মনুষ্যত্বহীনতা ও নৈরাজ্যের ছবি, একের পর এক
Violence and Unrest

কুৎসিত বীভৎসা-’পরে...

নুহ-তে বিদ্বেষের আগুন জ্বলে ওঠে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের উদ্যোগে মন্দিরমুখী একটি ধর্মীয় শোভাযাত্রা আক্রান্ত হওয়ার পরে। এই ধরনের যে কোনও অপচেষ্টা কোনও দিন শুভবুদ্ধির সমর্থন পেতে পারে না।

Advertisement

দেবাশিস ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১০ অগস্ট ২০২৩ ০৪:৩৬
Share:

দহন: গুরুগ্রামে দুষ্কৃতীদের লাগানো আগুনে পুড়ে গিয়েছে দোকান ও অন্যান্য অস্থায়ী কাঠামো। ১ অগস্ট ২০২৩। ছবি: পিটিআই।

সমসময়ের তিনটি ছবি। খর নদীস্রোত থেকে ছিটকে বুকে এসে লাগা তিনটি পাথর যেন। হতে পারে, তাদের স্থান-কাল-পাত্র এবং পরিস্থিতির ব্যাপকতা সম্পূর্ণ আলাদা। হতে পারে, একের সঙ্গে অন্যের তিলমাত্র সংযোগ নেই। থাকার কথাও নয়। তবু যাঁদের ন্যূনতম মনুষ্যত্ব আছে, এর প্রতিটি আঘাত তাঁদের কাতর করবেই।

Advertisement

কলকাতা, গুরুগ্রাম ও মণিপুর— দেশের তিন প্রান্তের আপাতবিচ্ছিন্ন তিনটি ঘটনাকে এ ভাবেই এক সুতোয় গেঁথে নেওয়া যায়। কারণ এগুলির উৎসমুখে রয়েছে উচ্ছৃঙ্খলতা, নৈরাজ্য, প্রশাসনিক অকর্মণ্যতা বা সচেতন ভাবে মুখ ফিরিয়ে থাকা, মানুষের অসহায়তা এবং অবশ্যই রাজনীতির বিষ। তাই অভিঘাতের নিরিখে ঘটনাগুলি সমগোত্রীয় না হলেও এ ভাবে কোথাও তারা একাকার।

ঘরের কাছে কলকাতার দিকে আগে তাকানো যাক। সে দিন সকালের খবরের কাগজে ছাপা ছবিটি মনে করুন। লরিতে সদ্য পিষ্ট হয়ে যাওয়া বালক-পুত্রের স্কুলব্যাগ আঁকড়ে মায়ের আর্তনাদ। এ কান্না তাঁর একার নয়, সবার। কী ঘটেছিল বেহালায়? দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়া ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দিতে যাচ্ছিলেন বাবা। রাস্তা পেরোনোর সময় সিগন্যাল সবুজ হয়ে যায়, লরির ধাক্কায় শিশুটির মাথা বলে কিছু অবশিষ্ট ছিল না।

Advertisement

ঘটনার পরে জনরোষ, ভাঙচুর, আগুন, পুলিশকে আক্রমণ, লাঠি, কাঁদানে গ্যাস, নৈরাজ্যের আতঙ্ক, যা-যা হয়েছে, তার কোনওটিই অভিনব নয়। এমনকি শোকার্ত মায়ের কাছে মুখ্যমন্ত্রীর ফোন পর্যন্ত। এ সব ক্ষেত্রে এ রকমই তো হয়! কিন্তু এখানেই থামলে চলবে না। মূলে গিয়ে প্রশ্ন করতে হবে, ওই এলাকার পথ-নিরাপত্তা নিয়ে এখন যে ভাবে কর্তাদের তৎপরতা, দৌড়ঝাঁপ দেখা যাচ্ছে, এত দিন সেই বিবেচনাবোধ ছিল কোথায়? কারণ এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে সাধারণের সুরক্ষা এবং পুলিশ-প্রশাসন নামক এক শ্রেণির চেতনাহীন, অপরিণামদর্শী, কর্তব্যরহিত ভূমিকা।

খবরে জেনেছি, রাজ্যের মুখ্যসচিবকে তদন্ত করে রিপোর্ট দিতে বলেছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। পুলিশ কমিশনারকেও তিনি নির্দেশ দিয়েছেন ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণে ‘উপযুক্ত’ ব্যবস্থা করতে। এর চেয়ে নির্মম পরিহাস আর কী হতে পারে! সাতসকালে বেপরোয়া লরি একটি ফুটফুটে শিশুর প্রাণ কেড়ে নেওয়ার পরে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে ডেকে বলতে হচ্ছে, “ওহে পুলিশ, তোমরা এ বার ওঠো, জাগো, ব্যবস্থা করো!” ঘটনা ঘটার পরে বোধ হয় নগরকর্তারা এটাও প্রথম ‘জানতে’ পারলেন যে, ভোরের কলকাতায় ট্র্যাফিক পুলিশের দেখা মেলে না! এই তা হলে ‘গুড গভর্ন্যান্স’-এর নমুনা!

