Sudan clash

দুই জেনারেল, একটি দেশ

রাজধানী খার্তুম এবং সুদানের অন্যান্য জনবহুল শহরে যে সংঘর্ষ শুরু হয়েছে, তাতে গোটা দেশে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

Advertisement

প্রণয় শর্মা

শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০২৩ ০৪:৩০
Share:

ভয়ানক গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে সুদানে। ফাইল ছবি।

ভয়ানক গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে সুদানে। ভারত-সহ বিভিন্ন দেশ নিজের নাগরিকদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিচ্ছে। ভিন্ন জাতি ও ধর্মের গোষ্ঠীদের মধ্যে দীর্ঘ, রক্তক্ষয়ী সংঘাতের জন্য বার বার দুনিয়ার নজরে এসেছে মিশরের দক্ষিণে অবস্থিত এই দেশটি। সুদানের পশ্চিমে দারফুর এলাকার অধিবাসীদের সঙ্গে ক্ষমতাসীন আরব সরকারের যে সংঘাত শুরু হয়েছিল ২০০৩ সালে, তাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। আবার, উত্তর সুদানের আরব মুসলিমদের সঙ্গে দক্ষিণ সুদানের কৃষ্ণাঙ্গ খ্রিস্টানদের বিরোধ চলে প্রায় পঞ্চাশ বছর। ২০১১ সালে দক্ষিণ সুদান নামে এক আলাদা রাষ্ট্র তৈরি হয়। ওসামা বিন লাদেন সৌদি আরব থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পরে সুদানই তাকে সর্বপ্রথম আশ্রয় দিয়েছিল, সেটাও নজর করেছিল আন্তর্জাতিক মহল।

Advertisement

এখন সুদানে যে সংঘর্ষ শুরু হয়েছে, তা সেনাবাহিনীর দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী জঙ্গি গোষ্ঠীর মধ্যে। দুই গোষ্ঠীরই লক্ষ্য, দেশের সামরিক-রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নেওয়া। এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে রাজধানী খার্তুম এবং সুদানের অন্যান্য জনবহুল শহরে যে সংঘর্ষ শুরু হয়েছে, তাতে গোটা দেশে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ফলে, বহু বছর ধরে চলে আসা সামরিক একনায়কতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে অসামরিক শাসনব্যবস্থা চালু হওয়ার সম্ভাবনাও হ্রাস পাচ্ছে। এই ক’দিনের সংঘর্ষে ৪২০ জন নিহত, এবং অন্তত ৩৮০০ জন মানুষ আহত হয়েছেন। অনেকেই মনে করছেন, বাইরের দেশগুলির চাপে আপাতত যুদ্ধ যদি বা বন্ধ হয়, তা হবে সাময়িক। দুই যুযুধান জঙ্গি গোষ্ঠীর মধ্যে শান্তি অত সহজে আসবে না।

এই দুই গোষ্ঠীর নেতাদের নাম যথাক্রমে জেনারেল আবদেল আল ফতা আল বুরহান ও জেনারেল মহম্মদ হামদান দাগালো। প্রথম জন সুদান সেনাবাহিনীর এক জন জেনারেল, এবং ২০১৯ থেকে দেশের সর্বোচ্চ শাসনব্যবস্থার জন্য ভারপ্রাপ্ত কাউন্সিলের প্রধান। দ্বিতীয় জন দেশের আধাসামরিক বাহিনী ‘র‌্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স’-এর প্রধান। দু’জনের বিরুদ্ধেই মানবাধিকার ভঙ্গ করা, লুটতরাজ, নৃশংসতা ও ধর্ষণের অভিযোগ রয়েছে। গত কয়েক দশকে সুদানে সামরিক বাহিনীর গৃহযুদ্ধের গণহত্যায় এই দুই সামরিক নেতারও ভূমিকা ছিল। স্বৈরতন্ত্রী শাসক ওমর আল বশির তিরিশ বছর ক্ষমতাসীন থেকে অনাচারের পর শেষ পর্যন্ত গণঅভ্যুত্থানের জেরে ক্ষমতা থেকে অপসারিত হন ২০১৯ সালে। তার পর প্রভাবশালী সামরিক গোষ্ঠীর নেতারা, এবং অসামরিক নেতারা মিলে একটি পরিচালন পর্ষদ গঠন করে নিজেদের মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগির ব্যবস্থা করেন। ঠিক হয়েছিল, কয়েক বছরের মধ্যেই পুরোপুরি অসামরিক এক সরকারের হাতে দেশের ক্ষমতা তুলে দেবে। কিন্তু ২০২১ সালে আল বুরহান ওই পর্ষদ ভেঙে দেন, এবং ২০২৩ সালে নির্বাচন ঘোষণা করেন। অর্থাৎ, এ বছর নির্বাচন হওয়ার কথা। তার আগে সুদানের সেনাবাহিনী এবং আধাসামরিক বাহিনীকে এক ছাতার তলায় আনার আলোচনা শুরু হতেই বিবাদ শুরু হয়। দুই জেনারেলের মধ্যে কে কার অধীনে থাকবেন, সেটাই প্রধান বিবাদের বিষয় হয়ে ওঠে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দুই জেনারেল এবং তাঁদের সামরিক গোষ্ঠীর কাছে এটা একটা অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই হয়ে দাঁড়িয়েছে।

Advertisement

ভারতের সঙ্গে সুদানের বন্ধুত্বের একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল ব্রিটিশ শাসনের সময় থেকেই। মহাত্মা গান্ধী এবং জওহরলাল নেহরু ভারত স্বাধীন হওয়ার আগেই সুদান গিয়েছিলেন। ভারতের স্বাধীনতার আন্দোলন সুদানকে অনুপ্রাণিত করেছিল। শোনা যায়, ১৯৫৫ সালে ইন্দোনেশিয়ার বান্দুং-এ এশিয়া ও আফ্রিকার সদ্য-স্বাধীন দেশগুলির সম্মেলনে যোগ দিতে এসে সুদানের প্রতিনিধিরা দেখেন যে, তাঁরা তাঁদের জাতীয় পতাকা আনতে ভুলে গেছেন। তখন বান্দুং সম্মেলনের অন্যতম উদ্যোক্তা প্রধানমন্ত্রী নেহরু নিজের একটা সাদা রুমাল বারকরে তাতে বড় বড় করে ‘সুদান’ কথাটি লিখে কনফারেন্স হলে সুদানের প্রতিনিধিদের টেবিলে রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন। সুদানে ১৯৫৩ সালে প্রথম সাধারণ নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন ভারতের তৎকালীন মুখ্য নির্বাচনী কমিশনার সুকুমার সেন।

সুদানের পূর্ব দিকে লোহিত সাগর, নীল নদ বয়ে গেছে মাঝখান দিয়ে, দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল ছুঁয়ে আছে আফ্রিকার কৃষি ও খনিজ সম্পদে ভরপুর সাহেল অঞ্চলকে। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম সোনার খনিও এই সুদানেই আছে। সুদানের সোনার খনিগুলিতে রাশিয়ার বিনিয়োগ আছে। তাই পশ্চিমের কোনও কোনও মহল আশঙ্কা করছে, সেখান থেকে আহরিত অর্থ হয়তো ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধ চালাতে ব্যবহার হচ্ছে।

সুদানে এই রক্তপাত ও লোকক্ষয় বন্ধ করতে অন্য দেশগুলি দুই জেনারেলের উপর প্রয়োজনীয় চাপ দিয়ে এঁদের আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসবে, না কি নিজেদের সঙ্কীর্ণ স্বার্থের কথা মাথায় রেখে এক-একটি দেশ এক-এক জন জেনারেলকে পরোক্ষ মদত দিয়ে সুদানে নিজেদের প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে সুদানের অশান্তির প্রভাব ইতিমধ্যেই প্রতিবেশী রাষ্ট্র চাড, ইথিয়োপিয়া, দক্ষিণ সুদানে পড়তে শুরু করেছে। গৃহযুদ্ধের কালো মেঘ আরও কত দিন ছেয়ে রাখবে সুদানের আকাশ, সেটাই এখন দেখার।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement