যুদ্ধকালীন: কুট্টি ও চণ্ডী লাহিড়ীর আঁকা কার্টুন। ১৯৭১ সালে দেশ ও আনন্দবাজার পত্রিকা-য় প্রকাশিত। ফাইল ছবি।
আলেকসান্দর বারবান্শচাইকভ কি কখনও চণ্ডী লাহিড়ীর নাম শুনেছেন? য়ুরি জ়ুরাভেল কখনও দেখেছেন কুট্টি, সুফি বা অমল চক্রবর্তীর কাজ? মনে হয় না। তবু, কী আশ্চর্য— এই মুহূর্তেও দেশ বাঁচানোর যে যুদ্ধটা চলছে এই দেশ, এই মহাদেশ থেকেও দূরে অন্য এক ভূমে, সেখানকার শিল্পীদের কালি-কলম রূপকল্প আর ভাবনা কী করে মিলে যায় তাঁদের সঙ্গে, অর্ধশতাব্দীরও বেশি আগের এক যুদ্ধের সময় কালি-কলম টেনে নিয়ে বসেছিলেন যাঁরা? আলেকসান্দর-য়ুরিরা ইউক্রেনের কার্টুনিস্ট। স্বদেশ নামের ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও এঁকে যাচ্ছেন কার্টুন, আলেকসান্দরের আঁকা কার্টুন নিয়ে খুব চর্চা হয়েছে ওডেসা শহরের আন্তর্জাতিক কার্টুন প্রদর্শনীতে। সের্গেই আইজ়েনস্টাইনের ব্যাটলশিপ পোটেমকিন ছবির ‘ওডেসা স্টেপস’-এর সেই ওডেসা, এখন ইউক্রেনে। আলেকসান্দরের কার্টুনে রুশ সরকার নিয়ন্ত্রিত টিভি চ্যানেল দেখছে এক দল মানুষ... মানুষ নয় ঠিক, পাথরের মূর্তি। ভাবলেশহীন নির্বিকার, তাই পাথুরে। ওদের পিছনে, দূরে আকাশটা রক্তলাল— যুদ্ধ হচ্ছে, পুড়ে যাচ্ছে পড়শি দেশ।
আর ৯ এপ্রিল ১৯৭১, আনন্দবাজার পত্রিকা-র পাঁচের পাতায় কী আঁকছেন চণ্ডী লাহিড়ী? হপ্তা দুয়েক আগে শুরু হয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, নির্বিচার গণহত্যার খবর আসছে দিনের পর দিন, সীমান্ত পেরিয়ে আসছে শরণার্থীর ঢল। এই বাংলা উদ্বিগ্ন বটেই, আবার একটা শিশুসুলভ কৌতূহলও কাজ করছে, ভারত-(পূর্ব) পাকিস্তান সীমান্তে তাই উৎসুক মানুষের ভিড়। হিমশিম ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা যুদ্ধ ‘দেখতে আসা’ ছেলে বুড়ো মহিলাদের হটিয়ে দিচ্ছেন (উপরে, দ্বিতীয় ছবি)। যুদ্ধ নিয়ে মানুষের ভাবলেশহীনতার উল্টো পিঠেই তো থাকে অত্যুৎসাহ! দুই-ই অ-মানবিক— বুঝিয়ে দেন সে কালের চণ্ডী থেকে আজকের আলেকসান্দররা।
য়ুরি-র সাক্ষাৎকার পড়ছিলাম। বলছেন, যে লোকটার দম্ভের মূল্য দিতে তাঁর স্বদেশের উপর এই আক্রমণ, সেই ভ্লাদিমির পুতিনকে তিনি এমন ‘স্টাডি’ করেছেন যে চোখ বুজেও ওঁর কার্টুন এঁকে ফেলতে পারবেন, ঠিক যেমনটি চান তেমন! ক্রূর পুতিন, পেশি-ফোলানো পুতিন, বাথরুমে বসা পুতিন, তর্জন-গর্জন করা পুতিন, চিন্তিত পুতিন— সব। শিল্পী যেমন দেখছেন, তেমন। একাত্তরে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ চোখের সামনে বা একটু দূর থেকে দেখেছেন যাঁরা, তাঁদেরও মনে পড়তে বাধ্য— তখনকার খবরকাগজে হররোজ নিয়ম করে বেরোত পাক সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান বা পিপিপি-র চেয়ারম্যান জ়ুলফিকার আলি ভুট্টোর কার্টুন, ঠিক এই রকম। বিশেষ করে বলতে হয় চণ্ডী, অমল, সুফি, রেবতীভূষণ, কুট্টির ইয়াহিয়া-চিত্রণ, কালি-কলমের মিনিম্যালিস্ট আঁচড়ে গণহত্যার কারিগরের দুর্বৃত্ত আত্মাটাকে টেনে বার করে আনতেন ওঁরা। একাত্তরেই কামরুল হাসান এঁকেছিলেন ইয়াহিয়ার দানবীয় মুখের ক্যারিকেচার-পোস্টার, তলায় লেখা ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’, ‘কিল দিজ় ডিমনস’। শহিদ মিনারে প্রদর্শনী হয় সেই পোস্টার-ছবির, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ কপি ছাপা হয়, ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বে। কলকাতার সরকারি আর্ট কলেজের একদা ছাত্র, গণনাট্য আন্দোলন ও ফ্যাসিবিরোধী লেখক-শিল্পী সঙ্ঘের আদর্শে উদ্দীপ্ত, তরুণ বয়সে গুরুসদয় দত্তের ব্রতচারী মন্ত্রে দীক্ষিত, বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার চূড়ান্ত রূপকার কামরুল হাসানের সেই মুক্তিযুদ্ধ-চিত্রকৃতি পদ্মাপার বুকে করে রেখেছে, আজকের গাঙ্গেয় বাঙালিরা তাঁকে জানেন কি?
দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় বেন জেনিংস ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে এই সে দিনও এঁকেছেন যে কার্টুনটি, সেও তো ভাবে-ভাষায় মিলে যায় একাত্তরে যুগান্তর পত্রিকায় অমল চক্রবর্তীর আঁকা মুক্তিযুদ্ধের কার্টুনের সঙ্গে! ইউক্রেনের জাতীয় পতাকার রং হলদে-নীল, সেই রঙের পোশাক পরা এক কিশোরী উঠে পড়েছে ট্যাঙ্কারের লম্বা বন্দুক-নলের উপরেই, গুলতি তাক করে আছে সুরক্ষিত রুশ সৈন্যের দিকে। ট্যাঙ্কারের পাল্টা গুলতি, স্বপ্নেও কদাপি সমকক্ষ নয়। কিন্তু ওই অসামঞ্জস্যেই তো লুকিয়ে কার্টুনিস্টের কল্পনা: বৃহতের বিরুদ্ধে ক্ষুদ্রের স্পর্ধা, সাঁজোয়ার বিরুদ্ধে গেরিলার সাহস! অমলও ইয়াহিয়াকে আঁকেন ধারালো নখ আর বিরাট লেজওয়ালা অতিকায় এক ডাইনোসর রূপে, আর তার মাথায় বসিয়ে দেন এক মুক্তিযোদ্ধাকে, স্রেফ একটা লাঠি হাতে যে দানবের সঙ্গে লড়তে এসেছে, প্রাণের তোয়াক্কা না করেই!
কার্টুনিস্ট কী দেখেন? সমাজে, রাজনীতিতে, চার পাশে ঘটতে থাকা অসঙ্গতি। ঠিক হচ্ছে না, বড় ভুল হয়ে যাচ্ছে কোথাও হররোজ, দিনের পর দিন— মগজের নিরন্তর খটকাগুলোকে চটজলদি কলমে তুলে ধরাটাই তাঁর কাজ। যে কোনও সময়েই এ একটা চ্যালেঞ্জ, কিন্তু যুদ্ধের মতো তোলপাড় করা একটা ঘটনার সময় তা হয়ে দাঁড়ায় কাজের চেয়েও বেশি কিছু, একটা ‘প্যাথলজিক্যাল’ দায়িত্ব। এ যেন হাসপাতালের সেই কর্মীটির মতো, একের পর এক লোকের আঙুলে ছোট্ট পিনপ্রতিম যন্ত্রটি ফুটিয়ে চলেছেন, রক্তপরীক্ষা হবে। পিঁপড়ের কামড়ের মতো একটু যন্ত্রণা, এক বিন্দু রক্ত মোক্ষণই কত কিছু বলে দেয় আখেরে। কার্টুনও তা-ই। বাঙালির দুর্ভাগ্য, খবরকাগজের কোনও মিউজ়িয়ম, কোনও ‘হল অব ফেম’ নেই। খানকয় বই-ই সম্বল, বাংলাদেশে মুনতাসীর মামুন ও চৌধুরী শহীদ কাদের দু’খণ্ডে প্রকাশ করেছেন কার্টুনে মুক্তিযুদ্ধ (প্রকা: কথাপ্রকাশ)— আনন্দবাজার পত্রিকা, হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড, দেশ, যুগান্তর, অমৃতবাজার, জয় বাংলা-সহ বাংলা-ইংরেজি ও বিদেশি পত্রপত্রিকায় ১৯৭১-এর মার্চ-এপ্রিল থেকে ডিসেম্বরে প্রকাশিত কার্টুনের নির্বাচিত সংগ্রহ। কথাসাহিত্য, সিনেমা, গণগান, চিত্রশিল্পের মতোই কার্টুনও ধরে রেখেছে মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর ইতিহাস— হাসি কান্না, হীরাপান্নায় জড়ানো। কত চরিত্র সেখানে, ইয়াহিয়া ভুট্টো বঙ্গবন্ধু ইন্দিরা গান্ধী নিক্সন মাও উ-থান্ট; কত ঘটনা: বাংলাদেশের গণহত্যা উঠে আসে কার্টুনে শকুনের পাল আর বছরশেষের সালতামামিতে স্তূপাকৃতি মড়ার মাথার খুলি গণনায় (তৃতীয়-চতুর্থ ছবি)। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চিনের পাকিস্তান-সমর্থন, আমেরিকার রাজনৈতিক দ্বিচারিতা, রাষ্ট্রপুঞ্জের নির্বিকার উদাসীনতা, শরণার্থী সমস্যায় বিব্রত পশ্চিমবঙ্গের হাল, স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে স্বীকৃতি আদায়ে ইন্দিরা গান্ধী ও তাঁর বিদেশমন্ত্রী সর্দার স্বর্ণ সিংহের পাশ্চাত্য-সফর, কী নেই! অংশুমান রায়ের সেই বিখ্যাত গান ‘শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি...’ কুট্টি অমর করে রাখেন দেশ পত্রিকার পাতায় আঁকা কার্টুনে (উপরে প্রথম ছবি)।
শুধু রাজনৈতিক সঙ্কট হিসেবেই যুদ্ধকে দেখে না, কোনও দিন দেখেনি কার্টুন। কী করে সমাজমনে ছায়া ফেলে যুদ্ধ, কী হয় রোজকার তেল-নুন-চাল-আলুর বাজারদর আর কাজে যাওয়া-বাড়ি ফেরাময় অতি সাধারণ জনজীবনে, তা-ও দেখায়। একাত্তরের কলকাতায় লক্ষ লক্ষ শরণার্থী, ক্যাম্পগুলিতে কলেরা আর আন্ত্রিকের প্রকোপ, সেই রোগভোগকেও কার্টুনের শরীরে মিশিয়ে নিয়েছেন বাংলার কার্টুনিস্টরা— যেমন কনজাংটিভাইটিস বা ‘চোখ ওঠা’কে বাঙালি কষ্ট সয়েও বরণ করে নিয়েছিল ‘জয় বাংলা’ নামে, অতিমানবিক অথচ অনায়াস সৌভ্রাত্রের নজিরে।
যুদ্ধের মধ্যেও উৎসব আসে। শিশুজন্ম হয়, বন্ধুর কাঁধে হাত রাখে বন্ধু, একাত্তরের মার্চেই মুক্তি পায় রাজেশ খন্না-অমিতাভ বচ্চনের আনন্দ। কার্টুনিস্ট সব দেখেন, খোঁজ রাখেন। একাত্তরের ইস্টার সানডের আগের দিন চণ্ডী লাহিড়ী আনন্দবাজার পত্রিকা-র পাতায় আঁকেন ইয়াহিয়ার ইস্টার-কেনাকাটা, দু’হাতে বাংলাদেশের মানুষের কাটা মুন্ডু। অগস্টে জন্মাষ্টমী, যুগান্তর-এ সুফি আঁকেন— ঝড়জলের রাতে ইয়াহিয়ার কারাগার থেকে নবজাতক বাংলাদেশকে বার করে নিয়ে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু! সেপ্টেম্বরে দুর্গাপুজো, অসুররূপী ইয়াহিয়াকে বিদ্ধ করতে ধেয়ে আসছে মহিষাসুরমর্দিনীর ভল্ল, গায়ে লেখা ‘বাঙলাদেশ’! প্রতিবেশীর দুর্দশা দেখে কোজাগরীর কার্টুনে পেঁচার পিঠে উড়ে আসেন স্বয়ং লক্ষ্মী; একাত্তরের অক্টোবরে শ্রী-সম্পদের দেবী নিজেই বাড়িয়ে আছেন দু’টি ভিক্ষাপাত্র, একটির গায়ে লেখা শরণার্থী সাহায্য, অন্যটির গায়ে বন্যাত্রাণ।
আবু আব্রাহাম, আর কে লক্ষ্মণ, সুধীর দার, কুট্টি-অমল-চণ্ডী-সুফিরা ভারত তথা বাংলায় যে কাজ করে গিয়েছেন, য়ুরি-আলেকসান্দররাও এ যুগের ইউক্রেনে বসে করছেন সেই কাজই। আমাদের অক্ষমতা, আমরা এঁদের শুধুই কার্টুনিস্ট হিসাবে দেখলাম, শিল্পী হিসাবে এঁদের, কিংবা ইতিহাসের উপাত্ত হিসাবে এঁদের কাজকে গ্রহণ করলাম না, চর্চা করলাম না সে নিয়ে। গুটিকয় শব্দ আর কালির আঁচড় যে কী অন্তর্ঘাত ঘটাতে পারে, ‘মিম’প্রেমী এই সময় কিন্তু জানে বিলক্ষণ। আজ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে মুক্তিযুদ্ধের সেই ফ্যাতাড়ুদের চর্চা শুরু হলে মন্দ কী!