Elections In India

চাই বিকল্প ব্যবস্থার খোঁজ

এ দেশের গণতন্ত্রকে সুস্থ করা কি অসম্ভব? যে কোনও নির্বাচনে প্রত্যেক নাগরিক যাতে শান্তিপূর্ণ ভাবে স্বাধীন মত প্রকাশের সুযোগ পান, তা নিশ্চিত করতে পারলে পরিস্থিতি বদলাতে পারে।

Advertisement

তূর্য বাইন

শেষ আপডেট: ১০ অগস্ট ২০২৩ ০৪:৫২
Share:

—প্রতীকী ছবি।

ভারতে প্রতি পাঁচ বছরে যে তিনটি প্রধানতম নির্বাচন ঘিরে সবচেয়ে বেশি উচ্ছ্বাস ও তৎপরতা, ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচন তার অন্যতম। ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ এবং স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পঞ্চায়েতের গুরুত্ব অপরিসীম। গ্রামীণ এলাকার উন্নয়ন ও সরকারি কল্যাণমূলক প্রকল্পের সুবিধা যাতে পক্ষপাতশূন্য ভাবে মানুষের কাছে পৌঁছয়, তা নিশ্চিত করতে পঞ্চায়েত এলাকায় জনসাধারণ নিজেদের প্রতিনিধি বেছে নেওয়ার সুযোগ পান এই নির্বাচনের মাধ্যমে। কিন্তু সমস্যা হল, এ দেশে গণতন্ত্রের যত বয়স বাড়ছে, ততই নির্বাচনপর্ব ঘিরে অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে চলেছে, প্রায় প্রতিটি নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। মনোনয়ন পর্ব থেকে শুরু করে নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে হিংসা, পেশিশক্তির আস্ফালন ও অনৈতিক আর্থিক লেনদেনের কারণে স্বাধীন জনমত প্রকাশের সুযোগ ক্রমশ সঙ্কুচিত। সবচেয়ে পরিতাপের বিষয়, গত দু’দশকে বিভিন্ন রাজ্যে নির্বাচন-কেন্দ্রিক অনিয়ম, হত্যা, সন্ত্রাসের তুল্যমূল্য বিচার করে কোনও তালিকা তৈরি হলে প্রথম স্থানের অন্যতম দাবিদার পশ্চিমবঙ্গই হবে, এমন আশঙ্কা অনেকেরই।

Advertisement

২০২৩-এর পঞ্চায়েত ভোটের পক্ষকাল পরেও রাজ্যে কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপস্থিতি ও তার প্রয়োজনীয়তা প্রশাসনিক ভাবে স্বীকারের মধ্য দিয়ে এই নির্বাচনে হিংসার অভিযোগই কি মান্যতা পেল না? তার্কিকদের অভিমত ভিন্ন হতে পারে, তাঁরা হিংসা মাপেন মৃতের সংখ্যা দিয়ে, অতীত থেকে তুলে আনা পরিসংখ্যানের নিরিখে। কিন্তু হিংসা মানে শুধু মৃত্যু নয়; খুন, ধর্ষণ, হুমকিতে জীবন দুর্বিষহ করে তোলা, ঘরবাড়ি-দোকানপাট ধ্বংস, ফসল লুট-সহ নানা সন্ত্রাসে মানুষকে তটস্থ করে রাখার পরম্পরা কম যন্ত্রণার নয়। জয়ের নেশায় উন্মত্ত রাজনীতিকদের কাছে কেবল মৃত্যুর সংখ্যাই যদি হিংসার সূচক হয়, তবে প্রতিটি নির্বাচনে বলি হওয়া মানুষগুলির স্বজনের অপূরণীয় ক্ষতি ও শোক তাঁরা মাপবেন কোন এককে?

