স্কুলের বইতে পড়া বাঁদর থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে মানুষের সৃষ্টির কথা আসলে ‘মিথ’। প্রতীকী ছবি।
১৯৬৬ সালের কথা। যে বছর নিল আর্মস্ট্রং আমেরিকার মহাকাশযানে চেপে চাঁদের মাটিতে পা রাখার প্রস্তুতি শুরু করেছিলেন, রাশিয়ার মহাকাশযান প্রথম বার চাঁদের কক্ষপথে ঢুকে পড়েছিল। সে বছরই ইলাহাবাদে কুম্ভমেলা বসেছিল। সেখানে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সভায় বক্তৃতা করেছিলেন মাধব সদাশিব গোলওয়ালকর। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক। যিনি ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ নামক তত্ত্বের জনক। সঙ্ঘ পরিবারে যাঁর পরিচিতি ‘গুরুজি’ নামে।
গোলওয়ালকর সেই বক্তৃতায় বলেছিলেন, “লোকে বলে, এখন বিজ্ঞানের যুগ। তাই প্রায়ই যুক্তি দেওয়া হয়, বিজ্ঞানের যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ধর্মেও পরিবর্তন আনতে হবে। আমি ঠিক উল্টো কথা বলি। যদি বিজ্ঞানের প্রতিটি গবেষণার সঙ্গে সঙ্গে ধর্মে পরিবর্তন করতে হয়, তা হলে ধর্ম আর ধর্ম থাকবে না।”
হিন্দু, ইসলাম বা খ্রিস্টান— যে কোনও ধর্মের গোঁড়ামিই বিজ্ঞানের নতুন নতুন গবেষণা থেকে চোখ বন্ধ করে রাখতে শেখায়। সেই ধর্মীয় গোঁড়ামি পুরাণকে ইতিহাস বলে, বিবর্তনের তত্ত্ব খারিজ করে দেয়। আর দেশের সরকার যখন ধর্মীয় গোঁড়ামিতে আটকে পড়ে?
বছর পাঁচেক আগে তদানীন্তন কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী সত্যপাল সিংহ আচমকাই ঘোষণা করলেন, তিনি চার্লস ডারউইনের বিবর্তনের তত্ত্ব মানেন না। স্কুলের বইতে পড়া বাঁদর থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে মানুষের সৃষ্টির কথা আসলে ‘মিথ’। আমাদের পূর্বপুরুষেরা কেউ বাঁদরকে মানুষে পরিণত হতে দেখেননি। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে আসা কোনও কাহিনিতেও এর উল্লেখ নেই। তাই ওই তত্ত্ব স্কুল-কলেজে পড়ানো উচিত নয়। সত্যপালের পক্ষে দাঁড়িয়ে আরএসএস নেতা রাম মাধব সে সময় বেশ কিছু নথি তুলে ধরেছিলেন। তাতে দেখানো ছিল যে, খ্রিস্টানদের অনেকেও ডারউইনের তত্ত্ব মানেন না। রাম মাধব যেটা বলেননি, তা হল, ওই সব গোঁড়া খ্রিস্টানের মতো গোঁড়া মুসলমানরাও বিবর্তনের তত্ত্বে বিশ্বাস করেন না। তাই সৌদি আরবে বিবর্তনের তত্ত্ব পড়ানো নিষিদ্ধ। গোঁড়ারা বিশ্বাস করেন, মানুষের সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর বা আল্লা। সত্যপাল যেমন মনে করেন, মানুষের সৃষ্টি সরাসরি মুনি-ঋষিদের ঔরস থেকে।
সত্যপালের এই ‘অসত্য-বচন’ নিয়ে সে দিন বিশেষ কেউ মাথা ঘামায়নি। পাঁচ বছর পরে দেখা যাচ্ছে, সত্যিই স্কুলের পাঠ্যক্রম থেকে ডারউইনের তত্ত্ব বাদ পড়েছে। মোদী সরকারের নতুন শিক্ষানীতি মেনে শিক্ষা গবেষণা ও প্রশিক্ষণের জাতীয় পরিষদ বা এনসিইআরটি গত বছরেই ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণির স্কুলের পাঠ্যক্রমে বিস্তর রদবদল করেছিল। এ বছর নতুন বই ছেপে আসার পরে দেখা যাচ্ছে, নবম-দশমের বই থেকে ডারউইনের তত্ত্ব পুরোপুরি বাদ। একাদশ-দ্বাদশে যে সব পড়ুয়া জীববিজ্ঞান পড়বে না, তাদের আর স্কুলজীবনে ডারউইনের নামই শোনা হবে না।
এত দিন সংখ্যালঘু তোষণের ধুয়ো তুলে মোগল সাম্রাজ্য বা সুলতানি আমলের অধ্যায় ইতিহাসের পাঠ্যক্রম থেকে বাদ যাচ্ছিল। ইতিহাস নতুন করে লেখা দরকার বলে বিজেপি নেতামন্ত্রীরা যুক্তি দিচ্ছিলেন, ইতিহাসের বইতে শুধুই বহিরাগত হামলাকারী মুসলমান রাজারাজড়ার কথা। দেশীয় হিন্দু রাজাদের বীরগাথা নেই। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার লড়াইয়ে শুধুই গান্ধী-নেহরু। বিনায়ক দামোদর সাভারকরকে নিয়ে একটি শব্দও নেই। প্রশ্ন হল, বিজেপি-আরএসএস কি শুধুই ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে বিজ্ঞানের পাঠ্যক্রমে রদবদল করছে? হিন্দুত্বের ভাবনা ছড়িয়ে দিতে পাল্টে দিচ্ছে ইতিহাসের বই? সহজ উত্তর, শুধুই তা নয়। বিজেপি, বিশেষত আরএসএস আসলে তাদের ভাবধারা, হিন্দুত্বের তত্ত্বে বিশ্বাসী একটি পাকাপাকি ভোটব্যাঙ্ক তৈরি করতে চাইছে। তাদের নিজস্ব ভোটব্যাঙ্ককে আরও মজবুত করতে চাইছে। এমন একটি প্রজন্ম তৈরি করতে চাইছে, যারা তাদের ভাবধারাতেই বড় হয়ে উঠবে।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের নেতারা জানেন, নরেন্দ্র মোদীর জনপ্রিয়তার রেখচিত্র আজ নয়তো কাল নিম্নমুখী হবেই। নরেন্দ্র মোদীর ঠিক পরেই তাঁর মাপের জনমোহিনী শক্তিসম্পন্ন নেতা খুঁজে পাওয়া মুশকিল হবে। অমিত শাহের মতো সংগঠনকে হাতের মুঠোয় ধরে রাখতে পারা নেতাও চট করে মিলবে না। তার জেরে বিজেপিতে ভাঙন ধরবে। ভোটব্যাঙ্কে ক্ষয় হবে। সঙ্ঘের মতাদর্শ শিকড়ে ছড়িয়ে দিতে আরএসএস নিয়ন্ত্রিত বিজেপির সরকার ক্ষমতায় থাকা দরকার। স্থায়ী ভোটব্যাঙ্ক তৈরি করে রাখাটা তাই জরুরি। আমজনতার কাছে ‘শিক্ষার গৈরিকীকরণ’ নামে পরিচিত এই প্রকল্প রূপায়ণের তাগিদ তাই মোদী সরকারের থেকেও সঙ্ঘ পরিবারের বেশি।
সেই লক্ষ্যেই নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরেই আরএসএস ‘ভারতীয় শিক্ষানীতি আয়োগ’ নামের একটি কমিটি তৈরি করেছিল। উদ্দেশ্য ছিল, ভারতের শিক্ষাব্যবস্থার ভারতীয়করণ। কমিটির প্রধান দীনানাথ বত্রা— সঙ্ঘ পরিবারের শিক্ষা সংগঠন ‘বিদ্যা ভারতী’-র দীর্ঘ দিনের সাধারণ সম্পাদক। হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা বত্রা মূলত চারটি বিষয়ে জোর দিয়েছিলেন। এক, হিন্দুরা এ দেশেরই ভূমিপুত্র। আর্যদের মতো তারা বাইরে থেকে ভারতে আসেনি। দুই, রামায়ণ-মহাভারতের মতো মহাকাব্যে যে সমস্ত গৌরবের কাহিনি লেখা রয়েছে, তার সবটাই ইতিহাস। তিন, মুসলিম হানাদারদের হাত ধরেই এ দেশে অন্ধকার যুগের শুরু। মোগল সাম্রাজ্য পর্যন্ত সেই অন্ধকার যুগ চলেছে। চার, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার লড়াইয়ে গান্ধী-নেহরুকে বড় বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সঙ্ঘ পরিবারের স্বাধীনতা আন্দোলনে কোনও ভূমিকা ছিল না, এ কথা ভুল। আসলে হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের ইতিহাস থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ২০১৪-তেই ওয়াই সুদর্শন রাওকে ভারতীয় ইতিহাস গবেষণা পরিষদ বা ‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব হিস্টরিক্যাল রিসার্চ’-এর শীর্ষ পদে বসানো হয়েছিল। রাও বুক ঠুকে বলতেন, যা পুরাণ, তাহাই ইতিহাস। পৌরাণিক মহাকাব্যে বর্ণিত স্থানগুলি এখন কোথায়, তা নিয়ে গবেষণা হওয়া উচিত।
খেয়াল করলে দেখা যাবে, কেন্দ্রে নতুন করে ক্ষমতায় আসার আগে বিজেপি যে সব রাজ্যে ক্ষমতায় থেকেছে, সেখানেই পাঠ্যপুস্তক, বিশেষত ইতিহাস বদলানোর চেষ্টা করেছে। গুজরাত থেকে রাজস্থান, সর্বত্র এর নজির রয়েছে। রাজস্থানে বিজেপি ক্ষমতায় থাকার সময় সে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী বাসুদেব দেবনানি স্পষ্ট ভাষায় বলতেন, ইতিহাসের বইতে আকবরের জয়গাথা না রেখে শুধু মহারাণা প্রতাপের বীরত্বের কাহিনি থাকা উচিত। তার জন্য তিনি হলদিঘাটের যুদ্ধের ফলাফল বদলে দিতেও পিছপা হননি। আকবরের বদলে সেখানে প্রতাপের যুদ্ধ জয় লেখা হয়েছিল। ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল, নবীন প্রজন্মের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত করা। যাতে কেউ জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে গিয়ে ‘দেশদ্রোহী’ না হয়ে ওঠে।
এই দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদ ছড়িয়ে দিতেই স্কুলের বই থেকে বাদ যাচ্ছে গণতন্ত্র ও বৈচিত্র, গণতন্ত্রের বিপদ, জনআন্দোলনের অধ্যায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বই থেকে বাদ যাচ্ছে গান্ধী-হত্যার পরে আরএসএস-এর উপরে নিষেধাজ্ঞা জারির অধ্যায়। কারণ সেই অধ্যায়ে লেখা রয়েছে, নরেন্দ্র মোদী যাঁর সুউচ্চ মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন, সেই সর্দার বল্লভভাই পটেলই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে আরএসএস-কে নিষিদ্ধ করেছিলেন।
দীনানাথ বত্রা মনে করেন, দেশের সরকার বদলালে স্কুলের পাঠ্যক্রমও বদলাবে। বাজপেয়ী সরকারের আমলে মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী হিসাবে মুরলী মনোহর জোশী স্কুলের বইতে অনেক রদবদল করেছিলেন। পরে মনমোহন সিংহের ইউপিএ সরকার এসে আবার সে সব বদলে ফেলে। আবার মোদী সরকার এসে স্কুলের বই বদলাচ্ছে।
বিজেপির বিরুদ্ধে এত দিন ভোটের সময় ধর্মীয় মেরুকরণের অভিযোগ উঠেছে। শিক্ষানীতির রদবদলের ফলে এখন পড়ুয়া, ইতিহাসবিদ, বিজ্ঞানীদের মধ্যেও মেরুকরণ হচ্ছে। এক দল ডারউইনের তত্ত্ব শিখেছে, অন্য দল পাণ্ডবদের জন্মের কাহিনি। এক দল রামায়ণকে গল্প বলে জানছে, অন্য দল রাম-রাবণের যুদ্ধকে ইতিহাস বলে পড়ছে। এক দল প্লাস্টিক সার্জারি নিয়ে গবেষণা করতে চাইলে অন্য দল বলছে, হাতির মাথা কেটে গণেশের ঘাড়ে মুন্ডু বসানোটাই প্রথম প্লাস্টিক সার্জারি।
প্রাপ্তির খাতায় তাই শুধুই মেরুকরণের রাজনীতি।