—প্রতীকী চিত্র।
সারা পৃথিবীতেই বস্তুবাদী বা ভোগবাদী জীবনদর্শনের আধিপত্য এখন। মানুষ পেতে ভালবাসেন। মানুষের প্রয়োজন মেটাবে সরকার, এটাই স্বাভাবিক। গণতন্ত্রের এটাই মূল কথা— সংখ্যাগরিষ্ঠ যা চাইছে তাদের সেটা পাইয়ে দেওয়া, যাতে ঠিকঠাক ভোট পেয়ে ক্ষমতায় থেকে যাওয়া যায়। এই ধরনের পরিকল্পনায় আদর্শের ভূমিকা তেমন ভাবে বোঝা যায় না। অথবা, এটাকেই গণতান্ত্রিক রাজনীতির আদর্শ বলে ভেবে নেওয়া যেতে পারে— মানুষ যে কাজকে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিতে কল্যাণকর বলে ভাবছেন, শুধু তাতেই মনোনিবেশ করা।
সংখ্যালঘুদের উপর সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্য, বা সংবাদমাধ্যমের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করা নিয়ে সাম্প্রতিক কালে ভারতে দীর্ঘ ও উত্তপ্ত আলোচনা হয়েছে। অসাম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক ভারতের সংবিধানকে সম্মান জানালে যে কোনও নাগরিকই এই দুই সাংবিধানিক আদর্শের খেলাপ নিয়ে আপত্তি করবেন। প্রশ্ন হল, সম্প্রতি তিন রাজ্যের বিধানসভায় যে ভোটাররা বিজেপি-কে ক্ষমতায় নিয়ে এলেন বা ক্ষমতায় রেখে দিলেন, তাঁরা কি তবে এই সাংবিধানিক আদর্শের খেলাপকে তেমন গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন না? না কি,
বিজেপিকে ভোট দিলে বস্তুগত ভাবে যা পাওয়া যাবে বলে মানুষ মনে করছেন, তার গুরুত্ব মতাদর্শের চেয়ে বেশি?
কেন্দ্রে হিন্দুত্ববাদী সরকার যখন মুসলমানদের তিন তালাক প্রথা বিলোপ করে, অন্য দিকে রান্নাঘরে গ্যাসের ব্যবস্থা করে, তখন অনেক সংখ্যালঘু মহিলা উত্তরপ্রদেশে বিজেপিকে ঢেলে ভোট দিয়েছিলেন। ঘটনা হল, তথাকথিত অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলি তাদের শাসনকালে এই কাজগুলো করতে পারেনি। কাশ্মীরে ৩৭০ ধারার বিলোপও বিরোধীপক্ষের অনেকের তেমন নিন্দে কুড়োয়নি। আদর্শগত কারণের পরিপ্রেক্ষিতে এই দু’টি পদক্ষেপ রাজনৈতিক সমর্থন জোগাতে সাহায্য করেছিল। রাজনীতি ভোটের জন্য সময় বুঝে আদর্শ অনুসরণ করে থাকে, এ কথা সত্য হলেও অনেকেই দু’টি পদক্ষেপ সমর্থন করেছিলেন বলে আমার ধারণা। অর্থাৎ, আদর্শের লালন-পালন তখনই সম্ভব, যখন সেটা ভোটের রাজনীতির সাফল্য সুনিশ্চিত করে। যে আদর্শ তা করে না, তার মৃত্যু অনিবার্য।
আদর্শের মৃত্যু তখনই হয়, যখন যাঁরা আদর্শটিকে সম্মান করেন, তাঁরাও নিজেদের ভোট এমন কাউকে দেন যিনি আদর্শটিকে সম্মান করেন না। হিন্দুত্বের প্রবক্তা সরকার যদি মুসলমান মহিলাদের উপকার করে, তার সুফল সে দলের রাজনীতি পাবেই। একটি সম্প্রদায়কে অসুবিধায় ফেলে, সম্প্রদায়ের ভিতরের নিপীড়িত গোষ্ঠীর উপকার করলে তা সাম্প্রদায়িকতাকে ইন্ধন জোগালেও সেই নিপীড়িত গোষ্ঠীর সমর্থন পাবে। কোনও কোনও আদর্শের মৃত্যুতে মানুষ গা করেন না— আর এখানেই বস্তুবাদী মানুষের সিদ্ধান্ত এ দেশের রাজনীতিতে আদর্শের মৃত্যুর জন্য খানিকটা দায়ী।
মানুষের কাছে নিজের অর্থনৈতিক লাভক্ষতিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ধীরে ধীরে এ দেশের বিভিন্ন সরকার এটা বুঝতে পেরেছে যে, প্রকল্পনিবিড় উন্নয়ননীতি— বিশেষ করে প্রত্যক্ষ অর্থসাহায্য বা সুনির্দিষ্ট আর্থিক উপযোগিতাসম্পন্ন কোনও প্রকল্প— মানুষের পছন্দ, এবং তা হলেই মানুষ ভোট দেবেন। বস্তুনিরপেক্ষ আদর্শ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে না। টিকছেও না। তা হলে কি রাজনীতিতে আদর্শের কোনও স্থান নেই?
আমাদের যা সত্যি বলে ভাবতে ভাল লাগে, সেটা অনেক সময় আমাদের কাছে আদর্শের চেহারা নেয়; যখন কেউ সেটাকেই সত্যি বলে যুক্তি সাজায়, তখন আমাদের ভাল লাগে, আমরা তাদের সমর্থন করি। পুষ্পক রথ আসলে রকেট আর মার্ক্সবাদ সর্বশক্তিমান কারণ তা সত্য— দুটোই ওই ধরনের ‘সত্যি’ কথা। যদি এক সঙ্গে অনেক লোক ভাবেন যে, সমুদ্রমন্থনের পর অমৃতের যে চার বিন্দু পৃথিবীতে পড়েছিল, তার দুই বিন্দু প্রয়াগরাজে (ইলাহাবাদ) পড়েছিল, তাই প্রয়াগরাজ যে সে জায়গা নয়— রাজনীতি এই বিশ্বাসটিতে জলসিঞ্চন করে চলবে। মানুষের উপকারকল্পে এবং যথার্থ উন্নয়নকল্পে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প তৈরি করা, এবং যে বিশ্বাস আমূল প্রোথিত তাকে আরও মজবুত করে মানুষের ভাল লাগাকে সঞ্জীবিত রাখা, দুটোই রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ।
দেশ হিসাবে আমরা কতখানি উন্নত ও আদর্শ, অনেকের কাছেই তা মাপার মাপকাঠি হল, দুনিয়ার শক্তিমান দেশগুলি আমাদের শক্তিমান ভাবছে কি না। আদর্শ দেশ হল সেটাই, যাকে সবাই ভয় পাবে। তা হলে সেই আদর্শকেই রাজনীতি সম্মান জানাবে এবং জানানোর পদ্ধতি হল মানুষ যাকে শক্তি আখ্যা দেয়, সেই শক্তি প্রদর্শন। ফলে আন্তর্জাতিক সহমর্মিতার আদর্শ পিছনের দরজা দিয়ে পালানোর পথ পাবে না। বস্তুবাদী মানুষের কাছে আদর্শ দেশ সেটাই, যার জাতীয় আয় সবচেয়ে বেশি। অন্যান্য উচ্চবিত্ত দেশ সে-সব নিয়ে আলোচনা করে, ফলে সেই আদর্শই রাজনীতির আদর্শ হিসাবে গণ্য হবে, মাথাপিছু আয় নয়। ফলে বণ্টন ব্যবস্থার সমস্যা, বৈষম্য ইত্যাদি আলোচ্য হিসাবে গুরুত্বহীন হবে। সর্বোপরি ভাল খারাপ সমস্ত আদর্শকে পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি দুরমুশ করে দেবে। এটা মনে করা ভুল যে, যাঁদের অ্যাকাউন্টে সরকারি আর্থিক সাহায্য জমা পড়ে তাঁরা সঠিক আদর্শের কথা চিন্তা করেন না। কিন্তু বস্তুবাদী মানুষ লাভক্ষতির হিসাব করেই ভোটটা দেন।