পঞ্চায়েত নির্বাচনে আইএসএফ-এর উত্থান এবং শাসক দল তৃণমূলের সঙ্গে তাদের হিংসাত্মক সংঘর্ষ। —ফাইল চিত্র।
পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে হিংসার যে বিশদ বিবরণ প্রতি দিনই সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হল, তার একটা বৈশিষ্ট্য খেয়াল না করে উপায় নেই— বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট বা আইএসএফ-এর উত্থান এবং শাসক দল তৃণমূলের সঙ্গে তাদের হিংসাত্মক সংঘর্ষ। এটা রাজ্য-রাজনীতিতে একটা নতুন মোড়।
গোড়াতেই দুটো কথা বলে নেওয়া যাক। প্রথমত, সাম্প্রতিক অতীতে পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান জনগোষ্ঠী এমন কোনও রাজনৈতিক দল পায়নি, যারা শুধুমাত্র তাদের কথাই বলেছে। বামফ্রন্ট আমলে মুসলমানদের নানা অভিযোগ ছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই অসন্তোষকে ব্যবহার করে মুসলমান ভোটব্যাঙ্ক ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন। সাগরদিঘি উপনির্বাচনে তৃণমূলের হারের পর সেই ভোটব্যাঙ্কে চিড় ধরাটা আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে বটে, মাটি কিন্তু তলায় তলায় সরছিল গত বিধানসভা নির্বাচন থেকেই। মুসলমানপ্রধান অঞ্চলে কান পাতলেই শোনা যেত, ‘ভাইজান’কে কেন্দ্র করে আলোচনা শুরু হয়েছে। কোনও রাজনৈতিক দল শুধুমাত্র তাদের কথাই বলবে, এমন প্রতিশ্রুতিতে বাংলার মুসলমানদের একটা অংশ সাড়া দিয়েছিল। আইএসএফ-এর প্রাপ্ত ভোটের কত শতাংশ কোন ধর্মাবলম্বীদের থেকে এসেছে, তা নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে। কিন্তু এ কথা অনস্বীকার্য যে, বত্রিশটি আসনে আট লাখেরও বেশি ভোট জমা হয়েছিল আইএসএফ-এর ঝুলিতে।
দ্বিতীয়ত, নামে এবং ইস্তাহারে ধর্মনির্বিশেষে পিছিয়ে পড়া শ্রেণির সমানাধিকারের কথা বললেও আইএসএফ ধর্মের ভিত্তিতেই রাজনীতিতে এসেছে— এই সহজ সত্যটা মেনে নেওয়াই মঙ্গল। বামফ্রন্ট তথা সিপিএমের তরফে এই ‘পিছিয়ে পড়া শ্রেণির সমান অধিকার’-এর বুলি আওড়ে আইএসএফ-কে তাদের স্বাভাবিক জোটসঙ্গী হিসাবে তুলে ধরার চেষ্টা এখনও চোখে পড়ছে। কিন্তু যে সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ককে লক্ষ্য করে আব্বাস ও নওসাদ সিদ্দিকীরা মাঠে নেমেছেন, সেই মুসলমানদের একটা অংশ অন্তত আইএসএফ-কে ‘নিজেদের দল’ হিসাবেই দেখছে।
ধর্মের নামে ভোট চাওয়া আমাদের জন্যে নতুন নয়। দেশের তখ্তে যাঁরা বসে আছেন, সেই শাসক দলেরও নির্বাচন বৈতরণি পার হওয়ার মূল চালিকাশক্তি এটি। কিন্তু একটা অশুভ শক্তিকে পরাস্ত করতে আর একটা বিষবৃক্ষ রোপণের অর্থই হল তাদের নৈতিক ভাবে জিতিয়ে দেওয়া। রাহুল গান্ধীই হোন বা অরবিন্দ কেজরীওয়াল বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, বিজেপির মোকাবিলায় সর্বদা এঁরা প্রমাণ করতে চেয়েছেন, এঁরা নিজেরা কত বড় হিন্দু। এমনকি যে মুখ্যমন্ত্রী একা হাতে গত বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলকে জিতিয়েছেন, সেই তাঁকেও নির্বাচনী মঞ্চে চণ্ডীপাঠ করতে হল। এর বিপরীতে দাঁড়িয়ে সংখ্যালঘু ভোট একত্রিত করতে আইএসএফ নেতারা যদি দেখাতে চান যে তাঁরা মুসলমানদরদি, তাতে প্রচলিত ধারার বিপরীতে হয়তো হাঁটা হয়, কিন্তু সঙ্কটের হেরফের ঘটে না। সবচেয়ে বড় সঙ্কট কাদের? যাদের হয়ে তাঁরা সমানাধিকারের সওয়াল করছেন, সেই জনগোষ্ঠীরই।
