পরবাসী: তিপ্রা মহিলা পার্টি এনডিএ প্রার্থী দেবী সিংহ দেব-এর সমর্থনে স্লোগান দিতে রাস্তায়, আগরতলা, ২৮ মার্চ। পিটিআই।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের এক ছোট রাজ্য ত্রিপুরা। ১৯৪৭ সালের আগে এই দেশীয় রাজ্য ছিল মাণিক্য মহারাজাদের অধীনে, ১৯৪৯ সালে যা ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে পৌঁছে এ সব রাজারাজড়ার তথ্য তুলে ধরার কারণ কী? উত্তর হল, এ বারের লোকসভা ভোট-যজ্ঞে, ত্রিপুরার দুটো আসনে, এই রাজারাই আকর্ষণের মূল।
গত ২ মার্চ, ২০২৪-এ ত্রিপুরার আদিবাসী/জনজাতি সম্প্রদায়গুলির পক্ষ থেকে প্রদ্যোত কিশোর মাণিক্য দেববর্মার নেতৃত্বাধীন দল ‘দি ইন্ডিজেনাস প্রোগ্রেসিভ রিজিয়োনাল অ্যালায়েন্স’ বা তিপ্রা মথা, সঙ্গে ত্রিপুরার তথাকথিত ‘ডাবল ইঞ্জিন’ বিজেপি সরকারের সঙ্গে এক ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। বাংলাদেশ থেকে ত্রিপুরায় অবৈধ অভিবাসন, আদিবাসীদের বঞ্চনা, অ-আদিবাসীরা বিপুল সংখ্যায় বসতি স্থাপনে আদিবাসীরা তাঁদের নিজভূমিতে সংখ্যালঘু হয়ে ওঠা, রাজ্যের জনসংখ্যাগত পরিবর্তন ইত্যাদি বিষয়গুলোকে উল্লেখ করে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেন, “এই চুক্তির মাধ্যমে আমরা ইতিহাসকে সম্মান করেছি, ভুল সংশোধন করেছি ও আজকের বাস্তবতাকে মেনে নিয়েছি।” চুক্তি স্বাক্ষরের পরে, প্রদ্যোত দেববর্মা আদিবাসীদের শৃঙ্খলাবদ্ধ থেকে, তাঁদের মধ্যে ‘থানসা’ বা ঐক্য বজায় রাখার ডাক দিয়েছেন।
কিন্তু, এই ঘটনার সঙ্গে গত ১৯ এপ্রিল হয়ে যাওয়া ত্রিপুরা পশ্চিম কেন্দ্রে লোকসভা নির্বাচন এবং আগামী ২৬ এপ্রিল ত্রিপুরা পূর্ব আসনে ভোটের কি কোনও সম্পর্ক আছে? কেনই বা, হাতাই কোটর বা বড়মুড়া পাহাড়ে প্রদ্যোত দেববর্মা আমরণ অনশনের ডাক দিলে, তড়িঘড়ি তাঁকে দিল্লিতে ডেকে, চুক্তি স্বাক্ষর করা হল? ২০২৩ সালের ৪ মার্চ বিজেপি-নেতৃত্বাধীন জোট দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব নেওয়ার পর, মন্ত্রিসভার ৩টি খালি মন্ত্রী-পদে তিপ্রা মথার দু’জন মন্ত্রীর শপথ এবং ত্রিপুরায় লোকসভা নির্বাচনের জন্য বিজেপি, তার জোট দল ইন্ডিজেনাস পিপলস ফ্রন্ট অব ত্রিপুরা (আইপিএফটি) এবং তিপ্রা মথার নেতাদের নিয়ে তিন সদস্যের সমন্বয় কমিটি গঠন করা হল, এত কম সময়ে?
লক্ষণীয়, গত বছর বিধানসভা ভোটের আগে প্রদ্যোত দেববর্মা ‘বৃহত্তর তিপ্রাল্যান্ড’ তৈরির জন্য ‘লিখিত আশ্বাস’ চান— অথচ বাস্তবে এখন, এই নতুন ত্রিপক্ষীয় চুক্তি কিন্তু তাঁর দলকে আন্দোলন থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। ত্রিপক্ষীয় চুক্তির একটা ধারা অনুযায়ী, স্টেকহোল্ডাররা তাঁদের সমস্যার ‘সম্মানজনক সমাধান’ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন-বিক্ষোভ করা থেকে বিরত থাকবেন। ‘বৃহত্তর তিপ্রাল্যান্ড’ তৈরির দাবিতে রাস্তায় নামা যাবে না।
ত্রিপুরার ইতিহাসে আদিবাসী রাজনীতি সব সময় গুরুত্বপূর্ণ। ত্রিপুরায় সরকার তৈরির ক্ষেত্রে, রাজনৈতিক দলগুলোর আদিবাসীদের সমর্থন একান্ত প্রয়োজনীয়। বামপন্থীরা এক সময় আদিবাসী ভোটের সহায়তায় ক্ষমতায় এসেছিলেন। তিপ্রা মথা প্রতিষ্ঠার পর থেকে, বিশেষ করে ২০২৩ সালে ত্রিপুরার বিধানসভা ভোটের আগে, প্রদ্যোত দেববর্মা আদিবাসীদের সামগ্রিক সমস্যার ‘সাংবিধানিক’ সমাধানের জন্য তিপ্রাল্যান্ড তৈরির দাবি জানান। ২০২১ সালে তিপ্রা মথার উল্লেখযোগ্য জয়, ২০২৩ সালের শেষ বিধানসভা ভোটে ১৩টি আসনে জিতে প্রধান বিরোধী দল হয়ে ওঠা— এ সব থেকেই ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের আগে এই চুক্তি।
তিপ্রা মথা-ই প্রথম দল নয়, যারা তিপ্রাল্যান্ড তৈরির দাবি জানিয়েছে। চিত্তরঞ্জন দেববর্মার তিপ্রাল্যান্ড স্টেট পার্টি ২০১৫ সালে প্রথম আদিবাসীদের জন্য রাজ্য তৈরির কথা বলে। ‘ইন্ডিজেনাস পিপলস ফ্রন্ট অব ত্রিপুরা’ (আইপিএফটি)-ও তিপ্রাসা (ত্রিপুরার আদিবাসীদের নিজস্ব রাজ্য) তৈরির লক্ষ্যে ২০১৮ সালে আন্দোলন করেছিল। উল্লেখ্য, আইপিএফটি-এর দাবিগুলির একাংশও পূরণ না হলেও তারা বিজেপির সরকারে যোগদান করে। ২০২৩ সালের বিধাসভার নির্বাচনের আগে বিজেপির ইন্টারনাল সার্ভেতে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, ত্রিপুরার অ-বাঙালি বা ট্রাইবাল অধ্যুষিত এলাকায় তিপ্রা মথা-র গগনচুম্বী জনপ্রিয়তার মাঝে বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জিততে পারবে না। তাই তিপ্রা মথার প্রার্থীদের দাঁড় করিয়ে, আদিবাসী ভোটকে একত্রিত করা হয়, যাতে বাম-কংগ্রেস জোটের দিকে এরা না যায়— এবং তিপ্রা মথার সঙ্গে বিজেপির বোঝাপড়া শুরু হয়। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সেই পরিচিত ভোট-কৌশল।
অবশ্য, বর্তমানে বিজেপি ও মথার নেতৃত্বের মধ্যে জোট উচ্চ স্তরে থাকলেও, নিচু স্তরে কর্মী ও সমর্থকদের বোঝাপড়া আদৌ তৈরি হয়েছে কি না, সন্দেহ আছে। যে চুক্তি হয়েছে, তাতে কী ভাবে তিপ্রাল্যান্ডের ধারণার বাস্তবায়ন করা হবে, কী মানচিত্র বা আইনগত অধিকার হবে, কিছুই স্পষ্ট লেখা নেই।
এখন প্রশ্ন, বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ত্রিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরে এত তাড়াহুড়ো করল কেন? উত্তর হল— লোকসভা নির্বাচনে ত্রিপুরার পূর্ব আসন তফসিলি জনজাতিদের জন্য সংরক্ষিত। আরএসএস-এর এক ধরনের কর্ম-তৎপরতা ত্রিপুরার আদিবাসী এলাকায় বহু বছর ধরে আছে। বিপ্লব দেব ২০১৮ সালে প্রথম বার জিতে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পিছনে, আদিবাসী সমর্থন ছিল বড় রকমের। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তাঁকে মুখ্যমন্ত্রিত্ব থেকে সরিয়ে, পশ্চিমের আসনে টিকিট দিয়েছে এই কারণেই। তাঁর জন্যই কেন্দ্রীয় বিজেপি নেতৃত্বের সঙ্গে প্রদ্যোত দেববর্মার সম্পর্কের ভিত্তিও দৃঢ় হয়েছে বলে শোনা যায়। এই ত্রিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার ফলে ত্রিপুরা পশ্চিম আসনে তিপ্রা মথা সমর্থকদের ভোট বিজেপির জন্য প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেছে। অন্য দিকে, প্রায় সাত দশক পর দু’টি লোকসভা আসনে একসঙ্গে লড়ছে বাম দল ও কংগ্রেস, এ বারের ভোটে যার ছাপ ক্ষীণ হবে বলেই মনে হয়।
ত্রিপুরা পূর্ব লোকসভা আসন যা তফসিলি জনজাতিদের জন্য সংরক্ষিত, তার প্রার্থী নির্বাচন নিয়ে সমস্যা ছিল। যাতে এমন মনে না হয় যে, বিজেপির প্রার্থীকেই ভোট দিতে হচ্ছে, তাই এমন এক জনকে ঝাড়খণ্ড থেকে নিয়ে এসে পূর্ব আসনে প্রার্থী করা হল— প্রদ্যোত দেববর্মার বড় বোন মহারানি কৃতি সিংহ দেববর্মাকে— যিনি ‘রাজবাড়ি’র লোক। মথার সমর্থকের রাজবাড়ির প্রতি আনুগত্য জানা কথা। অন্য দিকে, মহারানি বিজেপির লোক। এক ঢিলে অনেকগুলো পাখি মারা হয়েছে।
প্রদ্যোত দেববর্মা এখনও পরিকল্পনা মাফিকই এগোচ্ছেন। কিন্তু আগামী কয়েক বছর তাঁর জন্য অগ্নিপরীক্ষা। তিনিই তিপ্রাসা থেকে তিপ্রাল্যান্ড করার আহ্বান জানিয়েছিলেন, তাঁরই জন্য দলটা টিকে আছে। তিনি প্রতিশ্রুতি মতো তিপ্রাল্যান্ড আগামী ২-৩ বছরে তৈরি না করলে মথার অবস্থাও হবে আইপিএফটির মতো। তিপ্রাল্যান্ডের ধারণা হারিয়ে গেলে, ত্রিপুরার আদিবাসী রাজনীতির বর্তমান গতিপ্রকৃতি হারিয়ে যাবে। তবে তাতে বিজেপির কী? ভোট বার করে নেওয়াই যখন লক্ষ্য, তখন বেল পাকলে কাকের কী?
তিপ্রা মথার সঙ্গে বিজেপির জোটের যে চরিত্র, তার সঙ্গে বিভিন্ন রাজ্যে বা প্রদেশে বিজেপি অন্য আঞ্চলিক দলগুলোর যে ভাবে জোট বেঁধেছে, তার তুলনা হয় না। অন্য প্রদেশে জোটের পরিমণ্ডল ছিল। ইচ্ছাকৃত ভাবে, বা কৌশলগত ভাবে হোক, ত্রিপুরার ক্ষেত্রে জোটের পরিস্থিতি মেঘের আড়ালে ছিল। ত্রিপুরায় ২০২৩-এর বিধানসভা ভোটের আগে যে প্রক্রিয়াটা শুরু হয়েছিল, সেই কৌশল পরিপূর্ণতা পেয়েছে এ বারে। ভারতবর্ষে বর্তমানে রাজাদের রাজনীতিতে নিয়ে আসার পালা চলছে, রাজবাড়ি নিয়ে আবেগ পশ্চিমবঙ্গেও টের পাওয়া যাচ্ছে কৃষ্ণনগরে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আত্মীয় রাজবধূ অমৃতা রায়কে বিজেপির প্রার্থী হিসাবে দাঁড় করানোর ফলে। তবে ত্রিপুরার ক্ষেত্রে লক্ষণীয়, তিপ্রা মথার গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে কী ভাবে উপেক্ষা করে তাদের রাজানুগত পার্টি হিসাবে গণ্য করে, অঙ্ক কষে, ঝাড়খণ্ড থেকে নিয়ে আসা হয়েছে প্রদ্যোত দেববর্মার বোনকে, যাঁর সঙ্গে ত্রিপুরার বহু বছর ধরে কোনও যোগ নেই। তিপ্রা মথা রাজবংশের সদস্যকে প্রার্থী হিসাবে পেয়ে খুশি, আবার বিজেপির সমর্থকরা জানেন, তিনি বিজেপিরই প্রার্থী।
সারা ভারতে মোট ৪০০ আসনে জয়ী হওয়ার লক্ষ্য কেবল রাজনৈতিক স্টান্ট নয়, বিজেপির নির্বাচনী ম্যানেজাররা প্রতিটি আসন নিয়ে কী পরিমাণ বিশ্লেষণ করছেন বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে, এবং আইটি সেলকে কাজে লাগিয়ে— সেটা খেয়াল করা দরকার। মাত্র দু’টি আসনের জন্যও যুক্তি-বুদ্ধি বিশ্লেষণের এই ম্যানেজমেন্ট ‘প্রশংসনীয়’ নয় কি?