—প্রতীকী ছবি।
চুপ করে আর থাকা গেল না রে, তোপসে। এমন দিন এসে গেল, চুপ করে আর থাকা যায় না!
এমন দিনে প্রধানমন্ত্রীর রাজস্থান-বক্তৃতা শোনা গেল। শোনা হল কী ভাবে সাতাত্তর বছরের গণতন্ত্রের জীবনে নিম্নতম বিন্দুটি ছোঁয়া যায়। বোঝা হল ভারত আমার ভারতবর্ষের চেনা মাটিটা কেমন আজ সমূলে উৎপাটিত। গ্রীষ্মের খরসূর্যের দাহনে তখন যেন পুড়ে যাওয়ার জোগাড়— অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে... ঠিক ওই রকম পোড়া।
ভাবি, কেউ যখন বলবেন, ‘আক্রমণ’ তো সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে, ‘আমাদের’ তাতে কী— উত্তর কী দেব? অকালি দলের নেতার কথাটিই কি বলব? ওই যে শিরোমণি অকালি দল (বাদল)-এর নেতা পরমবংশ সিংহ রোমানা বললেন— “এবার যদি ওরা লক্ষ্য হয়, পরের বার কিন্তু আমরা!”
এখানে ‘ওরা’ মুসলমান, ‘আমরা’ শিখ। কিন্তু ‘ওরা-আমরা’ চার দিকে আরও অনেক রকম ছড়িয়ে। ভিন ধর্মের দরকার নেই, হিন্দুরা হিন্দু হলেও ‘ওরা’ হয়ে যেতে পারে, যে কোনও মুহূর্তে! কেননা যতই এক দেশ এক জাতি, এক দেশ এক ভোট ইত্যাদি হইচই হোক না কেন, আমরা তো জানিই যে এক ধর্মের মধ্যেও কেমন অগুনতি রকম হিন্দু! বাঙালি হিন্দুরা গোবলয়-হিন্দুত্ববাদ থেকে কেমন শত যোজন দূরে, যারা অনায়াসে হতেই পারে ‘ওরা’। কিংবা সেই হিন্দুরা যারা ‘আরবান নকশাল’, অন্য রকম ভাবনা ভাবে, তারাও। সেই হিন্দুরা যারা সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতা হ্যানতানে বিশ্বাস রাখে, তারাও। সেই হিন্দুরা যারা ভাবতে বসে, গণতন্ত্রের ভান্ডার আছে ভরে তোমা সবাকার ঘরে ঘরে, তারাও। সেই হিন্দুরা যারা নারীকে আপন ভাগ্য জয় করার সমান মাটি দিতে চায়, তারাও। আর, অবশ্যই, সেই হিন্দুরা যারা ‘জয় শ্রীরাম’ বলতে অনাগ্রহী, কিংবা যারা গরুকে বাঁচাতে মানুষকে মারা শ্রেয় ভাবতে নারাজ, কিংবা যারা আমিষাশী, কিংবা যারা শাঁখা-সিঁদুর-পৈতে-পুরুত অন্ত প্রাণ নয়, তারা তো ‘ওরা’ বটেই।
আসলে হিন্দুরা ইতিমধ্যেই ‘ওরা’ হয়ে গিয়েছে, এটাই খবর। এই যেমন, কর্নাটকের লিঙ্গায়ত সম্প্রদায়। ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে’ ভাবে লড়ছেন তাঁরা, আজকের সাম্রাজ্যবাদী হিন্দুত্ববাদের সঙ্গে। ‘আততায়ীর হাতে নিহত’ গৌরী লঙ্কেশ বা মালেশাপ্পা মালদিভালাপ্পা কালবুর্গিরাই বলে গিয়েছেন, লিঙ্গায়তদের সঙ্গে বিজেপি-আরএসএস’এর কেবল আদর্শের দূরত্ব নয়, রাজনৈতিক শত্রুতা— লিঙ্গায়তদের শেষ করতে উত্তরাপথের ‘হিন্দু’রা তাই অতি উদ্যোগী। টাইম পত্রিকায় পড়লাম ক’দিন আগে, ‘দ্য হিন্দু লিডার্স ফাইটিং হিন্দু ন্যাশনালিজ়ম’, জানলাম, কেরল রাজ্যে স্বামী সন্দীপানন্দ গিরির আশ্রমের উপর কয়েক মাস আগেই বিরাট আক্রমণ ঘটেছে, কেননা স্বামীজি হলেন আরএসএস-ভাবনার প্রবল বিরোধী। কেরল, কর্নাটক, তামিলনাড়ু থেকে শুধু হিন্দি ভাষার আগ্রাসনের বিরোধিতা আসছে না, ধর্মের অর্থ ও অধিকার নিয়েও জমি দখলের লড়াই চলছে। ইতিহাস বলে, এই তিন রাজ্যেই হিন্দুত্বের আলাদা ঘরানা শ-দেড়েক বছর ধরে সক্রিয়। তার সঙ্গে নাগপুরী হিন্দুত্ববাদ মোটেই খাপ খায় না। কথাটা হল, যে সব ‘হিন্দু’ ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও আশ্রম এখনই আক্রমণের লক্ষ্য, দেশজোড়া দামামা-বাদন শেষ হলে যে অমৃত-ভারত সুনীল জলধি থেকে উঠে আসবে, সেখানে তারা আরওই বেশি ‘ওরা’ হয়ে যাবে না কি?
এ তো গেল ধর্মের অপরাপর আশ্রমের কথা। আর এ সবের বাইরে যাঁরা আছেন? ধর্মে যাঁরা নিরাসক্ত? ধর্ম বলতে যাঁরা বোঝেন ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’? আজ তাঁরা সবাই ‘ওরা’ হয়ে গিয়েও চুপ করে আছেন। কিন্তু তাঁদের ভবিতব্য কী?
ভবিতব্যের সেই হদিস দিয়েই গিয়েছিলেন নাৎসি জার্মানির প্যাস্টর বা যাজক, মার্টিন নিমোলার। সেই বহু-কপচানো কবিতাটা নিমোলারেরই লেখা: “প্রথমে ওরা কমিউনিস্টদের ধরতে এল/ আমি কিছু বলিনি/ কেননা আমি কমিউনিস্ট নই।/ তার পর ওরা সোশ্যালিস্টদের ধরতে এল/ আমি কিছু বলিনি/ কেননা আমি সোশ্যালিস্ট নই।/ তার পর ওরা ট্রেড ইউনিয়নিস্টদের ধরতে এল/ আমি কিছু বলিনি/ কেননা আমি কোনও ট্রেড ইউনিয়নিস্ট নই।/ তার পর ওরা ইহুদিদের ধরতে এল/ আমি কিছু বলিনি/ কেননা আমি ইহুদি নই।/ তার পর ওরা আমাকে ধরতে এল/ আমার হয়ে বলার জন্য তখন কেউ ছিল না— কেউ না।” এ কবিতা অনেকেরই জানা। জানা হয়তো কম— নিমোলার ব্যক্তিটি কে, তাঁর কী হয়েছিল। নাৎসি বাহিনীর সমর্থক ছিলেন তিনি এক দশকেরও বেশি। ১৯৩০-এর দশকের মাঝামাঝি অবশ্য নাৎসিদের সমর্থন করা কঠিন হয়ে গেল, বন্দি হলেন নাৎসি কারাগারে, আটটি বছর ভয়ানক কারাজীবন কাটিয়ে ছাড়া পেলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের উৎখাতের পর। তার পরই লেখা এই কবিতায় অনেক দিন চুপ করে প্রতিবাদ না জানানোর দামটি স্বাক্ষরিত হল। পড়তে গিয়ে মনে হয়, ‘অন্যায় যে সহে’, তার জন্য রবীন্দ্রনাথের কবিতায় ছিল এক আত্মিক মূল্য চোকানোর কথা। আর নিমোলারের কবিতা বলে দিল কেমন করে রক্তমাংসের জীবনেই ধরে দিতে হয় দামটা।
‘পলিটিকস অব সাইলেন্স’ নিয়ে আলোচনা অনেক। হানা আরেন্ট-এর নামটি আলাদা করে মনে পড়ে। নীরবতার মধ্যেও যে কত আলাদা ঢেউ-এর হদিস, জেনেছিলাম। তাই ভাবি, কেউ চুপ করে থাকেন অন্যায়ের সমর্থনে ও স্বীকৃতিতে। কেউ চুপ থাকেন ভয়ে। কিন্তু যে জনেরা থাকেন মাঝখানে— তাঁদের চুপকথার ভরটি সংশয়ে, অজানায়, অবিশ্বাসে। কেউ ‘কনফিউজ়ড বাই হোয়াট ইজ় গোয়িং অন’, কেউ ‘র্যাশনালি ইগনোর্যান্ট অ্যাজ় টু দ্য ফ্যাক্টস’। বাস্তব হল, সংশয়ের রূপটি আজ আর অবহেলা করার মতো নয়: কেননা কোনটি সত্যি কোনটি নয় তা আজ জানার উপায় নেই। পোস্ট-ট্রুথ আর আইটি সেল-এর তোলপাড়ে ‘কনফিউশন’ আর ‘ইগনোর্যান্স’, দুই-ই লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে বাড়ছে। এর ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়বেই নীরবতার সমর্থন (কমপ্লিসিটি), আশ্চর্য কী।
লক্ষণীয়, এক দিকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অভিযোগ যে ভিত্তিহীন, সেটা যেমন ইগনোর্যান্স বা অজ্ঞানতায় ডুবে যাচ্ছে, অন্য দিকে এ যে কেবল মুসলমানদের বিষয় নয়, অভিযোগ ও আক্রমণ যে যে-কোনও মুহূর্তে ধেয়ে আসতে পারে অন্যদের দিকেও, সেটা তত শোনা যাচ্ছে না কনফিউশনের চোটে। ইগনোর্যান্স ও কনফিউশনের এই যুগল প্রকোপে আমরা চোখে যা দেখি, কানে যা শুনি, তারও অর্থ বোধগম্য হয় না। তাই নির্বাচনী বন্ড রহস্য, মুসলমানদের মধ্যে দেশের সম্পদ বাঁটোয়ারার অন্যায় অভিযোগ, সবই এসে ভেসে চলে যায়। ঘৃণাভাষণ যে অন্যায় ও বেআইনি— ‘কনফিউশন’-এর চোটে বেচারা নির্বাচনী কমিশনই তা বুঝে উঠতে পারে না, অথচ সেই কমিশনকে বিরোধী দেখলেই ‘রেড’ করতে ছুটে যেতে দেখে অজ্ঞানজন ভাবে, শাসকের পদলেহনই সরকারি প্রতিষ্ঠানের একমাত্র কাজ, অসুবিধে কোথায়! কেরলে ইভিএম-এ ধরা পড়ে বিজেপির নামে অতিরিক্ত ভোট— মোট যত ভোট পড়ার কথা, তার থেকেও বেশি, আর তদন্ত ছাড়াই ঘোষিত হয়, অভিযোগ মিথ্যা। অজ্ঞানজন শুনে শান্তি পান, প্রসন্ন হন।
আসল কথা, এই ভারতে এখন প্রতিষ্ঠানগুলি বিকল ও বিনষ্ট, আর মানুষগুলি নীরব ও নির্বাক। নীরবতা এমনিতে এক মহা গুণ বলেই জানি আমরা, যার মধ্যে আছে সংযমের সৌন্দর্য, এমনকি প্রতিরোধের কৌশলও। কিন্তু কোনও কোনও সময় আসে যখন নীরবতা অমার্জনীয়, সেটা ভাঙাটাই তখন প্রতিবাদ হওয়ার কথা— কেননা নীরবতা ততক্ষণে দাঁড়িয়ে গিয়েছে ক্ষমতার পরিপোষণের পথ হয়ে, স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায়। নীরবতার জন্যই তখন মানবনিয়তি অন্য খাতে বইতে শুরু করেছে, দেশভাগ্য অস্তমিত হতে বসেছে। নীরবতা ভেঙে বেরিয়ে আসাটা তখন হয়ে যায় একটা নৈতিকতার প্রশ্ন। রাজনৈতিকতার প্রশ্ন তো বটেই।
আর তেমন-তেমন সময় এলে, যাঁরা চুপ করে থাকেন, কেউ ভয়ে, কেউ সংশয়ে, কেউ হতাশায়, কেউ যন্ত্রণায়— এই দুর্দিনে বোধহয় তাঁদের ফেরাতেই হয়— ব্যর্থ নমস্কারে।