Uniform Civil Code

শরিয়া পুরুষেরও প্রতিকূল

১৯৪৮ সালের ২৩ নভেম্বর তারিখে সংবিধান সভাতে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে যে বিতর্ক দেখা দেয়, তার মূল সুর ছিল আইনের সঙ্গে ধর্মের পৃথকীকরণ।

Advertisement

ওসমান মল্লিক

শেষ আপডেট: ২৪ জুলাই ২০২৩ ০৪:৪৪
Share:

—প্রতীকী চিত্র।

সম্প্রতি ২২তম আইন কমিশন একটি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি সম্পর্কে মতামত আহ্বান করেছে। এ পর্যন্ত প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ নাগরিক মতামত নথিভুক্ত করেছেন। আরও অনেক ব্যক্তি ও সংগঠন মতামত জানানোর জন্য আগ্রহ প্রকাশ করায় কমিশন অন্তিম তারিখ বৃদ্ধি করতে বাধ্য হয়েছে। প্রস্তাবিত কোনও আইনকে কেন্দ্র করে এমন প্রতিক্রিয়া বিরল। তবে হয়তো অপ্রত্যাশিত নয়, কারণ এই আইনটির দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।

Advertisement

১৯৪৮ সালের ২৩ নভেম্বর তারিখে সংবিধান সভাতে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে যে বিতর্ক দেখা দেয়, তার মূল সুর ছিল আইনের সঙ্গে ধর্মের পৃথকীকরণ। মুসলিমরা ধর্মের থেকে পারিবারিক আইনকে পৃথক করতে রাজি ছিল না, তাই বেশ কয়েকটি সংশোধনী আনে। বিহারের প্রতিনিধি হুসেন ইমাম বলেন, অভিন্ন দেওয়ানি বিধির দাবি যথার্থ ও বাঞ্ছনীয়, কিন্তু তা রূপায়ণের উপযুক্ত সময় সেটা নয়। তিনি এই আইন প্রণয়ন করার জন্য আরও কিছুটা সময় চান। মুসলিম পক্ষের আনা সংশোধনীর বিরোধিতা করতে গিয়ে সে দিন কে এম মুনশি বলেছিলেন, তাঁরা পারিবারিক আইন থেকে ধর্মকে ‘ডিভোর্স’ দিতে চাইছেন। এক দিকে নারী-পুরুষের সমানাধিকার, আর এক দিকে নাগরিকদের ধর্মাচরণের অধিকার, এই দু’টি দিকের ভারসাম্য রক্ষা কী ভাবে সম্ভব, এই প্রশ্নও সংবিধান সভাতে দেখা দেয়। কেননা, কোনও ধর্মই নারীকে সমানাধিকার দিতে রাজি নয়। তখনই ঠিক হয়, নাগরিকের ধর্মাচরণের অধিকার নিরঙ্কুশ হবে না, সরকার যুক্তিসঙ্গত কারণে ধর্মাচরণের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ আনতে পারবে। সেই সঙ্গে, ‘সেকুলার’ বিষয়গুলি— যথা, বিবাহ, বিবাহ-বিচ্ছেদ, খোরপোশ, উত্তরাধিকার, অভিভাবকত্ব, দত্তকগ্রহণ, উইল করা ইত্যাদি— নিয়ে আইন প্রণয়ন করার ক্ষমতা সংসদের হাতে থাকবে। এই ক্ষমতার বলেই ভারতের সংসদ হিন্দু কোড বিল পাশ করে, যার সঙ্গে হিন্দুশাস্ত্রের যোগ নেই বললেই চলে, যার ভিত্তি সাম্য ও ন্যায়নীতির উপরে, রোমান আইনের আদলে। ফলে হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন ও শিখ ধর্মের মেয়েদের সমানাধিকার আইনসম্মত ভাবে প্রতিষ্ঠিত হল।

মুসলিম পারিবারিক আইন, বা শরিয়া অ্যাক্ট, ১৯৩৭, মুসলমানদের সুন্না নির্ভর আইন, যার মূলে আছে কোরান ও হাদিশের নির্দেশ। এটি বিধিবদ্ধ (কোডিফায়েড) নয়। অতি সংক্ষিপ্ত এই আইনটিতে বলা হয়েছে যে, মুসলমানদের বিবাহ প্রভৃতি বিষয়গুলি শরিয়া অনুযায়ী পরিচালিত হবে। সেখানে মেয়েদের সমানাধিকারের প্রশ্ন নেই। এ ছাড়াও দেশে প্রচলিত আছে কিছু ধর্মীয় প্রথা, যেগুলিকে আইনের সমান মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। সেগুলিও নারীদের সমানাধিকার উপেক্ষা করে।

Advertisement

২১তম আইন কমিশন পারিবারিক আইনে নারীবৈষম্যের দিকগুলি উল্লেখ করে নিরসনের জন্য সুপারিশ করে। তবে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রণয়ন করে নয়, বরং পারিবারিক আইনগুলিকে সংস্কার করে বৈষম্য দূর করার কথা বলে। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও শরিয়া আইন মস্ত এক বাধা। যদিও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কয়েকটি দেশ শরিয়া আইনে পরিবর্তন এনেছে, তাতে মুসলিম মেয়েরা হয়তো বাড়তি সুবিধা পেয়েছে, কিন্তু তা সমানাধিকার নয়। যত দিন ধর্মশাস্ত্র-নির্ভর আইন থাকবে, তত দিন কোনও ভাবেই মেয়েদের সমানাধিকার দেওয়া যাবে না।

এই কথাটিই সে দিন সংবিধান সভার আলোচনায় উঠেছিল। আম্বেডকর, নেহরু, কে এম মুনশি প্রমুখেরা পারিবারিক আইনে ধর্মীয় বিধি অনুসরণের বিপক্ষে মত দেন। ফলে মুসলিম পক্ষের সংশোধনীগুলি বাতিল হয়, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি মূল সংবিধানের নির্দেশাত্মক নীতির অধ্যায়ে যুক্ত হয়। এই আইন প্রণয়নের ভাবী কালের সংসদের উপর ন্যস্ত হয়। ১৯৫৬-য় হিন্দু কোড বিল পাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ তার আওতায় চলে আসে। ফলে আগে সমানাধিকারের যে আন্দোলনটি ভারতীয় মেয়েদের আন্দোলন ছিল, সেটি শুধুমাত্র মুসলমান মেয়েদের হয়ে দাঁড়াল। শাহবানু মামলার সময় মুসলিম মেয়েদের অসহায়তার দিকটি বেআব্রু হয়ে পড়ে। এই মামলা-সহ বেশ কিছু মামলার রায় দিতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্ট অভিন্ন দেওয়ানি বিধির প্রসঙ্গটি সামনে আনে।

আজ প্রশ্ন উঠেছে, ভারতের মতো একটি বহুত্ববাদী দেশে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি ‘চাপিয়ে দেওয়া’ যায় কি? হয়তো কেন্দ্রের বর্তমান শাসক দল বিজেপি এই পরিবর্তন আনতে চেয়েছে বলেই এই প্রশ্ন আসছে। তবে আইনটি আনার নির্দেশ কিন্তু সংবিধানেই রয়েছে। বরং বলা চলে, একুশ শতকেও এক ব্যক্তি মুসলমান পরিবারে জন্মেছে বলেই তার উপর শরিয়া আইন ‘চাপিয়ে দেওয়া’ হচ্ছে। কেবল মেয়েদের প্রতি বৈষম্যের জন্যই শরিয়া আপত্তিকর, তা নয়। শরিয়া আইন কোনও মুসলমান পুরুষকেও তার নিজস্ব সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশের বেশি উইল করার অধিকার দেয় না। দত্তক নেওয়ারও অধিকার দেয় না। এগুলো চাপিয়ে দেওয়া নয়?

বহুত্ববাদের প্রসঙ্গ তখনই উঠছে, যখন মেয়েদের প্রতি অবিচার-অন্যায় প্রতিরোধের দাবি উঠছে। বহুত্ববাদ মানে কি তবে বহু ভাবে নারী-নির্যাতন বোঝায়? বহুত্ববাদী সংস্কৃতির সঙ্গে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির বিরোধ কোথায়? ফৌজদারি আইন-সহ বহু ক্ষেত্রে আমরা এক আইন মেনে নিয়েছি। সেখানে যদি বহুত্ববাদ ও বহু সংস্কৃতি অনুসরণে বাধা না আসে, দেওয়ানি বিধির ক্ষেত্রেই বা আসবে কেন? হিন্দু, মুসলমান বা জনজাতি, কেউই ধর্ম বা প্রথার নামে নারীর প্রতি বৈষম্য করার অধিকার পেতে পারে না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement