দীর্ঘপ্রতীক্ষিত: বাইকুল্লা জেল থেকে ছাড়া পেয়ে সোমা সেন (ডান দিক থেকে দ্বিতীয়), তাঁর পরিবারের সঙ্গে, ১৭ এপ্রিল, মুম্বই। পিটিআই।
অনেক দিন পরিবারকে ছেড়ে থাকতে হয়েছিল সোমা সেনকে। নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির এই প্রাক্তন অধ্যাপককে ভীমা কোরেগাঁও মামলায় ২০১৮-র ৬ জুন গ্রেফতার করেছিল পুণে পুলিশ। দীর্ঘ ছ’বছর পরে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে জামিনে মুক্তি পেলেন তিনি।
এই মামলায় মোট ১৬ জন অভিযুক্তের মধ্যে এখনও কয়েক জন মুক্তির স্বাদ পাননি। ভারতীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে এই ধরনের মামলার তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী। এলগার পরিষদের এই মামলায় দেশবাসী সাক্ষী থাকলেন বিদ্বজ্জনদের প্রতিস্পর্ধার। প্রান্তিক ও দলিতদের লড়াইয়ে তাঁদের সঙ্গেই সাধারণ মানুষের সহমর্মিতার— রাষ্ট্রশক্তির প্রতিহিংসাপরায়ণতারও! আইনজীবী-মানবাধিকার কর্মী-কবি-সাংবাদিক-শিক্ষাবিদদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হল, তাঁরা নাকি সকলেই নিষিদ্ধ ঘোষিত সিপিআই (মাওবাদী) সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। এমনকি, তাঁরা নাকি দেশের প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার ষড়যন্ত্রেও জড়িত।
ম্যাসাচুসেটস-এর একটি ডিজিটাল ফরেন্সিক সংস্থা আরসেনাল কনসাল্টিং তাদের একাধিক রিপোর্টে জানিয়েছিল, অন্তত দুই অভিযুক্ত রোনা উইলসন ও সুরেন্দ্র গ্যাডলিংয়ের কম্পিউটারে স্পাইওয়্যারের মাধ্যমে ‘অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল তথ্যপ্রমাণ’ ঢোকানো হয়েছিল। অর্থাৎ এখনও অবধি মনে করার কারণ আছে, এই সব চক্রান্ত-প্রোথিত ‘তথ্যপ্রমাণ’-এর ভিত্তিতেই অভিযোগ আনা হয়েছিল যে, অভিযুক্তদের সঙ্গে মাওবাদী সংগঠনের যোগাযোগ রয়েছে কিংবা তাঁরা সরকার ফেলে দেওয়ার চক্রান্তেও জড়িত। আরসেনালের ওই রিপোর্ট ভারতের আদালতে প্রমাণিত হলে রাজনীতি-প্রশাসনের অনেককে নিয়েই টানাটানি হতে পারে, এমনই অনুমান।
ভীমা কোরেগাঁওয়ের ইতিহাসটা আজ যেন আরও জরুরি হয়ে উঠেছে। পুণের কাছে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছিল মরাঠা সেনা ১৮১৮-র ১ জানুয়ারি। মরাঠা সাম্রাজ্যের তৎকালীন অধিপতি ছিলেন পেশোয়া দ্বিতীয় বাজিরাও। ব্রিটিশদের কাছে হার মানতে হয় মরাঠা সেনাদের। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ব্রিটিশ বাহিনীর হয়ে পেশোয়ার বাহিনীকে পর্যুদস্ত করেছিলেন যাঁরা, তাঁরা ছিলেন মূলত মহার সম্প্রদায়ের মানুষ। তাঁরা কিন্তু সে দিন এই যুদ্ধকে ব্রিটিশ ও মরাঠাদের যুদ্ধ হিসেবে দেখেননি। তাঁদের কাছে এটা ছিল উচ্চবর্ণের মরাঠিদের বিরুদ্ধে নিম্নবর্ণ দলিতদের যুদ্ধ। উচ্চবর্ণের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে দলিতদের প্রতিবাদের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচিত হয় সে সময় থেকেই।
ভীমা কোরেগাঁও আরও বিখ্যাত হয়ে ওঠে সেখানে বি আর আম্বেডকরের পদার্পণের পরে। ১৯২৭-এর ১ জানুয়ারি সেখানে তাঁর সফরের পর থেকে প্রতি বছর দলিতরা যুদ্ধজয়ের স্মারক হিসেবে ওই জায়গায় আসেন। বহু মানুষের সমাগম হয়। ওই যুদ্ধের দ্বিশতবার্ষিকী পালনের জন্য ২০১৭-র ৩১ ডিসেম্বর সেখানে বড় আকারের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। কিন্তু কট্টরপন্থী মরাঠি সংগঠনগুলি ওই আয়োজনের তীব্র বিরোধিতায় নেমে পড়ে। তারই জেরে ২০১৮-র পয়লা জানুয়ারি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বাধে মহারাষ্ট্রের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। মারা যান এক দলিত যুবক। আহত হন বেশ কয়েক জন।