পশ্চিমবঙ্গে গত কয়েকটি পঞ্চায়েত নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলির ঘটানো হিংসার পাশাপাশি মনোনয়নে বাধা, বুথ দখল, ছাপ্পা, গণনায় কারচুপি-সহ পুরনো যত রোগ ছিল, সেগুলির সঙ্গে সদ্যসমাপ্ত পঞ্চায়েত নির্বাচনে স্ট্রং রুমে ব্যালট বাক্স বদল, বৈধ মনোনয়নপত্র বিকৃত করা-সহ বেশ কিছু নতুন অভিযোগে বিরোধীরা সরব হয়েছেন। এই সব দুষ্কর্মে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি আধিকারিক ও কর্মীদের প্রত্যক্ষ যোগের ইঙ্গিত আরও উদ্বেগের। সম্প্রতি কলকাতা হাই কোর্টের রায়ে হাওড়ার উলুবেড়িয়া-১’এর বিডিও তথা পঞ্চায়েত রিটার্নিং অফিসার এবং উলুবেড়িয়ার অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ আধিকারিক-সহ মহকুমা শাসককে এক মহিলা প্রার্থীর বৈধ মনোনয়নপত্র বিকৃত করে বাতিল করা এবং ওই একই আসনের অপর মহিলা প্রার্থীকে অবৈধ ওবিসি সার্টিফিকেট প্রদান করে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হতে সাহায্য করার অভিযোগে নিলম্বিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। অনেকের চোখেই এগুলি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কিন্তু মূল আশঙ্কার জায়গা হল, এই নির্বাচনে রক্ষকের ভক্ষক ভূমিকা ঘিরে আদালতে আরও অনেকগুলি মামলা বিচারাধীন বলে শোনা যাচ্ছে।

Advertisement

এ দেশের গণতন্ত্রকে সুস্থ করা কি অসম্ভব? যে কোনও নির্বাচনে প্রত্যেক নাগরিক যাতে শান্তিপূর্ণ ভাবে স্বাধীন মত প্রকাশের সুযোগ পান, তা নিশ্চিত করতে পারলে পরিস্থিতি বদলাতে পারে। নেতাদের জনমোহিনী প্রতিশ্রুতি, সিসি ক্যামেরার নজরদারি, কেন্দ্রীয় বাহিনীর প্রহরাও যে অসার, তা ইতিমধ্যে প্রমাণিত। সুতরাং কোটি কোটি টাকা খরচ করে বুথে বুথে নির্বাচনকর্মী পাঠিয়ে ব্যালট পেপার বা ইভিএম-এর মাধ্যমে নির্বাচন ব্যবস্থা পরিহার করে বিকল্প পথের সন্ধানই শ্রেয়। অনলাইন ভোটিং-এর কথা ভাবা যেতে পারে। বিনামূল্যে রেশন, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা, লক্ষ্মীর ভান্ডার-সহ কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের নানা জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের দৌলতে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও মানুষের হাতে মোবাইল ফোন পৌঁছে গেছে। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া হয় যে এমন বহু ভোটার আছেন যাঁদের মোবাইল ফোন নেই, সে ক্ষেত্রে তাঁদের জন্যে কোনও ‘ভোটিং ডিভাইস’ দেওয়া যেতে পারে। অন্যথায় থানা বা ডাকঘরে গিয়ে তাঁরা যাতে অনলাইনে ভোট দিতে পারেন, সেই ব্যবস্থাও করা যেতে পারে।

এতে এক দিকে বর্তমান নির্বাচন ব্যবস্থার বিপুল অর্থব্যয় কমবে, অন্য দিকে দশ বা পনেরো দিন ব্যাপী চলা নির্বাচনপর্বে প্রত্যেক নির্বাচককে ওটিপি পাঠিয়ে ভোটদানের সুযোগ করে দিতে পারলে ভোট-কেন্দ্রিক হানাহানি অনেকটাই হ্রাস পাবে। যথার্থ জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে আর একটি সংস্কারের কথা ভাবা যেতে পারে। বর্তমান নির্বাচন ব্যবস্থায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিজয়ী মোট প্রদত্ত ভোটের অর্ধেকেরও কম ভোট পেয়েছেন, অর্থাৎ অর্ধেকের বেশি ভোটদাতার প্রত্যাখ্যান সত্ত্বেও তিনিই বিজয়ী। এই ত্রুটি সংশোধনে ‘প্রেফারেনশিয়াল ভোটিং’ চালু করা যেতে পারে: ভোটদাতারা ব্যালটে প্রার্থীদের নামের পাশে সংখ্যা দিয়ে প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় পছন্দ জানাবেন। প্রথম পছন্দে কেউ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে প্রথম ও দ্বিতীয় পছন্দের যোগফল, তাতেও না হলে ক্রমান্বয়ে পরবর্তী পছন্দগুলো যোগ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ নির্বাচকের পছন্দের প্রার্থীকে জয়ী হিসাবে পাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। খোলাখুলি আলোচনায় হয়তো আরও বিকল্পের খোঁজ মিলবে, সবার আগে চাই রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সার্বিক ঐকমত্য।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement