জয়ী: মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘিতে উপনির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পরে কংগ্রেস ও বাম সমর্থকদের উচ্ছ্বাস। ২ মার্চ। ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়।
সাগরদিঘি উপনির্বাচনের ফল রাজ্য-রাজনীতিতে স্বাভাবিক ভাবেই আলোচনার নতুন পরিসর তৈরি করেছে। তবে এটা বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন, না কি সিন্ধুতে বিন্দু, তা ঠিকমতো বুঝতে আরও কিছু দিন সময় লাগবে। অন্তত পঞ্চায়েত এবং লোকসভা ভোট পর্যন্ত।
একটি কেন্দ্রে উপনির্বাচনের ফল থেকে দ্রুত কোনও নিশ্চিত সাধারণ সিদ্ধান্তে পৌঁছনো ঠিক নয়। কারণ, বৃহত্তর রাজনীতির বাইরেও এমন অনেক বিষয় থাকে, যেগুলি হয়তো কোনও একটি কেন্দ্রে তাৎক্ষণিক প্রভাব ফেলে। হতে পারে তা প্রার্থী বাছাই কেন্দ্রিক, হতে পারে এলাকার চাওয়া-পাওয়ার, ভোট ভাগাভাগির বা অন্য কোনও কিছুর।
তথাপি হার-জিতই ভোটের অমোঘ সত্য। অতএব সাগরদিঘির এই উপনির্বাচনে হেরে তৃণমূল যে বড় ধাক্কা খেয়েছে, তাতে ভুল নেই। উপরন্তু মাত্র দু’বছর আগে পঞ্চাশ হাজারের ব্যবধানে জেতা এই আসনে এ বার তেইশ হাজার ভোটে পিছিয়ে যাওয়া প্রকৃতপক্ষে তিয়াত্তর হাজারের ব্যবধান সূচিত করে। সেই সত্যও অনস্বীকার্য।
মুর্শিদাবাদ জেলার এই কেন্দ্র সংখ্যালঘু-অধ্যুষিত। মুসলিম ৬৫ শতাংশের মতো। সিপিএম, কংগ্রেস তো বটেই, কখনও জিততে না-পারা বিজেপি পর্যন্ত এখানে এক বার সংখ্যালঘু প্রার্থী দাঁড় করিয়েছিল। একমাত্র ব্যতিক্রম তৃণমূল। সাগরদিঘিতে তারা কখনও সংখ্যালঘু প্রার্থী দেয়নি। তবে জিতেছে পর পর তিন বার। সংখ্যালঘু ভোট দীর্ঘ দিন ধরে তৃণমূলের নিজস্ব ‘আমানত’ বলে ধরা হয়। হয়তো সেটাই ছিল তাদের ‘ভরসা’র জায়গা!
এ বার ফল দেখে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই তাই জানতে চান, সংখ্যালঘুদের ভোট তাঁরা পেলেন না কেন। তাঁর খেদ, “সংখ্যালঘুদের জন্য এত কাজ করার পরেও এটা কেন হবে?” এখানে প্রয়াত বিধায়ক ছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী। বিষয়টি তাই আরও অর্থবহ।
কিন্তু অন্য আলোচনায় যাওয়ার আগে সাগরদিঘির ভোট-পরিসংখ্যানের দিকে এক ঝলক তাকানো যেতে পারে। রাজ্যের ক্ষয়িষ্ণু কংগ্রেস এখনও যে দু’-একটি জেলায় চিহ্ন রাখে, মুর্শিদাবাদ তার একটি। সেই সুবাদে সাগরদিঘিতেও তারা অস্তিত্ব বজায় রেখে চলেছে। অন্য দিকে, তৃণমূল ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার ভোট থেকে একটানা তিন বার এই বিধানসভা আসনে জিতলেও ’২১-এর ভোট ছাড়া অন্য দু’বার জয়ের ব্যবধান থেকেছে চার-পাঁচ হাজারের মধ্যে। লক্ষণীয় হল, ২০১১ এবং ২০১৬ দু’বারই দুই ‘বিক্ষুব্ধ’ প্রার্থী ‘নির্দল’ হয়ে প্রচুর ভোট কেটেছিলেন। ’১১-তে তৃণমূল এবং কংগ্রেসের জোট ছিল। সিপিএম-কে হারায় তৃণমূল। কংগ্রেসের বিক্ষুব্ধ প্রার্থী সে বার পেয়েছিলেন ২২ হাজারের বেশি ভোট। আর ’১৬-র বিধানসভায় তৃণমূলের বিক্ষুব্ধ পান ৩২ হাজার। সে বার সিপিএম ও কংগ্রেস আলাদা লড়ে উভয়েই ৩৯ হাজারের বেশি ভোট পেয়েছিল। তৃণমূলের কাছে হেরে কংগ্রেস দ্বিতীয় হয়।
২০২১-এর বিধানসভায় বিজেপির বিরুদ্ধে তৃণমূলের জয়ের ব্যবধান পঞ্চাশ হাজারে চলে গিয়েছিল ঠিকই, তার পিছনে রাজ্য জুড়ে বিজেপি-কে হারানোর একটি হাওয়া অবশ্যই বড় ভাবে কাজ করেছে। প্রকৃতপক্ষে ’২১-এর ভোট ছিল অনেকটা সরাসরি তৃণমূল বনাম বিজেপি। তৃণমূল অবশ্যই সংখ্যালঘু-প্রধান এই কেন্দ্রে তার রাজনৈতিক ‘সুফল’ পেয়েছিল।
ওই ভোটেও এখানে বাম-কংগ্রেস জোট হয়েছিল। প্রার্থী ছিল কংগ্রেসের। বিজেপি ও কংগ্রেস উভয়েই সংখ্যালঘু প্রার্থী দেয়। ’১৬-র তুলনায় বিজেপির ভোট বেড়েছিল কুড়ি শতাংশ। আর কংগ্রেসের কমেছিল চার।
কংগ্রেস ও বিজেপির গত বার প্রাপ্ত ভোট যোগ করলে আরও দেখা যায়, তৃণমূলের সঙ্গে সম্মিলিত বিরোধীদের ব্যবধান ছিল হাজার পনেরো। এর থেকে ধরে নেওয়া যেতে পারে, সাগরদিঘি একা তৃণমূলের পক্ষে খুব অনায়াস আসন নয়। বিরোধী ভোট ভাগাভাগির অঙ্কটিই আসলে গুরুত্বপূর্ণ। এমনটি বিরল বা বিচিত্র নয়। দেশের অজস্র জায়গাতেই এই ভাবে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়ে থাকে।
এ বারের উপনির্বাচনেও কংগ্রেস প্রার্থীকে সিপিএম পূর্ণ সমর্থন করেছিল। কোনও গোঁজও ছিল না। ত্রিমুখী লড়াইতে বিজেপির ভোট গত বারের তুলনায় কমে গেল প্রায় ২০ হাজার। তৃণমূলের ভোটও কমেছে ৩০ হাজার। কংগ্রেস (সঙ্গে বাম) ৫০ হাজার ভোট বাড়িয়ে জিতেছে ২৩ হাজারে।
তৃণমূল তার জয়ের ধারাবাহিকতা একেবারেই ধরে রাখতে পারল না কেন, এটা অত্যন্ত গুরুতর প্রশ্ন। বিশেষত সংখ্যালঘুদের সমর্থন পাওয়ার নিরিখে দেখলে বিষয়টির গভীর তাৎপর্য রয়েছে। এক নজরে মনে হতেই পারে, সংখ্যালঘুরা এ বার উজাড় করে ভোট দেননি বলেই তৃণমূল হারল। মমতার বক্তব্যে যার যথেষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়। সত্যিই তা হয়ে থাকলে পরিণাম সুদূরপ্রসারী হওয়ার শঙ্কা তৃণমূলের মনের মধ্যে কাজ করবে। উল্টো দিকে, পঞ্চায়েত নির্বাচনের ঠিক আগে এই ফল বিরোধীদের, সঠিক বললে বাম ও কংগ্রেসের, বাড়তি উৎসাহের কারণ হচ্ছে।
কিন্তু এর বাইরেও সাগরদিঘির ফলাফলের আর একটি সম্ভাব্য দিক আছে। যা এড়িয়ে যাওয়ার নয়। সেটি হল, নিয়োগ-দুর্নীতি। ওই দুর্নীতির বিস্তার সামনে আসার পরে রাজ্যে এটিই প্রথম বড় ভোট। কিছু কাল ধরে সবাই দেখছি, যাঁরা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে নিয়োগ-দুর্নীতির শিকার, তাঁরা এখন ঘটনাচক্রে ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে এক ছাতার তলায় এসে পড়েছেন। সেখানে সাগরদিঘির জনাদেশকে কি ‘প্রতীকী’ বলা যায়? এটা ভাবার অবকাশ একেবারে নেই, তা-ও বোধ হয় নয়।
যদিও আবার বলছি, এখনই স্থির সিদ্ধান্তে যাওয়ার সময় আসেনি। আরও দেখতে হবে। সাগরদিঘির সঠিক অন্তর্তদন্ত এবং বিশ্লেষণ হলে তবেই বোঝা যাবে, বাম-কংগ্রেস জোটের ফলে তৃণমূলের সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কে টান পড়ল, না কি শাসকের বিরুদ্ধে অন্যতর ক্ষোভের সামগ্রিক প্রতিফলন ঘটল এই উপনির্বাচনে।
সাগরদিঘির সঙ্গেই পাশের বাঙালি রাজ্য ত্রিপুরায় চরম শোচনীয় ফল তৃণমূলের আর একটি বড় আঘাত। রাজ্যের বাইরে গিয়ে এই প্রথম মেঘালয়ে পাঁচটি আসন জিতেছে মমতার দল। কিন্তু সেই আলোচনা যেন ম্লান! তার মূল কারণ ত্রিপুরায় তৃণমূলের তিন প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপি, সিপিএম, কংগ্রেস এই রাজ্যেও পুরোদস্তুর আছে। মেঘালয়ের কোনও দল বাংলায় লড়তে আসে না। সেখানকার রাজনীতি বাংলায় সে ভাবে ছাপও ফেলে না।
ফলের পরেই অবশ্য মমতা ঘোষণা করে দিয়েছেন, তৃণমূল একা লড়বে। বস্তুত, বাংলায় এটা তাঁর কোনও নতুন অবস্থান নয়। বরং, একা লড়ে তিনি তাঁর সাফল্য ও রাজনৈতিক ‘প্রাধান্য’ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন আগেই। ২০১৬ এবং ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনগুলি তার বড় প্রমাণ।
কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি একটু ভিন্ন। সেখানে মমতার ভূমিকার সঙ্গে জাতীয় রাজনীতিতে বিরোধী-জোটের সম্ভাব্য ছবিটি কিছুটা যুক্ত হয়ে পড়ে। জানি, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু হয় না। তবু একটি বিষয় মোটামুটি স্পষ্ট হচ্ছে। তা হল, অদূর ভবিষ্যতে তৃণমূলের সঙ্গে কংগ্রেসের বোঝাপড়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। জাতীয় স্তরে মমতা-সহ বিরোধীদের একটি বড় অংশ কংগ্রেসকে নেতার আসন দিতে নারাজ। তথাপি কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে বিজেপি-বিরোধী জোট কত দূর কার্যকর হতে পারে, সেটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
তবে যা-ই হোক, লোকসভা ভোটের আগে মমতা এবং কংগ্রেস দিল্লিতে গলাগলি করবে, আর বাংলায় পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াই করবে, এটা হওয়া কঠিন। বিশেষত সাগরদিঘির পরে। কারণ, সেখানে মমতার সংখ্যালঘু ভোটে ‘ভাগ’ বসিয়েছে কংগ্রেস-সিপিএম জোট!
খুব সঙ্গত কারণে তাই মমতাকে আগের মতোই ‘একলা’ চলতে হবে। এ ক্ষেত্রে তাঁর একটি বিশেষ সুবিধা, জাতীয় রাজনীতিতে তাঁর ‘বন্ধু’রা বাংলায় লড়তে আসেন না। চ্যালেঞ্জ হল, দলকে ‘বন্ধুর’ পথ পার করানো।