গত কয়েক দশক ধরে এ রাজ্যের মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষা-সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। খাটতে পারার মতো বড় হলেই ছেলেকে কোনও কাজে ঢুকিয়ে দেওয়া বা মেয়েকে বিয়ের আসনে বসিয়ে দেওয়ার চিরাচরিত ধারা থেকে বেরিয়ে আসছেন এমনকি দারিদ্রসীমার নীচে বাস করা মুসলমান অভিভাবকরাও। আল-আমিন মিশনের মতো অজস্র আবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি বছর হাজারে হাজারে মুসলমান ছাত্রছাত্রী উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে উচ্চশিক্ষার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মূলত জাকাত থেকে সংগ্রহ করা অর্থ এবং ধনী ব্যবসায়ীদের অর্থানুকূল্যে চালিত এই প্রতিষ্ঠানগুলি শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকারকে বনিয়াদি স্তরে মুসলমান ছাত্রছাত্রীদের জন্যে নিশ্চিত করতে চাইছে। পিছিয়ে পড়া একটা জনজাতিকে আলোকবৃত্তে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এই শিক্ষা-আন্দোলনের ভূমিকা নতুন করে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই।
কিন্তু যখনই নতুন প্রজন্মের কাছে সামাজিক প্রতিনিধি হিসাবে উঠে আসেন ধর্মের নামে ভোট চাওয়া রাজনীতিকরা, তখন তার পরিণতি কী হয়? উচ্চশিক্ষার পরে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আসবে ঠিকই। সামাজিক প্রতিষ্ঠাও আসতে বাধ্য। কিন্তু এক জন মুসলমান তরুণ বা তরুণীর মনে যদি প্রতিবেশীর প্রতি বিদ্বেষের বীজ বোনা হয়, তবে সেই শিক্ষা কোন কাজের? নীতিগত এই প্রশ্নের বাইরেও একই সঙ্গে আরও একটি কথা এখানে মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন— মুসলমানদের জন্যে সংরক্ষিত এই অবাণিজ্যিক এবং বেসরকারি মিশনগুলো বরাবরই উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের আক্রমণের লক্ষ্য। জয়েন্ট এন্ট্রান্সের মতো পরীক্ষাগুলিতে চোখ ধাঁধানো সাফল্যের কারণ হিসাবে কনস্পিরেসি থিয়োরির উদ্ভাবন করা হয়েছে একাধিক বার। তাই শিক্ষিত মুসলমানদের নতুন প্রজন্মের মননে আব্বাস সিদ্দিকীর মতো মানুষজন উপনিবেশ গেড়ে বসলে আবাসিক এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ দারুণ কঠিন হয়ে পড়বে সর্ব স্তরেই।
আইএসএফ-এর বাড়বাড়ন্ত বিজেপির মেরুকরণের রাজনীতির পথকে মসৃণ করে তুলবে। ধর্মের দোহাই দিয়ে রাজনৈতিক সুবিধা আদায় নয়, যদি এগোতেই হয়, তবে লেখাপড়া শেখাটা মুসলমান বা যে কোনও পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত। বর্তমানের ‘ভাইজান’ রাজনীতি সে পথ ধরে হাঁটছে কি?