উত্তাল ইউক্রেন। ফাইল চিত্র।
যুদ্ধের তাণ্ডবে উত্তাল ইউক্রেন। এখন শীতকেই রাশিয়া ‘অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করছে বলে শোনা যাচ্ছে। তার লক্ষ্য ইউক্রেনের শক্তি উৎপাদনের কেন্দ্রগুলো। তাই রাজধানী কিভ-সহ অনেক রাজ্যেই বিদ্যুৎ বিহীন নিকষ কালো অন্ধকার। প্রবল শৈত্যে মানুষ হিটার-বিহীন। এমনকি তাঁদের পানীয় জল থেকেও বঞ্চিত করতে দিনে চল্লিশটি মিসাইল ছুটছে।
এমতাবস্থায় ইউরোপ ভ্রমণ কোনও কাজের সিদ্ধান্ত নয় বলে জানিয়েছিলেন সুহৃদরা। তবু রওনা হলাম চেক প্রজাতন্ত্রের প্রাগ, অস্ট্রিয়া-র ভিয়েনা এবং হাঙ্গেরির বুদাপেস্টের উদ্দেশে। ইউক্রেনের পারমাণবিক কেন্দ্র জ়াপোরিজিয়া হাঙ্গেরির সীমান্তে। কিন্তু রাজধানী বুদাপেস্ট থেকে বেশ খানিকটা দূরে। হাঙ্গেরি খুব মেপে চলমান যুদ্ধ-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। রাশিয়ার দিকে বাধ্যতামূলক ঝুঁকে থাকে অর্থনৈতিক নির্ভরতার দরুন। জ়াপোরিজিয়ার গোলাগুলির আঁচ হাঙ্গেরীয় সীমান্ত পায় না। তবে স্থানীয় জনগণ সরবে জানালেন যে, এই যুদ্ধ তাঁরা সমর্থন করেন না, কারণ যুদ্ধ জিনিসটাই ভাল নয়।
কিন্তু চেক প্রজাতন্ত্রের প্রাগ শহরে পা দিয়েই অনুভব করলাম যুদ্ধের আঁচ। ট্যাক্সি খুঁজতে সাহায্য করতে যে মানুষটি প্রথম এগিয়ে আসেন, তিনি জানান যে, তিনি ইউক্রেনীয়। এখানে রয়েছেন ছাত্র হিসেবে। মা-বাবা ও বোন তিন দিনের জন্য কিভ থেকে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। “ফিরে যাবেন কিভে তিন দিন পর?” আমার আতঙ্কিত চোখের উত্তরে হাসিমুখে বলেন, ঘর-বাড়ি, দিদা-ঠাকুরমা, সব সেখানে থাকায় কিভ ছাড়ার প্রশ্নই ওঠে না। এও জানালেন যে, ‘সোলার আলো’ দিয়ে কাজ চালানোর চেষ্টা করছেন তাঁর বাড়ির লোকজন।
চার লক্ষ ইউক্রেনীয় শরণার্থী রয়েছেন প্রাগে। হোটেল, সরকারি আবাসন, এই সবের পর, মানুষ তাঁদের নিজেদের বাড়ির একটি ঘর খোলা রেখেছেন তাঁদের জন্য। চেক-রা রুশ কমিউনিস্ট শাসনের ভুক্তভোগী। নেটোর পৃষ্ঠপোষকতার শক্তপোক্ত জোর থাকায় নিষ্কম্প কণ্ঠে নাগরিকরা জানালেন, “উই হেট পুতিন, পুতিন জমানার নিষ্পত্তি ঘটুক।” প্রত্যুত্তরে প্রশ্ন করি, এক জমানার খতমে সমস্যার নিষ্পত্তি ঘটবে? চেক রমণী উত্তর দেন, “দশ বছর আগে কিন্তু এমন ছিলেন না পুতিন। কিন্তু এই অহং যুদ্ধে উনি হার মানতে নারাজ। তাই পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।”
আমার সহানুভূতি জ্ঞাপনের ফাঁকে তিনি জিজ্ঞাসা করতে ভুললেন না যে, “হাঙ্গেরি নাহয় ধন্দে হতচকিত, কিন্তু যুদ্ধের ব্যাপারে ভারত কেন মধ্যপন্থী?” ঐতিহাসিক দুর্যোগকালে ভারতের পাশে দাঁড়ানোর ঋণস্বীকার ও সুলভ মূল্যে অস্ত্র কেনার ব্যাপারে থাকার আনাড়ি কথার বৃত্তান্তে তিনি খুব একটা সাড়া দিলেন না। বরং জানালেন, বিমান, গাড়ি, অস্ত্র-উৎপাদন ইত্যাদি ভারী শিল্প-নির্ভর চেক অর্থনীতি খুব শক্তপোক্ত খুঁটির উপরে দাঁড়িয়ে থাকায়, এখানে কোনও বেকারত্ব নেই। এবং সেই কারণেই এমন উদার হাতে আলিঙ্গন করেছে ইউক্রেনের যুদ্ধ শরণার্থীদের। কিন্তু একটাই শর্ত— তাঁদের ‘চেক ভাষা’ শিখতে হবে। রাশিয়ান ভাষার ব্যবহার চলবে না।
এটা সত্যি যে, গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে যুদ্ধ শুরুকালীন পোল্যান্ড, চেক প্রজাতন্ত্র এবং স্লোভাকিয়ার দেশনেতা ত্রয় প্রথমে গিয়ে কিভে ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট জ়েলেনস্কি-কে সমর্থন জানিয়েছিলেন। পরবর্তী কালে অবশ্য বিশ্বের কেউকেটা দেশগুলো ইউক্রেনের সমর্থনে যোগ দেয়। চেক প্রজাতন্ত্র যুদ্ধ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করে দেয় রুশদের জন্য। রাজপথে জনসমক্ষে, প্রাগের বিখ্যাত চার্লস ব্রিজের কাছে ক্লেমেন্টিনাম কনসার্ট হল-এ বড় করে টাঙানো প্ল্যাকার্ডে লেখা ‘হ্যান্ডস অফ ইউক্রেন, পুতিন’। আর দেখলাম, যুদ্ধের কিল যথেষ্ট পড়েছে অর্থনীতির পিঠে।
প্রাগ বিমানবন্দরে ট্যাক্সিচালক ছিলেন খেরসন-এর বাসিন্দা। জানালেন, খেরসন জ্বলছে, যদিও তাঁর বাড়ি এখনও অক্ষত। ষাটোর্ধ্ব নাগরিকদের দেশত্যাগের ছাড় দিয়েছে ইউক্রেনের মার্শাল ল। খারকিভ, খেরসন, বাকমুট এবং ক্রিমিয়ায় চলছে রাশিয়ায় ইউক্রেনকে সাম্রাজ্যভুক্ত অর্থাৎ ‘অ্যানেক্স’ করার অনৈতিক গণভোট বা ‘রেফারেন্ডাম’। ইউক্রেন খারকিভ ও খেরসন পুনরুদ্ধার করার পরও অগণিত ক্ষেপণাস্ত্র তছনছ করছে সে অঞ্চল। ইউক্রেনের শিশুরা আতঙ্কিত ছিল যে সান্টার স্লেজ না পুড়িয়ে ফেলে ক্ষেপণাস্ত্র। প্রেসিডেন্ট জ়েলেনস্কি ক্রিসমাসে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিলেও, তা নাকচ করে দেয় রাশিয়া।
দশ মাসের যুদ্ধ যেন দিগন্তহীন দিশায় ছুটছে। ভবিষ্যৎ যেন সময়ের এক কৃষ্ণগহ্বরে আটক। ট্যাক্সি চালক বললেন, “দেশে ছিলাম অর্থনীতিবিদ, এখানে জীবনের ভরসা এই ট্যাক্সি।... চেক দেশটা সুন্দর, কিন্তু ইউক্রেন সেরা। হায় খেরসন…”, বলে মাথা নাড়ালেন প্রাগ শরণার্থী ইউক্রেন নাগরিক। একটু থেমেই বললেন যে “যুদ্ধ শেষেই আবার ফিরে যাব নিজের দেশে।” এর উত্তর যা হয়, তা-ই পিঠে হাত দিয়ে বললাম ওঁকে— স্লাভা উক্রাইন।