প্রতিবাদ: কেন্দ্রীয় বঞ্চনার বিরুদ্ধে রাজঘাটে ধর্নায় বসেছেন তৃণমূল কংগ্রেস নেতারা। ২ অক্টোবর, ২০২৩। ছবি: পিটিআই।
গত কয়েক মাস ধরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বার বার প্রতিবাদ করেছেন, তাঁর নেতাদের দিল্লি পাঠিয়ে আন্দোলন করেছেন, এবং জনসভায় সোজাসাপটা ভাবে মানুষকে জানিয়েছেন যে, তাঁর সরকার এবং পশ্চিমবঙ্গের জনগণ কেন্দ্রের বঞ্চনার শিকার। মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর দল বলেছেন যে, বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্প এবং প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার খাতে প্রাপ্য টাকা দিচ্ছে না, ফলে তাঁর সরকার এই দু’টি প্রকল্পের উপভোক্তাদের বকেয়া টাকা দিতে পারছে না। ওঁদের দাবি, কেন্দ্র পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে বঞ্চিত করছে।
কর্মসংস্থান যোজনা এবং আবাস প্রকল্প, দু’টিই ‘সেন্ট্রালি স্পনসর্ড স্কিম’। এগুলির পরিচালনা কতকগুলি আইন মেনে করতে হয়। যেমন, কর্মসংস্থান প্রকল্প মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান গ্যারান্টি আইন ২০০৫-এর আওতায় আসে। এই আইনের ২৭ নম্বর ধারা অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় সরকার এই প্রকল্পের কোনও টাকা নয়ছয়ের তথ্য পেলে শুধু টাকা না-দেওয়ার আদেশই দেবে না, নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সেই ভুলত্রুটি সংশোধনের জন্য পদক্ষেপ করবে। সংবাদে প্রকাশ, ২০১৯ সাল থেকেই কেন্দ্র অন্তত তিন বার বিভিন্ন তদন্তকারী দল পাঠিয়ে সরেজমিনে প্রকল্পগুলির পরিচালনা যাচাই করেছিল। এ ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গ সরকার জনগণকে তো দূরের কথা, এমনকি বিধানসভাতেও পরিষ্কার করে কিছু বলেনি। ২০২১-এর ডিসেম্বর থেকে যখন কেন্দ্র এই দুই প্রকল্পের খাতে পশ্চিমবঙ্গকে টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেয়, তখন থেকে তৃণমূল সরকারের প্রতিবাদ উগ্রতর হয়। কিন্তু, ষড়যন্ত্রের অভিযোগ ছাড়া সেই প্রতিবাদে আর কিছু বোঝা যায়নি।
ভারতের কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) কেন্দ্রের এবং রাজ্যগুলির হিসাবনিকাশ অডিট করেন এবং ভুলত্রুটি দেখিয়ে দেন। আশা করেছিলাম যে, পশ্চিমবঙ্গের সিএজি রিপোর্টটি রাজ্য সরকার জনসমক্ষে আনার পর স্পষ্ট হবে যে, আমাদের রাজ্যের বিরুদ্ধে সত্যিই প্রাপ্য টাকা না-দেওয়ার ষড়যন্ত্র হয়েছে, না কি কোনও হিসাবনিকাশে ভুলভ্রান্তির কারণে টাকা আসা বন্ধ হয়েছে। কিন্তু তা হল না। ২০২২ সালে প্রাপ্ত স্টেট’স ফাইনান্স অডিট রিপোর্ট ফর ২০২০-২১’এ সিএজি জানাল যে, রাজ্য সরকার ২০০২-০৩ থেকে ২০২০-২১ পর্যন্ত দু’লক্ষ ঊনত্রিশ হাজার কোটি টাকার ব্যবহার-শংসাপত্র দিতে দেরি করেছে। মুখ্যমন্ত্রী ২ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রীকে একটি চিঠি লিখে জানালেন, সিএজি-র অভিযোগ অসত্য, এবং রাজ্য সরকার সময়মতো, ঠিক ভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের সব মন্ত্রককে সব ব্যবহার-শংসাপত্র দিয়েছে। সিএজি যথাযথ ভাবে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ না করেই অভিযোগ এনেছে। ওই একই দিনে, মুখ্যমন্ত্রী কলকাতায় ধর্নায় বসলেন এবং অভিযোগ করলেন যে, সিএজি রিপোর্টটি ভুল তথ্যের ভিত্তিতে বিজেপি দ্বারা লিখিত। সাধারণ মানুষের মনে সংশয় তৈরি হওয়া স্বাভাবিক যে, তা হলে কার কথা ঠিক— সিএজি রিপোর্টের, না কি মুখ্যমন্ত্রীর?
কয়েকটা প্রশ্ন করা যাক। প্রথমত, রাজ্যের তৃণমূল সরকারের অডিট সম্বন্ধে গভীর অনীহা কেন? সিএজি-র রিপোর্ট অনেক দেরিতে আসছে। রিপোর্ট আসার পর, সেটিকে এবং তার সঙ্গে তার উপরে পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির (পিএসি) রিপোর্টটিকে বিধানসভায় পেশ করতে অনেক দেরি হচ্ছে কেন? বিধানসভায় পেশ করার পরই সিএজি-র রিপোর্ট জনসমক্ষে আসে। দেরির জন্য সিএজি-র রিপোর্ট যখন বিধায়করা এবং জনগণ পান তখন সেটি খবরযোগ্য থাকে না, শুধু ইতিহাসের গবেষকদের কাজে লাগে। সেই রিপোর্টে থাকা বেনিয়মগুলি জনসমক্ষে এলে তাকে সংশোধন করতে হবে, নিয়মকানুনের অধীন হতে হবে— তাকে এড়ানোর জন্যই কি এই গোপনীয়তা?
দ্বিতীয়ত, অপ্রিয় সত্য না জানলে এবং না জানালে সাময়িক— বিশেষত ভোটে জেতার জন্য— লাভ হয় বইকি, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির ঝুঁকি অনেক। এই মন্ত্র সিএজি-র অডিট সম্বন্ধে সমান ভাবে প্রযোজ্য। যেমন, সিএজি রিপোর্টে যথাসময়ে ব্যবহার-শংসাপত্র না জমা দেওয়া সম্বন্ধে সিএজি এবং মুখ্যমন্ত্রীর যে অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগ, তার কথাই ধরুন। খসড়া অবস্থায় সিএজি-র রিপোর্ট রাজ্য সরকারের কাছে আসে, রাজ্য সরকারের মন্তব্যের জন্য। যে ‘ভুল’ মাত্র কয়েকদিন আগে মুখ্যমন্ত্রী দেখিয়ে দিয়েছেন, যখন খসড়া রিপোর্টটি এসেছিল, তখনই সেই ‘ভুল’ দেখিয়ে দেওয়া এবং শুধরানো যেত। সেটি করা হয়েছিল কি? পিএসি আমলাদের জিজ্ঞাসা করেছিল কি যে, আমলারা সেই কাজ করেছেন কি না? এই ‘ভুল’ দেখানোর পরও যদি সিএজি রিপোর্টে ভুল থেকে যেত, তবে বিধানসভায় সিএজি রিপোর্ট আলোচনার সময় এ সম্বন্ধে প্রস্তাব পেশ করা যেতে পারত। আজকের পরিস্থিতিটি এড়ানোর পথ ছিল, রাজ্য সরকার সে পথে হাঁটেনি।
তৃতীয়ত, সিএজি রিপোর্টে যথাসময়ে ব্যবহার-শংসাপত্র জমা না দেওয়ার সমস্যা নতুন নয়, তা ২০০২ সাল থেকে চলছে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর প্রধানমন্ত্রীকে লেখা চিঠি অনুযায়ী রাজ্য সরকার সব ব্যবহার-শংসাপত্র ঠিক সময়মতো, ঠিক ফরম্যাটে কেন্দ্র সরকারের সব মন্ত্রককে দিয়েছে। গত দীর্ঘ বিশ বছরের মধ্যে কী করে বিস্ময়জনক ভাবে এই সমস্যা সম্বন্ধে রাজ্য সরকার এবং সিএজি-র আপাতবিরোধী উপলব্ধি ২০২৪ সালেই উদ্ঘাটিত হল? চতুর্থত, রিপোর্টে সিএজি শুধু যথাসময়ে ব্যবহার-শংসাপত্র জমা না দেওয়ার সমস্যার কথা লেখেনি, লিখেছে যে, বিলম্বিত ব্যবহার-শংসাপত্রের সংখ্যা ২০১৬-১৭ সালে ১৭,৪৮৫ থেকে সাড়ে তিন গুণ বেড়ে ২০২০-২১ সালে ৬১,১৯৬ হয়েছে। সবই ভূতের গল্প?
প্রশ্ন আর বাড়িয়ে লাভ নেই। তবে একটি কথা না বললে নয়। সিএজি-র রিপোর্টটি বিগত দু’বছর ধরে রাজ্য সরকারের কাছে ছিল। কেন্দ্রীয় সরকার কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্প ও আবাস যোজনার টাকা ২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে বন্ধ করেছে। আশ্চর্যের বিষয় যে, বিলম্বিত ব্যবহার-শংসাপত্রের ‘কল্পিত’ সমস্যা সম্বন্ধে রাজ্য সরকার কেমন যেন হঠাৎ জেগে উঠেছে! কেন?
যে কোনও সরকার যখন আর্থিক সঙ্কটের সম্মুখীন হয়, তখন তাদের প্রতিক্রিয়ার এক অদ্ভুত সামঞ্জস্য রয়েছে। প্রথম, সরাসরি অস্বীকার। তার পর ‘সৃজনশীল অ্যাকাউন্টিং’ এবং পাওনা মেটাতে বিলম্ব। এবং শেষে সমস্যাটি কোনও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির— তেলের দাম বৃদ্ধি বা কোথাও যুদ্ধ বা কোনও শত্রু দেশের ষড়যন্ত্রের উপরে চাপিয়ে দেয়। নিন্দুকে বলতে পারেন, মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীও এর ব্যতিক্রম হননি। শুধু, উনি শত্রু দেশের জায়গায় কেন্দ্রীয় সরকার আর সিএজি-কে তাক করেছেন।
ভারতীয় গণতন্ত্রের দুই স্তম্ভ নিয়ে এই টানাপড়েন এক করুণ এবং চিন্তাজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। সিএজি-র কি মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগ পরীক্ষা করার জন্য এবং আমলারা তাঁকে বিভ্রান্তিকর পরামর্শ দিয়েছেন কি না তা যাচাই করে দেখার জন্য একটি বিশেষ টাস্ক ফোর্স গঠন করা উচিত? তৃণমূল সরকারের কি বিধানসভায় এই বিভ্রান্তিকর অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগ সম্বন্ধে একটি শ্বেতপত্র পেশ করার সময় এসে গিয়েছে?