প্রচারপর্ব: নির্বাচনের প্রাক্কালে জনসভায় যোগ দিতে আসা প্রধানমন্ত্রীর কপ্টার ঘিরে সমর্থকদের উচ্ছ্বাস, বালুরঘাট, ১৬ এপ্রিল। পিটিআই।
আজ রাত পোহালেই লোকসভা ভোট শুরু। দেশের লড়াই কতখানি মোদী বনাম রাহুল, কতটাই বা এনডিএ বনাম ‘ইন্ডিয়া’, সেই প্রশ্নে মতভেদ আছে, থাক। তবে বাংলায় মোদী-দিদি টক্কর যে এ বার ধারে-ভারে কোনও অংশে কম যাচ্ছে না, তাতে সন্দেহ নেই। অনেকের মতে, শুধু এই রাজ্যেই নয়, ভোট-পরবর্তী জাতীয় রাজনীতিতেও এটা ছাপ ফেলতে পারে।
রাজ্যে ভোটের হাওয়ার গতি এ বার নানা কারণে বেশ এলোমেলো। পণ্ডিতদের পূর্বাভাস সব ভোটেই যেমন থাকে, তেমন এ বারেও আছে। সেগুলি কখনও প্রকৃত ফলের কাছাকাছি পৌঁছে যায়, কখনও একেবারেই মেলে না। এই বাস্তবতা মেনে তাই ধরে নেওয়া যেতে পারে, সাধারণ ভোটারকুল নিজেদের সিদ্ধান্ত ‘স্থির’ করেই রাখে। নেতা-নেত্রী-পণ্ডিত-বিশ্লেষকরা সব সময় সেটা হয়তো ঠিকঠাক আঁচ করতে পারেন না।
সবাই জানেন, ২০২১-এ তৃণমূলে ভাঙন, তাতে বিজেপির উচ্ছ্বাস এবং নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহদের আদাজল খেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া ইত্যাদি মিলেমিশে বাজারে হাওয়া ছড়িয়ে গিয়েছিল যে, বিজেপি ‘রাজ্যজয়’ করে ফেলতে পারে। পদ্মের ‘মুখ’ অর্থাৎ সম্ভাব্য মুখ্যমন্ত্রী নিয়ে জল্পনাও চলত বিস্তর। একাধিক তৃণমূল নেতার কথা বলতে পারি, ভোট-পর্ব চলাকালীন যাঁরা ঘন ঘন আসন ধরে ধরে হিসাব কষতেন— শেষ পর্যন্ত সরকার গড়ার মতো সংখ্যা মিলবে তো! দলের বড় মাপের এক নেতা তো সেই সময় সংশয়ী গলায় আমাকে এমনও বলেছিলেন যে, “সরকার গড়তে ১৪৭ আসন লাগে। আমরা কি ১৬০-৬৫ পাব না? তাতেও তো সরকারটা হয়ে যায়!”
মজার কথা, প্রাক্-ভোট এবং বুথফেরত অধিকাংশ সমীক্ষাও তৃণমূলের ভাগে সে বার কম-বেশি ১৬০/৬৫-র বরাদ্দই তুলে ধরেছিল। সে সব নস্যাৎ করে প্রকৃতপক্ষে ফল কী হয়েছিল, তা আজ আর নতুন করে মনে করানোর প্রয়োজন নেই। শুধু এটুকু স্মরণে থাক, ২০২১-এ বাংলা ‘দখল’-এর লক্ষ্যে এই বিজেপি দু’শো পার করার দাবি করে ৮০-তেও আসেনি। আর এ বারের লোকসভা ভোটে দেশের সামনে মোদীর চ্যালেঞ্জ, “ইস বার চারশো পার।”
এই সূত্রেই মনে পড়ে যাচ্ছে ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের কথা। সে দিন সকল রাজ্যের ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছে। ঘণ্টা দুয়েক পরে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে শুরু হবে বুথফেরত সমীক্ষা। সবাই উদ্গ্রীব। ঠিক সেই সময় একটি ফোন পেলাম। করেছিলেন তৃণমূলের উঁচুতলার এক জন। তাঁর বক্তব্য ছিল, “অনেক হিসাব করে দেখলাম, বিজেপি খুব ভাল করলেও এখানে বড়জোর দশ। তার বেশি আসন কিছুতেই পেতে পারে না।” মুখে মুখে বিজেপির সম্ভাব্য আসনগুলির তালিকাও শুনিয়েছিলেন তিনি। যদিও বুঝতে পারছিলাম ভিতরে ভিতরে তিনি উদ্বিগ্ন। বুথফেরত সমীক্ষায় অবশ্য এই রাজ্যে বিজেপির উত্থানের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দেখা যায় এবং ১৮ আসন জিতে সেই প্রথম তৃণমূলকে তারা বড় ধাক্কা দেয়।
এ বারে কিন্তু মনে হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের ভোট-ভবিষ্যৎ সম্পর্কে এখনও সর্বস্তরেই এক প্রকার অস্পষ্টতা দানা বেঁধে রয়েছে। তারই কারণে হয়তো কোনও সমীক্ষায় রাজ্যে তৃণমূল এবং বিজেপির মধ্যে আসন আধাআধি ভাগ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। কেউ বিপুল আসনে বিজেপির জয়ের আভাস দিচ্ছে। কেউ বা বলছে ঠিক উল্টো, অর্থাৎ তৃণমূলের জয়জয়কার। সামগ্রিক ভাবে দেশে বিজেপি-জোটের ক্ষমতায় ফেরার অনায়াস সম্ভাবনা যখন অনেকটাই স্পষ্ট ভাবে উচ্চারিত, তখন পশ্চিমবঙ্গ এই ভাবে আলোচনার আলাদা পরিসর ও গুরুত্ব তৈরি করছে।
ভোটের ময়দানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল বিজেপি-বিরোধী অন্যতম আঞ্চলিক শক্তি হিসাবে গণ্য হয়। শুধু তা-ই নয়, কংগ্রেস ও বাম যত আসনেই প্রার্থী দিক, বাংলায় লড়াই যে কার্যত তৃণমূলের সঙ্গে বিজেপির, তা নিয়ে তর্ক বৃথা। তার উপর রাজ্যে কাগজে-কলমে বিরোধীদের ‘ইন্ডিয়া’ জোটের গঙ্গাযাত্রা হয়ে গেলেও মমতার ঘোষণা অনুযায়ী তৃণমূল এখনও ওই জোটে আছে এবং থাকবে। ভোটের পরে বিরোধী শিবিরে তৃণমূলের ‘প্রকৃত’ অবস্থান কী দাঁড়াবে, সেই চর্চাও ইতিমধ্যে তাৎপর্যপূর্ণ মাত্রা পেয়েছে।
এই অবস্থায় ২০২১-এর বিধানসভার মতো বিজেপির বিরুদ্ধে এই লোকসভায় ‘একা’ লড়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কী ফল দেখাতে পারেন, তার উপর জাতীয় রাজনীতির পরবর্তী যোগ-ভাগ অনেকটা নির্ভর করবে। উল্টো দিকে, মমতার বিরুদ্ধে গত বিধানসভায় ঘা খাওয়া বিজেপি কতটা মাথা তুলতে পারবে, তার উপর শুরু হবে রাজ্যে পরবর্তী বিধানসভা ভোটের হিসাবনিকাশ। উভয় দলের অভ্যন্তরীণ সমীকরণও সেই সব অভিঘাতের বাইরে থাকতে পারবে না।
সাধারণত কোনও সরকার একটানা ক্ষমতায় থাকলে তাকে ‘অ্যান্টি-ইনকামবেন্সি’র মোকাবিলা করতে হয়। সেই ধাক্কা অনেকটা নির্ভর করে ‘উপযুক্ত বিকল্প’ থাকা, না-থাকার উপর। যা বোঝা যায় জনতার রায়ে। রাজ্য, কেন্দ্র সবার বেলাতেই এটা খাটে। সিপিএম রাজ্যে দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় ছিল। কংগ্রেস বিকল্প হতে পারেনি। তৃণমূল গড়ে মমতা পেরেছিলেন এবং সিপিএম হারল। সেই থেকে দশ বছর পেরিয়ে মমতা ক্ষমতায়। নরেন্দ্র মোদীরও দশ বছর হল। দেশের ভোটে তাঁর পরীক্ষা।
এ কথা ঠিক, গত বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকে সরকার ও দল মিলিয়ে তৃণমূল একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগে ফেঁসে রয়েছে। রাজ্যের মন্ত্রীদের জেলে থাকার ঘটনাও এই প্রথম।
বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতির ‘ফলনবৃদ্ধি’ এই সরকারের অন্যতম ব্যর্থতা।
অন্য দিকে, মোদী বহু প্রতিশ্রুতি বেবাক ‘ভুলে’ গিয়েছেন। মানুষের দৈনন্দিন যাপনের কষ্ট কমেনি। বেকারত্ব, কৃষক-শ্রমিকের সমস্যা সবই আছে। ধর্মীয় উন্মত্ততা বাড়ছে। ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হচ্ছে। দেশবাসী তারও সাক্ষী। অর্থাৎ, ভোটারদের সামনে সবার খাতাই খোলা।
কিন্তু যে শাসক নিজেরাই চারশো আসনের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে ভোটে নেমেছেন, সেই সরকার ঠিক এই সময় বেছে বেছে বিরোধীদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় তদন্তের ঢল নামিয়ে দিচ্ছে কেন, প্রশ্ন থাকছেই। অন্যায়ের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ জরুরি। তবে যে ভাবে এখন তা সংগঠিত হচ্ছে, সেটা কি ‘একচ্ছত্র’ কোনও দলের দৃঢ়তার পরিচয়, না কি চাপা ‘দুর্বলতা’র প্রকাশ? শুনেছি, সাপ আসলে ভিতু। ভয় পেয়ে কামড়ায়।
শেষে অন্য কথা। বাংলায় নির্বাচনে রক্তের আতঙ্ক। হতাহতের সংখ্যা গুনতে হয়। এই একটি জায়গায় আমরা, বঙ্গবাসীবৃন্দ, সত্যিই গরু, তবে ঘরপোড়া! তাই ভয়ে সিঁটিয়ে থাকি। বাংলার ভোটে জাল-জালিয়াতির ‘ঐতিহ্য’ খুঁজলে ১৯৫২-র প্রথম নির্বাচন থেকেই কম-বেশি প্রমাণ মিলতে পারে। কিন্তু গত তিন-চার দশক ধরে ভোটে হিংসা, হানাহানি যে ভাবে বেড়ে চলেছে, তাতে আমাদের রাজ্যকে ‘গণতন্ত্রের সমাধিক্ষেত্র’ বলার সময় বোধ হয় ক্রমশ এগিয়ে আসছে। এই ব্যাপারে সারা দেশে আর কোনও রাজ্য সম্ভবত বাংলাকে ‘হারাতে’ পারবে না। এখানে আক্ষরিক অর্থেই এগিয়ে বাংলা!
এ কথা নেতা-নেত্রীদের মনঃপূত না হতে পারে। শাসক ও বিরোধীপক্ষ পরস্পরের উপর দায় চাপানোর হাজার অজুহাত খুঁজতে পারে। কিন্তু ভোটের জন্য যে রাজ্যে কেন্দ্রীয় বাহিনীর পরিমাণ বাড়তে বাড়তে এ বার মোট ৯২০ কোম্পানিতে পৌঁছল, তার ‘মুখ’ তো পুড়বেই।
যদিও তালি কখনও এক হাতে বাজে না। তাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষার মূল দায় রাজ্যের শাসকের হলেও এ ব্যাপারে বিরোধীদের একেবারে সুবোধ ও নিষ্কলঙ্ক ভাবা মূর্খামি। শান্তির ললিতবাণী শোনানো রাজনীতির কারবারিরা এ ক্ষেত্রে সবাই সমান। পাপ তাঁদের সবার। আবার চাইলে তাঁরাই পারেন এই সব রক্তস্রোত বন্ধ করতে। সেই চেষ্টা এ বারই শুরু হোক না! জানি, এ সব বলা হয়তো অরণ্যে রোদন। তবু ভোটের সূচনা লগ্নে এটুকু আমরা চাইতেই পারি।