জানি, দুর্ঘটনা বলেকয়ে আসে না। কিন্তু বেহালায় সে সব যুক্তি অর্থহীন। কারণ ওখানে, বিশেষ করে স্কুলের সময়, ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে বিভিন্ন স্কুলের তরফে পুলিশকে আগে জানানো হয়েছিল। তা সত্ত্বেও কোনও ব্যবস্থা করা হয়নি। এই বালকের মৃত্যু তো সেই নিষ্ক্রিয়তারই পরিণাম। অভিযোগ উঠছে, সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে দেড় কিলোমিটারের মধ্যে সাত-আটটি স্কুল। শুরু এবং শেষের সময় শত শত ছেলেমেয়ের যাতায়াত। অথচ শুধুই কয়েকটি ‘দামি’ স্কুলের সামনে নাকি যান-নিয়ন্ত্রণের বন্দোবস্ত থাকে।

সত্যাসত্য পরের কথা। আগে জানতে চাইব, পুলিশ যদি আজ রাতারাতি পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে থাকে, কোথায় কী বন্দোবস্ত দরকার তা অনুধাবন করে ফেলে, তা হলে এত দিন নিশ্চয় তারা চোখ-কান বন্ধ রাখত? কেন? পুলিশ কি এই রকম কোনও দিনের অপেক্ষায় ছিল? এতেই বোঝা যায়, সাধারণ মানুষ কত অসহায়। আর ‘রক্ষক’রূপী রাজপুরুষেরা কত দূর হৃদয়হীন এবং অপদার্থ। যাঁরা এঁদের চালিকাশক্তি, ধিক্কার তাঁদেরও প্রাপ্য।

হরিয়ানা দেখাল আর এক নিদারুণ ছবি। যেখানে খেটে খেতে যাওয়া এক মহিলা প্রাণভয়ে কাঁপতে কাঁপতে হাতজোড় করে মিনতি করছেন, “আমরা কিচ্ছু চাই না। শুধু এখনই নিজেদের দেশ-গাঁয়ে ফিরে যেতে চাই।” ঘটনাচক্রে মহিলা বঙ্গভাষী। বাড়ি, ধরা যাক, এই রাজ্যে। না হলেও কিছু আসে-যায় না। কারণ এখানে সেটা অপ্রাসঙ্গিক। জরুরি তথ্য হল, তিনি মুসলিম। আর কর্মসূত্রে তাঁরা অনেকে রয়েছেন বিজেপি-শাসিত হরিয়ানার ওই অঞ্চলে।

শোনা গেছে, নুহ-তে বিদ্বেষের আগুন জ্বলে ওঠে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের উদ্যোগে মন্দিরমুখী একটি ধর্মীয় শোভাযাত্রা আক্রান্ত হওয়ার পরে। এই ধরনের যে কোনও অপচেষ্টা কোনও দিন শুভবুদ্ধির সমর্থন পেতে পারে না। যারা এ সব হামলার প্রযোজক, তারা নিঃসন্দেহে শান্তি-সম্প্রীতির শত্রু। মনুষ্যত্বের লজ্জা। তাদের দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা অবশ্যকর্তব্য। তবে সবচেয়ে আগে করণীয় শান্তি ফেরানো।

কিন্তু বাস্তবে কী হল? পরবর্তী দিনগুলিতে কার্যত একতরফা ভাবে যা ঘটে চলেছে,
তাতে আতঙ্ক আরও বাড়ছে। ঘটনার রাত থেকে দিল্লির গায়ে লেগে থাকা ঝাঁ-চকচকে গুরুগ্রামের নিম্নবিত্ত মুসলিম মহল্লাগুলিতে খাণ্ডবদাহন চলছে। বজরং দল বলে পরিচয় দেওয়া সশস্ত্র বাইকবাহিনী এলাকায় ঢুকে বাসিন্দাদের অবিলম্বে আস্তানা ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য প্রাণনাশী হুমকি দিচ্ছে। তাদের ‘নিরস্ত’ করার সক্রিয় উদ্যোগ রাজ্য বা কেন্দ্রের শাসকের আছে বলে মনে হচ্ছে না। উল্টে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, সকলকে নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব নয়!

ফলে সংশ্নিষ্ট শাসক ও আইনরক্ষকদের ‘সদিচ্ছা’ গুরুতর প্রশ্নের মুখে। তার মধ্যেই সরকারের নির্দেশে ‘জবরদখল’ উচ্ছেদের নামে শুরু হয়েছিল সংখ্যালঘু এলাকাগুলিতে নির্বিচার বুলডোজ়ার-অভিযান। জানি না, এগুলি অন্য রকম কোনও চিত্রনাট্যের অঙ্গ কি না। আদালত অবশ্য আপাতত অভিযান বন্ধ করেছে। তবে এ সব দেখে-শুনে ২০০২-এর গুজরাত দাঙ্গার ভয় জেগে ওঠা স্বাভাবিক। না, সেই ভয়াবহতার সঙ্গে এখনই আজকের হরিয়ানার তুলনা টানা উচিত নয়। তবে গুরুগ্রামের মহিলার ভয়ার্ত মুখের ছবিটি কোথাও যেন গুজরাতে ‘প্রাণভিক্ষা’ চাওয়া যুবক কুতবুদ্দিনের কান্নার মুখ মনে পড়িয়ে দেয়। সেই মুখের ছবি, যা গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে জনমত জাগ্রত করার প্রতীক হিসাবে।

গুজরাতেও দাঙ্গার সূত্রপাত হয়েছিল অযোধ্যা-ফেরত পুণ্যার্থীদের ট্রেনে আগুন ধরানো থেকে। তার প্রকৃত দায় কার, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও আসল কথা হল, ওই নৃশংসতা কয়েকশো গুণ ছাপিয়ে যায় পরবর্তী ধাপের ‘পাল্টা’ নিধনপর্বে। সরকারি পরিসংখ্যানেই তাতে নিহত ৭৯০ জন মুসলিম এবং ২৫৪ জন হিন্দু। গৃহহীন হয়েছিলেন আরও লাখ দেড়েক মুসলিম।

গুজরাতে সে দিনের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে তাঁরই দলের প্রধান নেতা ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী ‘সতর্ক’ করে বলেছিলেন, “রাজধর্ম পালন করতে হয়।” কালচক্রে সেই মোদীই আজ দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং হরিয়ানা নিয়ে এখনও নীরব। অটলবিহারী এখন কেবলই ছবি!

বিজেপির হাতে থাকা মণিপুরে কুকি জনজাতির দুই মহিলাকে বিবস্ত্র করে রাস্তায় হাঁটানো ও জঘন্য নিগ্রহের মর্মান্তিক ছবিটি কিছু দিন আগের হলেও তার ধাক্কা কাটিয়ে ওঠা যায়নি। ওই রকম একটি ঘটনা পুলিশ-প্রশাসনের ‘গোচরে’ আসতে দু’সপ্তাহ লেগেছিল কেন, নিয়মরক্ষার মতো মুখ খুলতেও মোদীই বা কেন আরও দু’মাস পার করে দিলেন, সে সবও বলা কঠিন।

যেমন বোঝা কঠিন, তিন মাস ধরে ভয়ঙ্কর জাতি-দাঙ্গায় পুড়তে থাকা এই ছোট্ট রাজ্যটিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে অপারগ একটি সরকার জাঁকিয়ে বসে থাকতে পারছে কী করে? অ-বিজেপি কোনও দল সেখানে ক্ষমতায় থাকলে মোদী-অমিত শাহ কী ভাবে ‘রাজধর্ম’-এর সবক শেখাতেন, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। বস্তুত আজ মণিপুর এ ভাবেই সারা দেশের সামনে মনুষ্যত্বহীনতা, নৈরাজ্য, অপশাসনের লালনক্ষেত্র এবং কুৎসিত রাজনীতির সবচেয়ে বড় উদাহরণ।

স্বাধীনতার ‘অমৃতকাল’ উদ্‌যাপনের দিন সমাগত। ক্ষমতাধরেরা যথারীতি সর্বত্র শান্তি-সম্প্রীতি-মানবাধিকার-সুশাসন ইত্যাদির জয়গান শোনাবেন। কিন্তু এই সব ‘ছবি’ কি তাতে বদলাবে?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement