physically challenged

সদিচ্ছা নেই, সক্রিয়তাও নেই

দীর্ঘ আন্দোলনের পর প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তিদের জন্যে আইন চালু হয় ১৯৯৫ সালে, সংশোধিত আইন ২০১৫ সালে।

Advertisement

অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৩ এপ্রিল ২০২১ ০৪:৫১
Share:

গত শতকের শেষ দশকে আমেরিকার চিত্রাভিনেতা, ‘সুপারম্যান’ খ্যাত ক্রিস্টোফার রিভ অ্যাবাভ সাসপিশন ছবিতে এক প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তির চরিত্রে অভিনয় করার আগে, নিজেকে প্রস্তুত করতে এক প্রতিবন্ধী সংস্থায় নিয়মিত যেতেন। রোজ মনে মনে বলতেন, ‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আমি ওদের মতো নই।’ এই ছবির পরে এক দুর্ঘটনায় তিনি পঙ্গু হয়ে যান। বাকি জীবন কাটে হুইলচেয়ারে।

Advertisement

দুর্ঘটনায় সাময়িক বা স্থায়ী ভাবে প্রতিবন্ধী হয়ে যাওয়া— যে কোনও মানুষের ক্ষেত্রেই হতে পারে। সম্প্রতি এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী চলন্ত গাড়ির ফুটবোর্ডে দাঁড়িয়ে ভোটের প্রচারকালীন অসাবধানতাবশত আচমকা ধাক্কা লেগে গাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে গেলে পায়ে জোর আঘাত পান। তাঁর দৈনন্দিন যাপনে পরিবর্তন এসেছে, হুইলচেয়ারে চলাফেরা করতে বাধ্য হচ্ছেন। মঞ্চে হুইলচেয়ার ওঠানামার জন্যে র‌্যাম্প তৈরি করতে হচ্ছে, গাড়িতে ঢুকতে-বেরোতে বিশেষ ব্যবস্থা করতে হচ্ছে, বাড়িতেও তা-ই। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা মানুষকে অসহায় ও পরনির্ভর করে দেয়। আমাদের সমাজে স্থাপত্যনির্মাণ কাঠামোর পরিকল্পনা করা হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ সুস্থ লোকেদের কথা ভেবে। নানা অসুখে পড়েও ক্রমশ পঙ্গুত্বের দিকে এগিয়ে যান অনেকে। যুদ্ধ বা রাজনৈতিক হানাহানিতে, বোমা-গুলি-ধারালো অস্ত্রে প্রতিবন্ধী হয়ে যান বহু মানুষ। এই পঙ্গুত্ব নিয়ে কত অসুবিধেয় তাঁদের দিন কাটাতে হয় সেটা রাষ্ট্র বা তথাকথিত সুস্থ মানুষও ভাবেন না।

চিকিৎসা ছাড়াও বেশির ভাগ প্রতিবন্ধকতার জন্যে দরকার উপযুক্ত সহায়ক উপকরণ— চশমা, শ্রবণযন্ত্র, লাঠি, ক্রাচ, হুইলচেয়ার ইত্যাদি। এ ছাড়াও রয়েছে শারীরিক ও মানসিক থেরাপি। সবচেয়ে জরুরি পারিবারিক সহযোগিতা, সামাজিক সহমর্মিতা। সরকারি ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা এই বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জীবন সহজতর করতে পারে। ঠিক যেমন মুখ্যমন্ত্রীর চলার পথ সুগম করতে অস্থায়ী র‌্যাম্প বানানো হচ্ছে।

Advertisement

দীর্ঘ আন্দোলনের পর প্রতিবন্ধকতাযুক্ত ব্যক্তিদের জন্যে আইন চালু হয় ১৯৯৫ সালে, সংশোধিত আইন ২০১৫ সালে। প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষের বাধাহীন চলাফেরা আইনানুগ স্বীকৃত হলেও, গত পঁচিশ বছরে পরিকাঠামোগত উন্নতি হয়েছে সামান্য। এখনও সব জায়গায় সবার যাওয়ার মতো ব্যবস্থা নেই। সব সরকারি অফিস, ব্যাঙ্ক, ডাকঘর, পার্ক, খেলার মাঠ, বিনোদন পরিসরে সবার যাওয়া সুগম করা যায়নি। অনুষ্ঠান-বাড়িতে র‌্যাম্প বা লিফটের সুবিধে না থাকায় অনেকেই নিমন্ত্রণ রক্ষা বা পারিবারিক ও সামাজিক সম্মিলনের সুযোগবঞ্চিত হয়ে একা পড়ে থাকেন।

দুর্ঘটনার কারণ যা-ই হোক, মুখ্যমন্ত্রীর হুইলচেয়ার নিয়ে ঘোরাফেরায় নানা ব্যঙ্গ-রসিকতা শুধু অমানবিকই নয়, তা সুস্থ মানসিকতারও পরিচয় নয়। এই মানসিকতা শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, আমাদের সমাজ আজও ‘কানা’, ‘খোঁড়া’, ‘ল্যাংড়া’, ‘পাগল’ ইত্যাদি শব্দের প্রয়োগ নিয়ে এবং এই মানুষগুলিকে নিয়ে যে রঙ্গ-রসিকতা করে তা অশিক্ষার জ্বলন্ত উদাহরণ।

সরকারি মন্ত্রী থেকে আমলা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা হামেশাই বিদেশে কাজে যান, দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ করেন, কিন্তু প্রতিবন্ধ-বান্ধব ব্যবহারিক ও স্থাপত্য নিদর্শনগুলো দেখেন না। নেপালের রাস্তার ফুটপাতে হুইলচেয়ার চালানোর জন্যে র‌্যাম্প করা আছে, সিঙ্গাপুরে চলমান কেবল কারে প্ল্যাটফর্ম থেকে হুইলচেয়ার ওঠার ব্যবস্থা আছে। যে কোনও সভ্য দেশে রাস্তার ধারে হুইলচেয়ারে আসীন কোনও ব্যক্তি থাকলে সিগন্যাল সবুজ থাকলেও গাড়ি দাঁড়িয়ে যায়। ইউরোপে সব দেশে গ্রন্থাগার, সংগ্রহশালায় র‌্যাম্প ও লিফট আছে, ব্রিটিশ মিউজ়িয়ামে মেজেনাইন ফ্লোরে যাওয়ার জন্যে লিফট লাগানো রয়েছে সিঁড়ির হাতলের সঙ্গে, যা দেখে নবনীতা দেব সেন তাঁর কলকাতার বাড়িতেও সে ব্যবস্থা করেছিলেন। লন্ডনের কিছু ট্যাক্সিতে হুইলচেয়ার সুদ্ধু ঢুকে যাওয়া যায়, রয়েছে ‘ডিসেবিলিটি’ গাড়ির বিশেষ পার্কিং ব্যবস্থা। সুইৎজ়ারল্যান্ডে যন্ত্রচালিত হুইলচেয়ার নিয়ে রাস্তা থেকে প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে বিনা বাধায় ট্রেনে ওঠার সুব্যবস্থা চমকে দেয়। ‘সব কা সাথ সব কা বিকাশ’ ও সব দেশে অনেক আগে থেকেই চালু, আমাদের দেশে সক্রিয়তা দূরস্থান, সদিচ্ছারও অভাব।

আমাদের দেশে রেলগাড়ি আর প্ল্যাটফর্মের মধ্যে এত ফাঁক যে ওঠানামায় সুস্থ মানুষেরই অসুবিধে হয়। একই অবস্থা বাসের ক্ষেত্রেও। এ যেন সামাজিক মানসিকতার, বৈষম্যমূলক ব্যবহারেরই প্রতিফলন। অতিমারিতে যে ব্যবধান প্রকটতর।

তবু মানুষ আশায় বাঁচে। নির্বাচন শেষে ক্ষমতায় যে দলই আসুক, তথাকথিত সুস্থ ও প্রতিবন্ধকতাযুক্ত সব মানুষেরই ভাল ভাবে বাঁচার ব্যবস্থা হোক, এই আশা। বন্ধ হোক রাজনৈতিক হানাহানির জেরে মানুষের প্রতিবন্ধী হয়ে যাওয়া। সে দিক থেকে দেখলে আমাদের সুস্থতা ও প্রতিবন্ধকতার মধ্যে ব্যবধান শুধু একটা দুর্ঘটনা, অসুখ বা অতি ক্ষুদ্র এক ভাইরাসের। অতিমারি তা আরও বুঝিয়ে দিয়েছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement