—ফাইল চিত্র।
অল্প সময়ের ব্যবধানে পর পর তিন ‘অগ্নিবীর’ সেনার অস্বাভাবিক মৃত্যুতে ফের গোটা অগ্নিপথ প্রকল্প নিয়েই প্রশ্ন উঠে গেল। ওই তিন জনের মধ্যে রয়েছেন এক জন তরুণীও। ২৭ নভেম্বর মুম্বইয়ে কুড়ি বছর বয়সি অপর্ণা ভি নায়ারের ঝুলন্ত দেহ পাওয়া গেল তাঁর হস্টেলের ঘরে। কেরলের মেয়ে অপর্ণার নৌবাহিনীতে যোগদানের জন্য ট্রেনিং চলছিল। নৌবাহিনীর তরফে তাঁর মৃত্যু নিয়ে তদন্তের আদেশ দেওয়া হয়েছে। আত্মহত্যা হিসাবেই দেখা হচ্ছে এই মৃত্যুকে, যদিও কোনও ‘সুইসাইড নোট’ মেলেনি। ১০ অক্টোবর জম্মুর রাজৌরি সেক্টরে মারা যান পঞ্জাবের অমৃতপাল সিংহ (২১)। ট্রেনিং শেষ করে মাত্র এক মাস আগে কাজে যোগ দিয়েছিলেন অমৃতপাল। ২১ অক্টোবর সিয়াচেনে কর্মরত অবস্থায় প্রাণ হারান মহারাষ্ট্রের গাওয়াতে লক্ষ্মণ অক্ষয় (২২)। এই মৃত্যুগুলি প্রতিরক্ষা প্রশাসনকেই প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
২০২২ সালে যুব সমাজের বিরোধিতার মধ্যেই চার বছরের মেয়াদে তরুণদের সেনাবাহিনীতে নেওয়া শুরু করে কেন্দ্রীয় সরকার। প্রতি বছর তিন বাহিনীতে ছেচল্লিশ হাজার যুবককে নেওয়া হবে, সাড়ে সতেরো বছর থেকে তেইশ বছর পর্যন্ত তাঁদের বয়স। এঁদেরই পোশাকি নাম ‘অগ্নিবীর’। চুক্তি শেষে প্রত্যেক বছর নিযুক্ত অগ্নিবীরদের মধ্যে থেকে পঁচিশ শতাংশকে সেনাবাহিনীর স্থায়ী পদে নেওয়া হবে। বাকিদের হাতে এককালীন কিছু টাকা দিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হবে সমাজ জীবনে। অফিসার ছাড়া সেনাবাহিনীতে সাধারণ সেনা হিসাবে আর কোনও নিয়োগ হবে না। অগ্নিবীরই একমাত্র নিয়োগ পথ।
এই প্রকল্পের প্রধান কারণ ছিল পেনশন এবং গ্র্যাচুইটি খাতে খরচ কমানো— মাত্র চার বছর কাজ করে অবসর নিলে সে সব প্রাপ্য দেওয়ার প্রশ্ন উঠবে না। এ ভাবে সেনাবাহিনীর কাজকে চুক্তিভিত্তিক এবং অস্থায়ী করার জন্য ২০২২ সালে প্রবল প্রতিবাদ হয়েছিল। সরকারি তরফে দুটো যুক্তি ছিল। প্রথমত, অবসরকালীন সুযোগসুবিধা খাতে খরচ কমানো। দ্বিতীয়ত, বাহিনীতে তারুণ্য নিয়ে আসা। ইতিমধ্যেই দুই দফায় ৪০ হাজার অগ্নিবীর নিয়োগ করা হয়েছে।
কিন্তু এই তরুণ সেনাদের প্রতি এই ব্যবস্থা কতটা ন্যায্য? ছ’মাসের প্রশিক্ষণে তরুণরা কতখানি প্রশিক্ষিত হচ্ছেন কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে? অমৃতপাল মারা যাওয়ার পরে সেনাবাহিনী থেকে জানানো হয়, ওই তরুণ আত্মহত্যা করেছেন। নিজের বন্দুক থেকে তিনি নিজের কানের পাশে গুলি করেছিলেন। সেনাবাহিনী ওই যুবককে ‘গার্ড অব অনার’ না দেওয়ায়, ক্ষতিপূরণের টাকা না দেওয়ায় প্রবল প্রতিবাদ ওঠে পঞ্জাবে। এমনকি সেনাবাহিনীর অ্যাম্বুল্যান্সে তাঁর মৃতদেহ পাঠানো হয়নি, পাঠানো হয় ভাড়া করা অ্যাম্বুল্যান্সে। সেনাবাহিনী থেকে বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়, আত্মহত্যা করার জন্যই অমৃতলাল গার্ড অব অনার, বা ক্ষতিপূরণ পাবেন না। তাতে ক্ষোভ আরও তীব্র হয়, অকালি দল অগ্নিপথ প্রকল্প বাতিলের দাবিতে সরব হয়। সমস্ত অগ্নিবীরকেই স্থায়ী সেনা হিসাবে নিয়োগপত্র দেওয়ার দাবি ওঠে। শেষ পর্যন্ত পঞ্জাব সরকার এক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে বিক্ষোভ চাপা দেয়।
এই ঘটনার আঁচ না নিবতেই সিয়াচেনে মৃত্যু হয় গাওয়াতে লক্ষ্মণ অজয়ের। সেনাবাহিনী জানায়, সিয়াচেনের উচ্চতায় এবং প্রবল ঠান্ডায় ওই যুবক অসুস্থ হয়ে মারা গিয়েছেন। ক্ষতিপূরণ, গার্ড অব অনারও দেওয়া হয়। এর পরেই নভেম্বরে মৃত্যু হল নৌবাহিনীর তরুণী অগ্নিবীরের। আত্মহত্যা প্রমাণ হলে তাঁর পরিবার পাবে না কোনও ক্ষতিপূরণ।
এই তিন মৃত্যু বহু প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসে, বিশেষত সিয়াচেন বা রাজৌরির মতো কঠিন জায়গায় অগ্নিবীরদের নিয়োগ নিয়ে। এই সব জায়গায় পোস্টিং-এর জন্য যে ধরনের প্রশিক্ষণ ও শারীরিক-মানসিক প্রস্তুতি প্রয়োজন হয়, মাত্র ছ’মাসের ট্রেনিংয়ে তা অর্জন অসম্ভব। সেনাকর্তাদের ভালই জানা আছে যে, সিয়াচেনে তাপমাত্রা মাইনাস পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে যায়। ঠান্ডা ও উচ্চতার কারণে অসুস্থ হয়ে প্রতি বছরই বেশ কয়েক জন সৈনিক মারা যান। তা হলে কেন অনভিজ্ঞ অগ্নিবীরদের এ সব জায়গায় পোস্টিং দেওয়া হচ্ছে?
এই তিন মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে অগ্নিবীর প্রকল্প নিয়ে পুনরায় চিন্তাভাবনা হবে, তেমন সম্ভাবনা অবশ্য সেনাবাহিনী এবং কেন্দ্রীয় সরকার সরাসরি খারিজ করে দিয়েছে। কেবল নিয়োগের সময় প্রার্থীদের ‘মানসিক শক্তি’ পরীক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছে। সে জন্য প্রত্যেক প্রার্থীর ‘সাইকোমেট্রিক টেস্ট’ করা হচ্ছে। যদিও নিয়োগের সময়ে সাইকোমেট্রিক পরীক্ষার ফলাফল সিয়াচেন, রাজৌরির মতো কঠোর পরিস্থিতিতে মানসিক ভারসাম্য কী ভাবে নিশ্চিত করবে, তা অস্পষ্ট।
কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রক অনমনীয় মনোভাব দেখালেও, অল্প সময়ের মধ্যে তিন অগ্নিবীরের মৃত্যু, এবং তাঁদের পেনশন, গ্র্যাচুইটির অধিকার থেকে বঞ্চনা নিয়ে রাহুল গান্ধীর সরব হওয়া কিছুটা চাপে ফেলেছে ভারত সরকারকে। এক দিকে সেনাবাহিনীতে কাজের ভবিষ্যৎ প্রশ্নের মুখে ‘অগ্নিবীর’-এর জন্য, অন্য দিকে অগ্নিবীর পরিকল্পনায় প্রাণ বিপন্ন হচ্ছে দেশের তরুণ-তরুণীদের। প্রশ্নগুলিকে ধামাচাপা না দিয়ে, খোলা মনে পুনরায় চিন্তা করা উচিত ভারত সরকারের। প্রতিটি জীবনই মূল্যবান, বিশেষত সে জীবন যদি অমিত সম্ভাবনাময় কোনও সদ্য-তরুণের হয়।