—প্রতীকী চিত্র।
অগস্ট ২০২২। সোভিয়েট ইউনিয়নের অতীত থেকে ভ্লাদিমির পুতিন ফিরিয়ে আনলেন ‘মাদার হিরোইন’ নামের প্রকল্পটি। যে সকল রুশ নারী দশ বা ততোধিক সন্তানের জন্ম দেবেন, তাঁরা পাবেন এই সম্মান, সঙ্গে দশ লক্ষ রুবল অর্থমূল্যের পুরস্কার। কোভিড-এর ফলে দেশের জনসংখ্যা হ্রাস পেয়েছে, সে ক্ষতি পূরণ করতে হবে। এই ঘোষণার মাত্র পাঁচ মাস আগেই রাশিয়া আক্রমণ করেছে ইউক্রেনকে। অল্প দিনেই যুদ্ধে মৃতের সংখ্যা ছাপিয়ে গিয়েছে অতিমারি-জনিত মৃত্যুকে। দেশের মায়েদের তো আর বলা যায় না যে, আপনারা সন্তান প্রসব করুন, আর সেই সন্তান আমার ভবিষ্যৎ যুদ্ধের বোড়ে হবে। বক্তব্য পেশ করতে হয় অন্য ভাষায়, অন্য মোড়কে। পুতিন তা-ই করেছেন। বলেছেন, ‘সে সব পরিবারেরই জাতীয়তাবোধ বেশি, যাদের পরিবারে সদস্য সংখ্যা বেশি’। দেশপ্রেমের প্রমাণ সব শাসকই দাবি করেন।
১৯৩৮ সালে হিটলার চালু করেছিলেন ‘মাদার’স ক্রস’। পরের বছর থেকেই শুরু হবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। হিটলার জানতেন, দীর্ঘমেয়াদে সামরিক শক্তি বজায় রাখতে প্রয়োজন ধারাবাহিক সেনার জোগান। তাই ভবিষ্যৎ জার্মান সেনার জোগান অক্ষুণ্ণ রাখতে অষ্টাদশী জার্মান মেয়েদের দেওয়া হত আদর্শ মা হয়ে ওঠার পাঠ। আদর্শ মা, মানে বহু সন্তানের জননী। বহুপ্রসবিনীরা সম্মানিতও হতেন।
তবে হিটলারও নন, জাতীয়তাবাদের আতর মাখিয়ে নিরবচ্ছিন্ন সেনা জোগানের লক্ষ্যে মেয়েদের শিশু উৎপাদন ও প্রতিপালনের যন্ত্রে পরিণত করার কৌশল আরও আগের। ১৭৫৬ সাল। লন্ডন ফাউন্ডলিং হাসপাতালের গভর্নর ছিলেন জন হ্যানওয়ে। তিনি বুঝেছিলেন যে, সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শক্তির ভিত্তি মজবুত করতে নিরবচ্ছিন্ন সেনা জোগান প্রয়োজন। অতএব, মেয়েদের মধ্যে মাতৃত্বকে এমন ভাবে গৌরবান্বিত করতে হবে, যাতে তাঁরা স্বেচ্ছায় বহুপ্রসবিনী হন। পাশাপাশি, অনাথ শিশুদেরও যদি মাতৃস্নেহে বড় করা যায়, তা হলে তারাও রাষ্ট্রের পদাতিক হবে। এই লক্ষ্যে, হ্যানওয়ে গোটা লন্ডন জুড়ে দিনমজুরিরও অর্ধেক মজুরিতে সারোগেট মাদার ও আয়া নিয়োগ করলেন। কিন্তু তাতেও যা খরচ হচ্ছিল, তাতে কোষাগার সামলানো মুশকিল হল। ফলে, প্রচার শুরু হল যে, মাতৃত্ব কেবল একটি পবিত্র ও গৌরবান্বিত কাজই নয়, জাতীয়তাবাদী কর্তব্যও বটে। তাই যে মহিলারা সন্তানলালনের এই গুরুদায়িত্ব পালন করবেন, তাঁদের দেশপ্রেম প্রশ্নাতীত। এই প্রচারে অভূতপূর্ব সাড়া মিলল। জাতীয়তাবাদের লক্ষ্যে দলে দলে মহিলারা সম্পূর্ণ বিনা মজুরিতে অনাথ শিশু প্রতিপালনের মাধ্যমে, মাতৃত্বের মহান ব্রতে ব্রতী হলেন।
অর্থাৎ, রাষ্ট্রযন্ত্র নিজের রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য জাতীয়তাবাদের মোড়কে মেয়েদের বহুমাতৃত্বের সুপারিশ করেছে বারে বারে। যার মূল্য মেয়েরা চুকিয়েছেন নিজেদের স্বাস্থ্য, জীবন ও স্বাধীনতা দিয়ে। প্রথমেই আসি মেয়েদের স্বাস্থ্যের প্রসঙ্গে। ‘টোটাল ফার্টিলিটি রেট’ অর্থাৎ এক জন নারীর জীবনকালে গড় সন্তানধারণের সংখ্যা, মহিলাদের স্বাস্থ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক। এক দিকে যেমন সন্তানধারণের সঙ্গে মেয়েদের পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের বিষয়টি ওতপ্রোত ভাবে জড়িত এবং সুস্থ সন্তানধারণের জন্যে মায়ের শরীরে পর্যাপ্ত পুষ্টির প্রয়োজন, তেমনই বহুমাতৃত্ব অনেক সময়েই গর্ভপাত, গর্ভাবস্থাজনিত রক্তক্ষরণ, সময়ের আগে শিশু প্রসবের প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়।
দ্বিতীয়ত, মায়ের স্বাস্থ্যের কারণেই দু’টি সন্তান প্রসবের মধ্যে অন্তত দুই থেকে তিন বছরের ব্যবধান থাকা বাঞ্ছনীয়। সাত, আট বা দশ সন্তানের জননী হতে গেলে মায়ের শরীরকে যে ধারাবাহিক পুষ্টি, যত্ন ও প্রশিক্ষিত চিকিৎসকের তত্ত্বাবধান পেতে হবে, পৃথিবীর অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের বেশির ভাগ মা, এমনকি উন্নত দেশগুলিরও সকল মা সেই সুযোগ পান না। অন্য দিকে, দু’টি সন্তানের জন্মের মধ্যে যদি দুই থেকে তিন বছর ব্যবধান রাখতে হয়, তা হলেই সন্তানধারণ করতে করতে মেয়েদের শুধু গোটা যৌবন নয়, প্রায় গোটা জীবনই অতিবাহিত করতে হয়। এর পর আছে সন্তান প্রতিপালনের জন্যে প্রয়োজনীয় সময়, যা মূলত বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই বর্তায় মায়ের উপরেই। এ সব পেরিয়ে, মহিলাদের শ্রমের বাজারে যোগদান, ব্যক্তিগত উৎকর্ষ বা বেঁচে থাকার জন্যে প্রয়োজনীয় ন্যূনতম শখ-আহ্লাদ, কিছুরই কি আর অবকাশ থাকে?
বৃহৎ পরিবার প্রতিপালনের জন্যে যথার্থ অর্থ সংস্থানের প্রয়োজন। তা না হলে পরিবারের মহিলারাই সর্বপ্রথম অপর্যাপ্ত জোগানের বিষম বণ্টনের শিকার হন। গবেষণা বলছে, যখনই পরিবারের প্রয়োজনীয় সম্পদের ঘাটতি দেখা দেয়, তখনই পরিবারের মহিলারা বঞ্চনার শিকার হন। এক দিকে যেমন তাদের পুষ্টি, স্বাস্থ্য বা শিক্ষার মতো বিষয়গুলিতে টান পড়ে, তেমনই বাড়ে বিনি পয়সার শ্রম ও গার্হস্থ হিংসার পরিমাণ। বিশ্বের বহু দেশই এখনও পর্যন্ত শিশুর সার্বিক সুরক্ষা ও উন্নয়নের জন্যে পর্যাপ্ত পরিষেবা দিতে সক্ষম নয়। ফলে, সন্তানের দায়ভার বর্তায় পরিবার, বিশেষ করে মায়ের উপরেই। সন্তান প্রতিপালন বিশ্বের বহু দেশেই আজও মায়েদেরই পূর্ণ সময়ের কাজ।
মাতৃত্বের কোনও গৌরবগাথাই এই বাস্তব সমস্যাগুলিকে মুছতে পারে না। ফলে, ‘বীরমাতৃকা’ হয়ে ওঠার টোপেই হোক বা কোনও জাতিগোষ্ঠীকে কাল্পনিক কোনও ‘খতরা’ থেকে উদ্ধার করার মহান দায়িত্ববহনের চাপিয়ে দেওয়া দায়েই হোক, রাষ্ট্র নারীকে কেবলমাত্র সন্তানধারণের যন্ত্র হিসাবে দেখছে কি না, সে প্রশ্ন থেকে নজর ফেরানোর কোনও উপায় উদারবাদী সমাজের নেই।