Joshimath Disaster

বেপরোয়া সিদ্ধান্তের ফল

চামোলি জেলা সমেত সমগ্র উত্তরাখণ্ড উক্ত দুটো প্রধান পূর্ব-পশ্চিম ফাটলের মধ্যে অবস্থিত এবং একাধিক উত্তর-দক্ষিণ ফাটল এলাকাকে অশক্ত করে রেখেছে।

Advertisement

অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০২৩ ০৫:০৬
Share:

জোশীমঠ এলাকার প্রায় ৪০০০ পরিবার আজ অসহায়। সমগ্র এলাকা যেন বালির স্তূপের উপর অবস্থান করছে। ফাইল ছবি।

বিজ্ঞান এবং বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান তথ্যকে অমান্য করে সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসন যত বার উন্নয়নের নামে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সাফল্য আসেনি। বরং তা শেষ পর্যন্ত বিপর্যয় ডেকে আনে, শত শত মানুষের মৃত্যু হয় এবং ততোধিক মানুষ গৃহহীন হয়ে অসহায় জীবনের সামনে এসে দাঁড়ান। জোশীমঠের সাম্প্রতিক ভাঙন সেই বেপরোয়া সিদ্ধান্তের সাক্ষী। উত্তরাখণ্ডের চামোলি জেলার এই বিপর্যয় অনিবার্য ছিল, তা বেশ কয়েক বছর আগেই জানতে পারা গিয়েছিল, সতর্ক করাও হয়েছিল। সেই পর্যবেক্ষণ রিপোর্ট অগ্রাহ্য করে সরকার। জোশীমঠ এলাকার প্রায় ৪০০০ পরিবার আজ অসহায়। সমগ্র এলাকা যেন বালির স্তূপের উপর অবস্থান করছে।

Advertisement

একদা টেথিস সমুদ্রের নীচে জমা পলি থেকে ভূ-তাত্ত্বিক ও ভূ-গাঠনিক প্রক্রিয়ায় গড়ে ওঠা হিমালয়ের চেহারা দেখে যতই শক্তিশালী মনে হোক, আসলে তা নয়। পাললিক শিলার ভিতরে বারে বারে ফুঁসে উঠেছে আগ্নেয়গিরি, জমা হয়েছে আগ্নেয়শিলা, রূপান্তরিত হয়েছে এই সব শিলা অত্যধিক তাপে ও চাপে। ঘন ঘন ভূকম্পনে কেঁপে উঠেছে, ফাটল ধরিয়েছে পূর্ব-পশ্চিম বরাবর একাধিক অক্ষরেখায়, যার মধ্যে ‘মেন সেন্ট্রাল থ্রাস্ট’ আর ‘মেন বাউন্ডারি ফল্ট’ দুটো প্রধান। এ ছাড়াও উত্তর-দক্ষিণ বরাবর অসংখ্য ফাটল। ভূমিকম্প যত হয়, পাথরের মধ্যে ফাটল ততই ভয়ানক হয়ে ওঠে। আবার হিমালয়ের উচ্চতা বেশি হওয়ায় পাহাড়ের মাথায় হিমবাহ জমে, গরমে তা গড়িয়ে পড়ে পাহাড়ের গা বেয়ে, কখনও গলে জলের ধারা নামিয়ে নিম্নদেশে নদী হয়ে বয়ে যায় সাগরে। এই সব নদী তীব্র গতিতে নামার সময় পাথর ভাঙতে ভাঙতে যায়। কখনও আচমকা বন্যা হয়, আবার কখনও জল পাথরের ফাটলে ঢুকে লুকিয়ে থাকে, শীতে বরফ হয়ে যায়। গরমে সেই বরফ যখন গলে, তখন নতুন করে ফাটল ধরে।

চামোলি জেলা সমেত সমগ্র উত্তরাখণ্ড উক্ত দুটো প্রধান পূর্ব-পশ্চিম ফাটলের মধ্যে অবস্থিত এবং একাধিক উত্তর-দক্ষিণ ফাটল এলাকাকে অশক্ত করে রেখেছে। ফলে এই জায়গা এক দিকে যেমন অতিরিক্ত ভূকম্পনপ্রবণ, আবার ধসের প্রবণতাও অধিক। ভূকম্পনের জেরে উত্তরাখণ্ডে উঁচু পাহাড়ের মাথায় হিমবাহের হঠাৎ সচলতা, তার থেকে নিষ্কাশিত জলের প্রবল বেগ এবং তার ধাক্কায় বিশাল ধস নামে এই জায়গায়, যেখানে জোশীমঠ গড়ে উঠেছে। সহজেই অনুমেয়, জোশীমঠের মতো জায়গা মোটেই স্থিতিশীল, নিরাপদ নয়। অথচ, সেখানেই তৈরি হচ্ছে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, পাহাড় কেটে চওড়া রাস্তা। ভঙ্গুর মাটিতে পাইলিং করে বাড়ি, হোটেল। কত অনুনয়, দরখাস্ত সরকার, সরকারি সংস্থার কাছে। কেউ কথা শোনেনি। সাম্প্রতিক কালে চারধাম ধর্মীয় পর্যটন গড়তে সরকারি অনুমোদনে উন্নয়নের জোয়ার লাগামছাড়া।

Advertisement

এই অঞ্চলে জনবসতি ও তীর্থযাত্রীদের বিশ্রামস্থল ক্রমাগত বেড়ে চলায় সরকার গঠিত মিশ্র কমিটির ১৯৭৬ সালের রিপোর্টে ভাঙনের পূর্বাভাস দেওয়া হয়। সেখানে আগের রিপোর্ট উল্লেখ করে বলা হয়েছে, জোশীমঠ শক্ত পাথরের জমিতে নয়, কোনও এক বড় ধসের ফলে জমে থাকা বালিমিশ্রিত পাথরের আলগা জমিতে গড়ে উঠেছে। আরও বলা হয়েছে, অলকানন্দা আর ধৌলিগঙ্গার চোরাস্রোত যে কোনও সময় ধসের কারণ হতে পারে।

উনিশ শতকে ব্রিটিশ সরকার ভারতে রাস্তা এবং রেলপথ নির্মাণে মনোযোগ দেয় এবং হিমালয়েও রাস্তা তৈরির পরিকল্পনা করে। তারা সদ্যপ্রতিষ্ঠিত জিয়োলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া-কে দায়িত্ব দেয় রাস্তা ও রেলপথ তৈরির উপযুক্ত জায়গা নির্ধারণের জন্যে। প্রাথমিক পর্যায়ে সাফল্য আসায় তারা নির্দেশ জারি করে, যে কোনও পথ, সমতল অথবা পাহাড়ে নির্মাণের আগে জিএসআই-এর বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া বাধ্যতামূলক। পরবর্তী কালে জিএসআই-এর কাজের পরিধি বিস্তৃত হলে ভারী স্থাপত্য, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, বাঁধ, সেতু ইত্যাদি ক্ষেত্রেও প্রতিষ্ঠানের ছাড়পত্র আবশ্যক হয়। এই সহস্রাব্দের গোড়ায় ভূ-বিপর্যয় মোকাবিলার প্রধান দায়িত্বও অর্পণ করা হয়। কিন্তু তত দিনে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ শুরু হয়ে গেছে। মানুষের সুরক্ষার তোয়াক্কা না করে, ভূ-তাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ অস্বীকার করে, পরিবেশ আইন না মেনে সরকার নিজে অথবা তার অনুমোদনে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ভঙ্গুর এলাকায়, সমুদ্রের তীরে, নদীর মোহনায় পরিবেশের সমূহ ক্ষতি করে নির্মাণ কাজ করে চলেছে। সমুদ্র এবং নদী থেকে যথেচ্ছ বালি তোলা, পাহাড় কেটে পাথর ভাঙা, কৃত্রিম উপায়ে নদীপথ ঘুরিয়ে দেওয়া ইত্যাদি অনিয়ম হয়ে চলেছে, আর বিপদের মুখে পড়ছেন সাধারণ মানুষ আর তাঁদের জমিবাড়ি।

অবৈজ্ঞানিক উপায়ে হিমালয়ে স্থাপত্য নির্মাণ করলে কী হয়, জোশীমঠের আগে একাধিক দুর্ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। এই সব বেআইনি নির্মাণের সঙ্গে যারা যুক্ত, তারা কেন অভিযুক্ত হবে না— এই প্রশ্ন তোলার সময় এসেছে। বেআইনি কাজের জন্য এক বিশাল সংখ্যক মানুষ নানা দিকে বিপর্যয়ের মুখোমুখি। কোনও সরকার এই মনুষ্যকৃত বিপর্যয়ের দায়িত্ব এড়াতে পারে না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement