—প্রতীকী ছবি।
আমরা শীতের আশায় সোয়েটার, মাফলার, জ্যাকেট আর লেপ-কম্বল নিয়ে হাপিত্যেশ করে বসে আছি। কিন্তু শহরে শীতের দেখা নেই! বর্ষাকালে তেমন বৃষ্টিও নেই! কিন্তু গরমকালে তেড়ে গরম। এখন যেন সাকুল্যে একটাই ঋতু। তা হল আবহমান গ্রীষ্মকাল! আবহবিদরা বলছেন, এমনটা যে হবে তা অনেক আগে থেকেই আশঙ্কা করা গিয়েছিল। সারা বিশ্ব জুড়ে জলবায়ু পরিবর্তন আর উষ্ণায়ন এখন সবচেয়ে বেশি মনখারাপ-করা ন্যারেটিভ। ভারতের পক্ষে তা আরও বেশি উদ্বেগের, বিশেষত স্বাস্থ্যগত কারণে।
ভারতের স্বাস্থ্যব্যবস্থা এমনিতেই নড়বড়ে। কোভিডের সময় আমরা তা হাড়ে-হাড়ে টের পেয়েছিলাম। এর পর ক্রমবর্ধমান উষ্ণায়ন আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা আর জীবনযাত্রার উপর আরও চাপ বাড়াবে। একটি গবেষণার হিসাব বলছে, বিশ্বের তাপমাত্রা যদি আরও দু’ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পায়, তবে ভারতের অনেক অঞ্চল বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। বাসযোগ্যতা হারাবে উপকূল, পাহাড়ি ও কৃষি অঞ্চল। সমুদ্রতলের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বাস্তুচ্যুত হতে পারে সুন্দরবনের প্রায় তিন লক্ষ পরিবার।
২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তির সময় বিশ্বের ১৯৬টি দেশ তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসে বেঁধে ফেলবে বলে শপথ নিয়েছিল। সে ছিল নিতান্তই কথার কথা। কেউ কথা রাখেনি। ফলত ২০২৩ সাল ইতিহাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা আর তাপপ্রবাহের বছর হিসাবে রেকর্ড করল। হিট স্ট্রোকের কারণে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া মানুষের সংখ্যা বেড়েছে, এবং কিছু অঞ্চলে মারাত্মক খরা দেখা দিয়েছে, যা স্বাস্থ্যের পাশাপাশি কৃষি-সংস্কৃতিকেও প্রভাবিত করেছে।
পরিবেশবিদরা বলছেন, উষ্ণায়ন জল ও স্থলের বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য নষ্ট করে দেবে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে উষ্ণপ্রবাহ, দাবানল, খরা, ভূমিধস, ঘূর্ণিঝড় আর বন্যা আমাদের জীবনযাত্রার নিত্য সহচর হয়ে উঠবে। কৃষিক্ষেত্রে ঘটবে বিপর্যয়। খাদ্যশস্য, স্বাস্থ্য ও জীবন-জীবিকার সংস্থান শোচনীয় ভাবে ব্যাহত হবে। খাদ্যাভাব থেকে ঘনিয়ে উঠতে পারে ঘোরতর সামাজিক ও রাজনৈতিক সঙ্কট। জলবায়ুর পরিবর্তন যাবতীয় রোগব্যাধির সংক্রমণ আরও বাড়িয়ে তুলবে। জলবায়ু-নির্ভর প্যাথোজেন আর ভেক্টরবাহিত রোগ কিছু অঞ্চলে বৃদ্ধি পেতে পারে। নানা জানা-অজানা রোগের ভেক্টর তাদের জীবনচক্রের পরিবর্তনের মাধ্যমে সংক্রমণের ঋতুপরিবর্তনও ঘটিয়ে তুলতে পারে। তাপমাত্রার পরিবর্তন ডেঙ্গি জ্বর আর ডায়রিয়ার অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে।
উষ্ণায়নজনিত নতুন পরিবেশে কমে যেতে পারে মানব-বান্ধব উদ্ভিদ আর প্রাণী। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, এমন চলতে থাকলে আর বছর দশেকের মধ্যেই উদ্ভিদ আর প্রাণী মিলিয়ে অন্তত চল্লিশটি প্রজাতি চিরতরে বিলুপ্ত হবে, বিপন্ন হবে আমাদের চেনাজানা ৭০ শতাংশ পাখি। বৃষ্টিপাতের রকমফের আর তাপমাত্রা বৃদ্ধির একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রবণতা হিসাবে ম্যালেরিয়ার ভেক্টর মশা কিংবা প্লেগের ভেক্টর ইঁদুরের প্রাচুর্যকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। মাত্রাতিরিক্ত তাপপ্রবাহ রোগজীবাণুর তীব্রতারও রকমফের ঘটায়। যদি বিশুদ্ধ পানীয় জলের জোগান কমে আর খাদ্যের পুষ্টি হ্রাস পায়, তবে রোগজীবাণু উৎসাহিত হয়। আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রকের হিসাব বলছে, জলবাহিত রোগে এ দেশে আক্রান্ত হন বছরে চার কোটি মানুষ, মারা যায় পনেরো লক্ষ শিশু। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, বছরে নয় লক্ষ মানুষ মারা যান দূষিত জল পান করে। উষ্ণায়ন এই পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটাবে।
আমরা যে ভাবে বায়ুদূষণ করছি, বনভূমি উজাড় করছি, তাতে বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ আশঙ্কাজনক ভাবে বেড়ে যাচ্ছে। ফলে বিকিরিত তাপশক্তি পুনরায় বায়ুমণ্ডলে ফিরে যেতে বাধা পাচ্ছে। আর তাই বায়ুমণ্ডলে তাপমাত্রা বাড়ছে, ঘটছে বিশ্ব উষ্ণায়ন। এর থেকে বাঁচতে হলে আমাদের প্রথমত গাড়ি আর কারখানার ধোঁয়া কমাতে হবে। সৌরশক্তি চালিত গাড়ির ব্যবহার বাড়াতে হবে। আর নিয়ন্ত্রণ করতে হবে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার। মাটির গভীরে যায় এমন গাছের সংখ্যা বাড়াতে হবে। বৃষ্টির জল ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
আবহবিদরা বলছেন, গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের রাশ টেনে যদি গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে না রাখা যায়, তা হলে আমাদের কপালে অশেষ দুঃখ আছে। উন্নয়ন আর গ্যাস উৎপাদনের চলতি ধারা পাল্টাতে হবে। নয়তো ভয়াবহ সঙ্কটে পড়বে ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশের মানুষের জীবনমান আর স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রশ্ন। এ দিকে— ঘটনা হল, কার্বন পরিসরের ৭৫ শতাংশ আছে পশ্চিমের দেশগুলির অধিকারে। তাই উষ্ণায়ন যতটা না পরিবেশের প্রশ্ন, তার চেয়ে ঢের বেশি রাজনীতির।