এই ঘটনার মাস পাঁচেকের মধ্যে মহারাষ্ট্র ও দিল্লি পুলিশ যৌথ অভিযান শুরু করে। প্রথম দিকে পুলিশের হাতে থাকলেও পরে এই ঘটনার তদন্তভার কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)-র হাতে যায়। পুলিশের অভিযোগ ছিল, সিপিআই (মাওবাদী) ও তাদের বিভিন্ন সংগঠন এই আয়োজনের মূলে ছিল। সেখানেই ওই সব মানবাধিকার কর্মী ও বিদ্বজ্জনের প্ররোচনামূলক ভাষণের পরে হিংসা ছড়িয়ে পড়ে। মোট ১৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়। তাঁদের মধ্যে ৯ জনকে ২০১৮-য় গ্রেফতার করে পুলিশ। ২০০০-এর জানুয়ারিতে এনআইএ তদন্ত শুরু করার পরে গ্রেফতার হন আরও ৭ জন। তাঁরা যাতে সহজে জামিন না পান তার জন্য ধৃতদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই কুখ্যাত ইউএপিএ-র বিভিন্ন ধারা প্রয়োগ করা হয়। যদিও অভিযুক্তেরা বিনা বিচারেই আটক রয়েছেন, এখনও শুনানি শুরু হয়নি।
এই ১৬ জনের মধ্যে অশীতিপর ফাদার স্ট্যান স্বামী জেল হেফাজতেই মারা যান। নবী মুম্বইয়ের তালোজা জেল থেকে ভিডিয়ো কনফারেন্সে হাতজোড় করে কাঁপতে কাঁপতে হাই কোর্টের বিচারপতিকে জেসুইট ফাদার জানিয়েছিলেন, জেলে তাঁর শরীর দ্রুত খারাপ হচ্ছে। তাঁকে যদি অন্তর্বর্তী জামিন দেওয়া না হয় তা হলে তিনি শীঘ্রই মারা যাবেন। কিন্তু বারে বারে ফাদারের জামিনের আর্জি নাকচ করে দেওয়া হয়েছে। ২০২১-এর ৫ জুলাই এই নিয়ে ফের শুনানি শুরু হওয়া মাত্র স্ট্যান স্বামীর আইনজীবী নাটকীয় ভাবে আদালতকে জানান, তাঁর মক্কেলের আর জামিনের প্রয়োজন হবে না। ওই দিন দুপুরে তিনি মারা গিয়েছেন।
সোমা সেন ছাড়া বাকি ধৃত ১৪ জনের মধ্যে এখনও পর্যন্ত জামিনে মুক্তি পেয়েছেন অশীতিপর তেলুগু কবি ও মানবাধিকার কর্মী ভারাভারা রাও, আমদাবাদ আইআইএম-এর প্রাক্তনী, অধ্যাপক আনন্দ তেলতুম্বডে, আইনজীবী তথা মানবাধিকার কর্মী সুধা ভরদ্বাজ, সমাজকর্মী ভার্নন গনজালভেস, অরুণ ফেরেরা। জনজাতির অধিকার রক্ষা নিয়ে আন্দোলনকারী মহেশ রাউত এবং সাংবাদিক তথা মানবাধিকার কর্মী গৌতম নওলাখাকে বম্বে হাই কোর্ট জামিনে মুক্তি দিলেও এনআইএ তাঁদের জামিনের বিরোধিতা করে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানিয়েছে। সেই আবেদনের শুনানি এখনও হয়নি। এরই মধ্যে হাই কোর্ট এই কারণে রাউত ও নওলাখার জামিনের আদেশ কার্যকর করার উপরে স্থগিতাদেশ দিয়েছে। ওই দু’জনের মধ্যে গৌতম নওলাখা বর্তমানে গৃহবন্দি রয়েছেন।
এই মামলায় যাঁরা এখনও জেলবন্দি রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে আছেন মহারাষ্ট্রে মানবাধিকার আন্দোলনের সুপরিচিত মুখ সুধীর ধাওয়ালে। তিনি সাংবাদিকও বটে। বন্দি সুরেন্দ্র গ্যাডলিং নানা মহলে সুপরিচিত। কারণ শুধু সামাজিক আন্দোলনকারীই নন, দলিত ও জনজাতির হয়ে আইনি লড়াই চালান সুরেন্দ্র। জেলে রয়েছেন রোনা উইলসন। কেরলের কোলাম জেলা থেকে আসা রোনা দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই নানা সামাজিক আন্দোলনে জড়িত হন। এঁরা ছাড়াও এলগার পরিষদ মামলায় এখনও জেলে রয়েছেন সাংস্কৃতিক তথা রাজনৈতিক কর্মী সাগর গোরখে, রমেশ গাইচর এবং জ্যোতি জগতাপ।
এই গোটা প্রেক্ষাপটে হাতে এল ভীমা কোরেগাঁও নিয়ে অলপা শাহের লেখা দি ইনকারসারেশনস/ভীমা কোরেগাঁও অ্যান্ড দ্য সার্চ ফর ডেমোক্র্যাসি ইন ইন্ডিয়া নামে বইটি। ভীমা কোরেগাঁওয়ের ঘটনাবলি নিয়ে ভারতীয় গণতন্ত্রের বেআব্রু দশাকে তিনি প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছেন। দলিত, জনজাতি ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষজনের অধিকারের লড়াই যাঁরা চালান, তাঁদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রশক্তি কী ভাবে আক্রমণ শাণায়, পরতে পরতে তার বিবরণ উঠে এসেছে অলপা-র এই গ্রন্থে।
একটি স্বাধীন দেশে কী ভাবে প্রতিস্পর্ধাকে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয় তা ভাবতে গিয়ে দার্শনিক রোজ়া লাক্সেমবার্গের সেই অসামান্য উক্তি মনে পড়ে যায়: “শুধুমাত্র সরকারের সমর্থকদের জন্য যে স্বাধীনতা, সেটা স্বাধীনতাই নয়... স্বাধীনতা শুধুমাত্র একটি দলের সমর্থকদের জন্য নয়, তা সংখ্যায় যত বড়ই হোক না কেন। বরং স্বাধীনতা সর্বদাই এবং প্রকৃত অর্থে তার জন্য, যে অন্য রকম করে ভাবে।” এ দেশে আজ অন্য রকম করে ভাবার লোক বড় কম।