—প্রতীকী চিত্র।
মাস ঘুরতে চলল, ভারত-কানাডা সম্পর্ক এখনও স্বাভাবিক হল না। ভারত কানাডার ভিসা দেওয়া বন্ধ করে রেখেছে, সে দেশে না যেতে পরামর্শ দিচ্ছে। ফলে বিপাকে পড়েছেন ছাত্রছাত্রী, পর্যটকরা। দু’তরফই বলছে, এই পরিস্থিতি সাময়িক। কিন্তু কবে এর নিরসন হবে, স্পষ্ট নয়।
বেশ কিছু দিন ধরেই ভারত-কানাডার সম্পর্কের মধ্যে যে চাপা ক্ষোভ ছিল, সেটা জনসমক্ষে এসে দাঁড়াল ১৮ সেপ্টেম্বর। প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো কানাডার পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বললেন যে, কানাডার এক নাগরিককে কানাডার মধ্যেই হত্যার সঙ্গে ভারত সরকার জড়িত। ভারত তৎক্ষণাৎ অভিযোগ অস্বীকার করে। ভারতের দাবি, নিহত হরদীপ সিংহ নিজ্জর এক জন সন্ত্রাসবাদী, পঞ্জাবে খুনের দায়ে পলাতক। তিনি জাল পাসপোর্ট নিয়ে ভারত থেকে কানাডায় ঢুকেছিলেন, এবং তাঁর বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড কর্নার নোটিস থাকা সত্ত্বেও কানাডা তাঁকে নাগরিকত্ব দিয়েছিল। ভারতের পাল্টা অভিযোগ, কানাডা ক্রমেই সন্ত্রাসবাদীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠছে।
ইতিমধ্যেই কানাডা ও ভারত, দুই দেশে অবস্থিত দূতাবাস থেকে একে অন্যের গোয়েন্দা অফিসারকে ফিরে যেতে বাধ্য করেছে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা আপাতত বন্ধ। ভারত কানাডার নাগরিকদের ভিসা দেওয়া বন্ধ রেখেছে। ভারতে কানাডার দূতাবাসে কর্মরত বাষট্টি জন কূটনীতিকের মধ্যে একচল্লিশ জনকেই ফিরে যেতে বাধ্য করেছে।
মহা অস্বস্তিতে পড়েছে আমেরিকা। কানাডা আমেরিকার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, এবং বিশ্বে আমেরিকার রণনীতিতে অপরিহার্য সঙ্গী। আবার, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এশিয়ায় চিনের আগ্রাসী পদক্ষেপ ঠেকাতে ইতিমধ্যেই ভারতকে আমেরিকার রণনীতির ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসাবে গ্রহণ করেছেন। মনে রাখতে হবে, আমেরিকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান, এই দু’পক্ষে বিভক্ত হলেও, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর করার লক্ষ্যকে এই দুই যুযুধান শিবিরই স্বীকার করে। এমন ঐকমত্য সচরাচর হয় না। তবু লক্ষণীয়, আমেরিকার গোয়েন্দা দফতরই কানাডা সরকারকে নিজ্জর হত্যার ঘটনায় ভারতের ‘সংযোগ’ স্থাপনে সাহায্য করেছিল।
এখন ভারত-কানাডা সম্পর্কের মধ্যে উত্তেজনা কমানোর প্রয়াস শুরু হয়েছে সন্তর্পণে। তবে, কানাডার প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোর তাতে সমস্যা মিটছে না। তিনি এখনও পর্যন্ত ভারতের বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ হাজির করতে পারেননি। সম্ভবত তার কারণ, কানাডা সরকার সে দেশে কর্মরত ভারতীয় কূটনীতিকদের মধ্যে ফোনে কথাবার্তা আড়ি পেতে শোনে, যা ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী নিষিদ্ধ। সে ভাবে সংগৃহীত তথ্যই যদি ট্রুডোর অভিযোগের ভিত্তি হয়, তা হলে ভারতের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণিত হবে কি না, সন্দেহ থাকে।
অভিযোগ, দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমস্যার বাধ্যবাধকতার কারণেই ট্রুডো এমন নজিরবিহীন ভাবে ভারতের দিকে আঙুল তুলছেন। তাঁর সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য পার্লামেন্টে খলিস্তানি গোষ্ঠীর সদস্যদের সমর্থনের উপর একান্ত নির্ভরশীল। মনে রাখতে হবে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর বাবা পিয়ের ট্রুডো যখন ১৯৮০-র দশকে কানাডার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখনই খলিস্তানি সন্ত্রাস নিয়ে ঝড় উঠেছিল। সেই সময় কানাডা সরকার এক জন খলিস্তানিকে ভারতের হাতে তুলে দিতে অস্বীকার করে। পরে জানা যায়, ১৯৮৫ সালে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানে মাঝ-আকাশে খলিস্তানিরা বোমা বিস্ফোরণ ঘটানোর ফলে কানাডার ৩০০ জনেরও বেশি নাগরিকের মৃত্যুর ঘটনার সঙ্গে সেই খলিস্তানির যোগ ছিল।
কানাডায় আট লক্ষের বেশি শিখ রয়েছেন, তার বেশির ভাগ শিখই খলিস্তান আন্দোলনের সমর্থক নন। নিজ্জর যে তাঁদের খুব কাছের লোক, এমন নয়। ভারতকে নিয়ে এই শিখ সম্প্রদায় বেশ গর্বই করেন। যদিও, ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা-হত্যার পরে শিখ-বিরোধী দাঙ্গা, এবং চার দশক পরেও অভিযুক্তদের শাস্তি না হওয়ার জন্য তাঁদের মনে বেদনা রয়ে গিয়েছে। এটাও বুঝতে হবে যে, কানাডার এক জন নাগরিককে বাইরে থেকে কেউ এসে হত্যা করে যাবে, সেটা কানাডার শিখরা কখনওই ভাল চোখে দেখবেন না।
কেউ কেউ মনে করেন যে বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের রাজনৈতিক ভাবে কাছে টানার চেষ্টা করছে কানাডা-সহ পশ্চিমি দুনিয়ার অনেক দেশই। সেই জন্যই নেতারা এখন তাঁদের দেশে খলিস্তানিদের কাজকর্ম থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রাখছেন। তাই ‘খলিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগানেও তাঁরা দোষের কিছু দেখছেন না। ভারত অবশ্য মনে করে যে, এর ফলে সন্ত্রাসবাদী শক্তিকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে।
কিছু দিনের মধ্যে হয়তো কানাডার মানুষজনের ভারতে আসার জন্য ভিসা ব্যবস্থা আবার শুরু হবে। ভারতীয় ছাত্রছাত্রীরা আগের মতোই কানাডার বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ভিড় করবেন। তবে ভারতে এ বিষয়ে আলোচনায় কানাডার অভিবাসী সমগ্র শিখ সমাজকেই খলিস্তানিদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন বলে তুলে ধরলে ভুল হবে। আরও ভুল হবে যদি কানাডার নতুন প্রজন্মের শিখ যুব সম্প্রদায়ের সঙ্গে যোগাযোগের রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে, তাদের খলিস্তানিদের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়।