—প্রতীকী চিত্র।
ফরাসি বিপ্লবের ধ্বংসাবশেষকে ‘ব্যবহার’ করে প্রায় একক প্রচেষ্টায় সম্রাট হওয়া নেপোলিয়নের নামে যে ক’টি স্মরণীয় উক্তি কথিত আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে অমোঘ বোধ হয় এইটি যে, রাজনীতিতে ‘স্টুপিডিটি’ বা নির্বুদ্ধিতা বিশেষ কোনও প্রতিবন্ধকতা নয়। রাজনীতির সঙ্গে ক্ষমতার লোভ, নির্লজ্জ আত্মম্ভরিতা, ধূর্ততা, দুর্নীতি, টিকে থাকার জেদ (সারভাইভালিজ়ম) ইত্যাদি যে অঙ্গাঙ্গি ভাবে যুক্ত, এটা তো আমাদের মজ্জাগত উপলব্ধি, কিন্তু ‘স্টুপিডিটি’ও যে রাজনীতির হাতিয়ার হতে পারে, সেটা কিন্তু সচরাচর আমাদের গোচরে আসে না।
আসা উচিত ছিল। তার কারণ সুকুমার রায়। সদ্য শতবর্ষে পড়া আবোল তাবোল আবার পড়তে গিয়ে কথাগুলো মনে হল। সুকুমারের প্রয়াণকাল আর আবোল তাবোল সমবয়সি। সুকুমার যে অফুরান, একটু মনোযোগ দিয়ে আশেপাশে তাকালেই যে তাঁর ননসেন্স-এর মূর্ত, সারবান উপস্থিতি লক্ষ করা যায়, সে নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। কবীর সুমন লিখেছিলেন, “আমার সমাধি হবে অমোঘ চিতায়/ তখন আগুন হোয়ো সুকুমার রায়।” এটি শুধু এক অক্ষয় শিল্পীর প্রতি আর এক শিল্পীর আবেদন নয়, সমকালই বুঝি এই আর্জি নিয়ে ফিরে ফিরে যায় সুকুমারের কাছে। রাজনীতির নির্বুদ্ধিতা আর নির্বোধের রাজনীতি বুঝতে চেয়ে এই লেখাও সেই আর্তিরই পুনরাবৃত্তি।
রাজনৈতিক দর্শনের মূলধারার মতে ক্ষমতা অগোচর হতে ভালবাসে। নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি থেকে এডমন্ড বার্ক সবারই মত যে, ক্ষমতালোভী কোনও বলয় তাদের ক্ষমতার বিগ্রহকে জনগণের থেকে দূরে রাখতেই পছন্দ করে, পাছে নৈকট্যে ক্ষমতার ‘মানহানি’ হয়। ধর্মে যেমন— যত দূরে তত ভক্তি। এই প্রবণতা আমরা জর্জ অরওয়েল-এ পেয়েছি, হাক্সলি-র ‘মুস্তাফা মন্ড’-এ পেয়েছি; এমনকি রক্তকরবীর রাজার দুরূহ নৈর্ব্যক্তিকতাতেও ধরা পড়ে আলো আর বাসনার কাছে ধরা না দেওয়ার এক মরিয়া আকাঙ্ক্ষা। এ প্রসঙ্গে অনেকেরই মনে আসবে যে রক্তকরবীও লেখা শুরু হয়, যক্ষপুরী হিসাবে, ১৯২৩-এই। ওই নাটকের প্রস্তাবনা থেকে পরিষ্কার যে রবীন্দ্রনাথ রূপকধর্মী নয়, আদ্যোপান্ত একটি রাজনৈতিক নাটকই লিখতে চেয়েছিলেন। ক্ষমতার অনায়াস আস্ফালন ও কেন্দ্রীকরণ, ধনবাদ, প্রোলেতারিয়েতের মুক্তি, এমনকি বাসনার মুক্তিও রক্তকরবীর বিষয়। বেশ কিছু দশক পরে ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো ও তার দুই উত্তরসূরি দেল্যুজ় ও গুয়াত্তারির লেখা পড়লে রক্তকরবী খুব স্বাভাবিক ভাবে মনে আসে। এই নিয়ে একাধিক কাজ আছে, বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য মিরান্দা পত্রিকার ২০০৩ সালের একটি সংখ্যা, যেখানে অনেক বিখ্যাত পণ্ডিত নতুন করে ভেবেছিলেন রক্তকরবী নিয়ে। আশ্চর্যের বিষয় হল, যে উপন্যাসটিকে ‘ডিস্টোপিয়ান জন্র’-এর পুরোধা ধরা হয়, ইভগেনি যামিয়াতিন-এর সেই উই-এর ইংরেজি অনুবাদ বেরিয়ে যায় ১৯২৪-এ, যদিও ১৯৫২ অবধি এর মূল রুশ সংস্করণটি প্রকাশিত হয়নি। উই-এর সর্বগ্রাসী ‘ওয়ান স্টেট’ পরে অরওয়েল ও হাক্সলি-তে ফেরত আসে। কিন্তু বহু আগে রক্তকরবীর সঙ্গে সমকালীন উই কিন্তু অসীম শক্তিধর ‘স্টেট’-এর উদ্বেগ ভাগ করে নিচ্ছে।
এক ভাবে ভাবতে গেলে আবোল তাবোল নামক সংগ্রহের পূর্ণতাপ্রাপ্তি এবং রক্তকরবীর সূচনা একই সময়ে। সেখানে একটা প্রশ্ন জাগে। সেটা হল, ক্ষমতা কি শুধুই নির্মম, আপন ভারে ভারাক্রান্ত, সুদূরস্থিত দর্শনের বিবেচ্য বস্তু, যেটা রক্তকরবীর কেন্দ্রীয় ভাবনা? না কি অন্য কিছু? চার পাশ দেখলে কি মনে হয় না ক্ষমতা একটি বলবান কিন্তু আস্ত গবেটের প্রয়োগশালাও বটে? সুকুমারের অলীক, জাদুসদৃশ এবং ব্যতিক্রমী যে কল্পনার রাজ্য, সেখানে অন্যান্য দর্শনের মতো রাজনীতির পাঠও অনেকটাই অন্য রকম। রাজনীতি সেখানে প্রগল্ভ, বেহায়া, হাস্যকর এবং মনোরঞ্জনে সদাব্যস্ত এক নিচু মানের কৌতুক-অভিনেতার মতো।
এই নিয়ে একাধিক কবিতা বা কবিতার অংশ আছে, তার মধ্যে এখানে তিনটি উল্লেখই যথেষ্ট। যেমন ‘বোম্বাগড়ের রাজা’। তার রাজত্বে কী কী হয়, তার ফর্দটা কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে অ্যাবসার্ড। সত্যি আমরা জানি না কে বা কারা ‘সিংহাসনে ঝোলায় কেন ভাঙা বোতল শিশি?’ বা ‘কুমড়ো নিয়ে ক্রিকেট খেলে কেন রাজার পিসি?’ ইত্যাদি। দেখা যাচ্ছে যে শুধু রাজাই নয়, রাজ্যের বাকি যারা গণ্যমান্য— ওস্তাদ, পণ্ডিত, মন্ত্রী, রাজার খুড়ো বা পিসি, সবাই কিন্তু বিনা প্রতিবাদে, বিনা বাক্যব্যয়ে এই আস্ত ‘অ্যাবসার্ডিটি’র অংশ। যদি এ ভাবে ভাবা যায় যে বোম্বাগড়ের রাজা রাজত্বের নামে যা খুশি তাই করে, কেউ কিছু বলার নেই, আস্ত একটি সার্কাস দেখেও কারও প্রতিবাদের শিরদাঁড়াটি খাড়া হয় না, তা হলে বাস্তবিকই রাজনীতির একটা অকাট্য বলিরেখা কবিতাটার গায়ে ফুটে ওঠে। নির্বোধ রাজাও সর্বশক্তিমান, আর তিনি যে নির্বোধ সেটা বলার চেয়ে আগাপাছতলা ওই নির্বুদ্ধিতার প্রতিযোগিতায় যোগ দেওয়া ঢের সহজ। একেই আমেরিকার লেখক জন কেনেডি টুল তাঁর কৌতুককাহিনি-তে বলেছেন
‘আ কনফেডারেসি অব ডান্সেস’। রাজনীতি যে চাইলেই ক্ষমতার ননসেন্স-এ পর্যবসিত হতে পারে তার আরও উৎকৃষ্ট প্রমাণ ‘কুমড়ো পটাশ’ আর ‘একুশে আইন’। ‘কুমড়ো পটাশ’-এ যেমন পরিষ্কার বিধান লেখা থাকছে: “(যদি) কুম্ড়োপটাশ হাসে-/ থাকবে খাড়া একটি ঠ্যাঙে রান্নাঘরের পাশে;/ ঝাপ্সা গলায় ফার্সি কবে নিশ্বাসে ফিস্ফাসে;/ তিনটি বেলা উপোস করে থাকবে শুয়ে ঘাসে!” অর্থাৎ বোম্বাগড়ের রাজা যা খুশি করে নিজে সুখ পায়, আর এক ধাপ এগিয়ে কুমড়োপটাশ কিন্তু সুনিশ্চিত করতে চায় যে তার বিভিন্ন অভিলাষের ইঙ্গিতে জনগণ না গণজন— কী ভাবে সাড়া দেবে। দরকার হলে তারা উল্টে ঝুলে, গাছে চড়ে, ভুখা থেকে, ইটের ঝামা ঘষে থাকবে। সেই মতো ‘এডিক্ট’ তৈরি করা আছে যাতে কোনও ভাবেই অমান্যের সামান্য সুযোগও না থাকে। শেষে এসে এটা আর অধরা থাকছে না। “তুচ্ছ ভেবে এ-সব কথা করছে যারা হেলা,/ কুম্ড়োপটাশ জানতে পেলে বুঝবে তখন ঠেলা।” অর্থাৎ বোম্বেটে রাজাটি আর ক্ষমতার বাহক নয়, ক্রমে নিজেই ক্ষমতার সমার্থক হয়ে উঠছে। আর ক্ষমতার সবচেয়ে বড় দোসর যে-হেতু আইন, তাই কুমড়োপটাশকে চটালে কী হতে পারে তার ফর্দ সিডিশন আইন, থুড়ি ‘একুশে আইন’-এ আছে। সামান্যতম বিচ্যুতিও সেখানে রাজার সিপাইকে লেলিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। “চলতে গিয়ে কেউ যদি চায়/ এদিক্ ওদিক্ ডাইনে বাঁয়,/ রাজার কাছে খবর ছোটে,/পল্টনেরা লাফিয়ে ওঠে,/ দুপুরে রোদে ঘামিয়ে তায়-/ একুশ হাতা জল গেলায়।।” সুকুমারের মাথায় ঔপনিবেশিক আইন যে ছিলই এ কথা হলফ করে বলা যায়, কিন্তু আইন বস্তুটির একেবারে মূলে যে আস্ত একটি অসম্ভবতা, কাপুরুষতা আছে, সেটা তো আমাদের চার পাশ দেখলে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে যায়।
তিনটে কবিতাকে পাশাপাশি রাখলে যা দাঁড়ায় তা হল— নির্বোধ রাজা যা খুশি করবে, আর রাজার নিকটজন তাতে যোগ দেবে; জনগণ রাজার বিধান অনুযায়ী সমস্ত অপমান হজম করবে; আর তা না করলে বা বাধ্য, বশে থাকা প্রজা হতে তারা অনিচ্ছুক হলে রাজার ‘আইন’ সেইমতো ব্যবস্থা করবে। এই সরলরেখাটি ক্ষমতাকে একটা অতিকায় রূপ দেয়, সুকুমারের হাতে সেটাই কিন্তু কৌতুকের, ব্যঙ্গের বস্তু। নোটবন্দি থেকে কোভিড মোকাবিলায় থালা বাজানোর ঘোষণা, ‘মন কি বাত’ থেকে চন্দ্রযান, গো-বলয় থেকে ভূ-রাজনীতি বা আম ভক্ষণের সু-উপায়, ‘অখণ্ড’ ভারতের অস্তিত্ব থেকে ‘সমস্ত’ রাষ্ট্রনীতিতে ডিগ্রি-সহ এখনকার ভারতে নির্বোধ রাজা ও তাঁর হ্যাঁ-তে হ্যাঁ মেলানোর উদাহরণ এত ঝুড়ি ঝুড়ি, পান থেকে চুন খসলে মাইনে করা পেয়াদার দরজায় ঠকঠক এতই স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, রাজনীতির যে ‘সুকুমার’ পাঠ, অর্থাৎ ‘ননসেন্স’-ই ‘নুইস্যান্স’-কে বুঝতে সাহায্য করে, সেটা দিন দিন আরও পরিষ্কার হচ্ছে।
ক্ষমতার অবয়ব নিয়ে সুকুমার-রবীন্দ্রনাথের মধ্যে এই কাল্পনিক ডায়ালেক্টিক-এর যদি একটা ছক আঁকা যায়, দেখা যাবে যে ইউরোপে কিন্তু এই ছক ধরা পড়ছে প্রায় এক দশক পরে। ১৯৩০-এর দশকে। সেখানে এক দিকে নাৎসিদের পৃষ্ঠপোষকতায় জার্মানিতে তৈরি লেনি রিফেনস্থল-এর ট্রায়াম্ফ অব দ্য উইল (১৯৩৫) আর অলিম্পিয়া (১৯৩৮)— ছবি হিসাবে দু’টিই অনন্যসাধারণ এবং দু’টিই হিটলারকে দেবত্ব আরোপ করে বানানো প্রপাগান্ডাধর্মী। ক্ষমতার আকার সে কারণেই সেখানে প্রকাণ্ড, বিস্তৃত— অর্থাৎ এক কথায় রক্তকরবীর কাছাকাছি। আর এর উল্টো দিকে মুসোলিনিকে মাথায় রেখে মার্ক্স ব্রাদার্স-এর ব্যঙ্গধর্মী বাউডেভিল ডাক সুপ (১৯৩৩) আর চার্লি চ্যাপলিনের মাস্টারপিস দ্য গ্রেট ডিকটেটর (১৯৪০)। দু’টিতেই, বিশেষ করে চ্যাপলিন-এ ‘ডিকটেটর’ কিন্তু বেকায়দায় পড়া,
ক্ষণে ক্ষণে হোঁচট খাওয়া, ভয় পাওয়া, পালিয়ে যাওয়া, পর্দা বেয়ে উঠে যাওয়া, বেলুনের পৃথিবী নিয়ে খেলতে খেলতে বেলুন ফেঁপে যাওয়ায় পশ্চাদ্দেশ উঁচিয়ে খানিক কেঁদে নেওয়া এক সঙ্কুচিত, অসঙ্গত, হাস্যাস্পদ উপদ্রব। রিফেনস্থল-এর ‘ফুয়েরার’ ঠিক উল্টো।
দ্য গ্রেট ডিকটেটর যে ব্যঙ্গাত্মক, সেটা নতুন কথা নয়, কথাটা হল যে সেই ব্যঙ্গের রোষ প্রায় পুরোটাই পড়ছে হিটলার-এর শরীরের উপর গিয়ে। ব্যঙ্গের এই রাজনীতিটাই আসল। ক্ষমতাকে যদি ভাঙতে হয়, তা হলে ক্ষমতার ভয় ভাঙতে হবে, আর ক্ষমতার ভয় ভাঙতে হলে ক্ষমতাকে ব্যঙ্গ করতে জানতে হবে, আর ক্ষমতাকে ব্যঙ্গ করতে হলে তাকে কাছে টেনে তার কদর্য উদর, তার দাঁতের পোকা, তার কানের লোম নিয়ে এক প্রস্ত হেসে নিতে হবে। অর্থাৎ ক্ষমতাকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার আগে তার অতিকায় ধারণাকে, তার সযত্নলালিত ইমেজকে, তার আত্মম্ভরিতাকে গুঁড়িয়ে দিতে হবে। ফ্যাসিজ়ম-এর উগ্র আস্ফালনের মাঝে দাঁড়িয়ে এ কথা বুঝেছিলেন চ্যাপলিন। তার প্রায় কুড়ি বছর আগে একই কথা বুঝেছিলেন সুকুমার রায়।