারণ মানুষের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে নির্বাচন জেতা যায় না— উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে তৃণমূল স্তরে এই জনসংযোগের ক্ষেত্রে আরএসএস কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, নির্বাচনের ফলাফলে তা স্পষ্ট। এই ভুল যত তাড়াতাড়ি সংখ্যাগরিষ্ঠ দল শুধরে নেয়, ততই তাদের পক্ষে মঙ্গল।
তৃতীয় একটি সম্ভাব্য কারণের কথাও বলা প্রয়োজন। বিগত দু’তিন বছর বর্তমান শাসক দল তাদের কেন্দ্রীয় পরিচালন সমিতিতে ভাল কর্মীদের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে কিছু তাঁবেদার-চাটুকারকে সামনে নিয়ে এসেছে। নিতিন গডকড়ীর মতো মন্ত্রীকে বর্তমান পরিচালন সমিতিতে সে রকম প্রাধান্য দেওয়া হয়নি। এই রকম অবস্থা চলতে থাকলে শাসক থেকে বিরোধী হতে বেশি সময় লাগবে না। তাই এই ধাক্কা হয়তো তাঁদের পক্ষে ভালই হবে— যদি এই ধাক্কা থেকে ভুলগুলি শুধরে নেওয়া যায়।
একটি পুরনো ঘটনা মনে পড়ছে। ২০০৪ সালে সবাই ভেবেছিলেন যে, কেন্দ্রে অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন সরকার আবার ফিরে আসছে। লোকসভা গণনার আগের দিন অন্ধ্রপ্রদেশের বিধানসভার গণনা হল, এবং তাতে চন্দ্রবাবু নায়ডুর ভরাডুবি। চন্দ্রবাবু ছিলেন তদানীন্তন এনডিএ-র আহ্বায়ক ও অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী, যিনি নিজেকে অন্ধ্রপ্রদেশের ‘সিইও’ বলা বেশি পছন্দ করতেন। অন্ধ্রপ্রদেশের গণনা চলাকালীনই বোঝা যাচ্ছিল যে, লোকসভায় কী হতে চলেছে এবং পরের দিন তা-ই হল— এনডিএ-র ভরাডুবি।
ঠিক কুড়ি বছর পর সেই চন্দ্রবাবুই বর্তমান সরকারকে ভরাডুবি থেকে বাঁচালেন। একটি বৃত্ত সম্পূর্ণ হল। বর্তমান শাসক দল নিশ্চয়ই চন্দ্রবাবুর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে।
বর্তমান সরকারের কী করা উচিত, আর কী উচিত নয়, তা নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। নির্বাচনপর্বের শেষ দিকে প্রধানমন্ত্রী মোদী ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, সরকার গঠন করার পর প্রথম একশো দিনে তিনি কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। আমার ধারণা যে, এর মধ্যে ‘এক দেশ এক নির্বাচন’ এবং ‘অভিন্ন দেওয়ানি বিধি’ নিয়ে অগ্রগতির ভাবনা হয়তো ছিল। কিন্তু এখন মোটামুটি নিশ্চিত যে, এই বিষয়গুলিতে আপাতত কোনও অগ্রগতি হবে না। তাই ওঁর প্রথম একশো দিনের কর্মসূচি আপাতত ঠান্ডা ঘরেই। সেটি হয়তো এই মুহূর্তে খুব খারাপ হবে না, কারণ এখন কর্তব্য হওয়া উচিত শুধুই অর্থনীতি নিয়ে ভাবা।
তারও আগের কর্তব্য হল ‘জোট ধর্ম’ পালন। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলতে হবে। বর্তমান ‘বন্ধু’দের একটি গুণ হল, তাঁরা অনেকেই আর্থিক সংস্কারের বিরোধী নন। তাই আপাতত অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই সরকারের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। পরিকাঠামো উন্নয়নে মন দেওয়া, আরও অর্থ বরাদ্দ করা, বর্তমানে চালু প্রকল্পগুলি শেষ করা এবং নতুন কিছু শুরু করার থাকলে সেগুলো শুরু করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বেশি এই মুহূর্তে ভাবার কিছু আছে বলে মনে হয় না। বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা, কর্মসংস্থানে নজর দেওয়া এবং রফতানি বাড়ানো এখন আবশ্যিক। আগামী দু’বছরের মধ্যে দেশ যাতে পাঁচ লক্ষ কোটি ডলারের আয়তনের অর্থব্যবস্থা হয়ে উঠতে পারে, সেই চেষ্টা করতে হবে। অন্য কোনও দিকে আপাতত নজর না দিলেও চলবে। কারণ এটি করতেই অন্তত দু’বছর লেগে যাবে।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন থেকে সরকারের কর আদায় বৃদ্ধি পায়, এবং সেই বর্ধিত রাজস্বের সাহায্যে সামাজিক প্রকল্পগুলি আরও ভাল ভাবে চালানো যায়। সামাজিক সমস্যা কমানোর একটি উপায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন— এই একটি ওষুধে এক সঙ্গে অনেক ব্যাধির উপশম হয়। এর সঙ্গে শিক্ষাক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়ানো, মানুষের ‘স্কিল’ বা কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির দিকে নজর দেওয়া উচিত। এর ফলে ভারতীয় শিল্পের ও দ্রব্যের গুণগত মান বৃদ্ধি পাবে, এবং বিশ্বের বাজারে ভারতীয় দ্রব্যের কদর ও রফতানি বাড়বে।
বলা হয়, ‘ব্যর্থতাই হল সাফল্যের সিঁড়ি’। যদি কেউ শিক্ষা নিতে চায়, তা হলে ব্যর্থতার থেকে ভাল শিক্ষক আর হয় না। বিজেপি নেতারা ভাগ্যবান যে, খাদের ধার থেকে ফিরে এসেছেন। আর যাতে খাদের ধারে যেতে না হয়, এ বার তাঁরা সেই ব্যবস্থা করুন— ঠিক লোকের উপরে ভরসা করুন, অর্থনীতিকে পাখির চোখ করুন আর মানুষের কাছে থাকুন। মানুষ আশীর্বাদ করবেন।