—ফাইল চিত্র।
কমলকুমার মজুমদার তাঁর বিখ্যাত গল্প ‘নিম অন্নপূর্ণা’-তে প্রবল ক্ষুধার যন্ত্রণা ভুলে থাকার জন্যে ছোট্ট দুই বোন যূথী এবং লতির খাওয়া-খাওয়া খেলার এক মর্মন্তুদ চিত্র এঁকেছিলেন। প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের উদ্দেশ্যে অতীতে গৃহীত বেশ কয়েকটা টেট (টিচার এলিজিবিলিটি টেস্ট)-এর নিয়োগ প্রক্রিয়া অসম্পূর্ণ থাকা সত্ত্বেও আগামী ১০ ডিসেম্বর, ২০২৩ আবার একটা টেট-এর আয়োজন দেখে ওই গল্পের কথা মনে পড়ে গেল।
ভুক্তভোগী মাত্রেই মানবেন যে, আমাদের রাজ্যে তথা গোটা দেশে যুবসমাজের বেকারত্বের যন্ত্রণা যূথী-লতির ক্ষুধার যন্ত্রণার চাইতে কোনও অংশে কম নয়। এক দিকে যখন প্রতি বছরই শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, অপর দিকে একই গতিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ ক্রমশ সঙ্কুচিত হচ্ছে। কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দফতরে প্রচুর সংখ্যক শূন্যপদ থাকা সত্ত্বেও নিয়োগের বিষয়ে তেমন তৎপরতা দেখা যায় না। এমনিতেই ২০০৪ সালের পয়লা এপ্রিল থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরিতে নিযুক্ত কর্মীদের ক্ষেত্রে সাবেক পেনশন ব্যবস্থা রদ করে দ্বি-স্তরীয় কন্ট্রিবিউটরি পেনশন চালু করেছে। তদুপরি, কোনও রকমে কাজ চালিয়ে নেওয়ার জন্যে প্রতিরক্ষা থেকে শুরু করে প্রশাসনিক নানা পদে চুক্তিভিত্তিক কর্মী নিয়োগ শুরু হওয়ায় কেন্দ্র সরকারে কর্মসংস্থানের সুযোগ অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। একই ভাবে পশ্চিমবঙ্গ সরকারও পুলিশ বিভাগে চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের দিয়ে কাজ চালিয়ে নিতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠায় রাজ্য সরকারি চাকরির সুযোগও প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট কম।
এতৎসত্ত্বেও, এ রাজ্যে যে কয়েকটি ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হল শিক্ষকতা। কিন্তু সেখানেও প্রতিবন্ধকতার শেষ নেই। আইনি জটিলতায় ২০১৪ সালের টেট-উত্তীর্ণ বহু চাকরিপ্রার্থী বিগত কয়েক বছর ধরে লাগাতার ধর্না-আন্দোলন করে যাচ্ছেন। ওই বছরের টেট-এর ভিত্তিতে যাঁরা চাকরিতে যোগদান করেছিলেন, তাঁরাও নিশ্চিন্ত নন। কারণ, মহামান্য হাই কোর্ট এক লপ্তে ৩৬ হাজার (পরে চাকরি-পূর্ব প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের বাদ দিয়ে ৩২ হাজার) শিক্ষকের চাকরি বাতিল করার পর সুপ্রিম কোর্টের স্থগিতাদেশের ফলে তাঁরা আপাতত চাকরিতে বহাল আছেন বটে, তবে মামলাটি পুনরায় হাই কোর্টে ফিরে এসেছে। ফলে ওই বছরে মেধার জোরে স্বচ্ছ ভাবে নিযুক্ত শিক্ষকদের ভাগ্য দুর্নীতির মাধ্যমে ঢুকে পড়া অযোগ্যদের সঙ্গে একই সুতোয় ঝুলছে।
এর পর ২০১৭ সালে যে টেট নেওয়া হয়েছিল, নানা আইনি জটিলতায় সেটিরও নিয়োগ সম্পূর্ণ হয়নি। এর পাঁচ বছর পর ২০২২ সালে ফের একটি টেট অনুষ্ঠিত হয়েছিল, কিন্তু এখনও পর্যন্ত সেটির নিয়োগের বিষয়টি এক চুলও এগোয়নি। এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে পর্ষদ সভাপতি জানিয়েছিলেন, টেট এবং নিয়োগ দু’টি ভিন্ন বিষয়। তিনি আরও পরিষ্কার করে বলেছেন, “টেট পাশ করা মানেই চাকরি নয়। ২০১৪ এবং ২০১৭ সালে পাশ করেছি বলে চাকরি দিতে হবে, এটা নিয়ম নয়। টেট হল যোগ্যতা নির্ণায়ক পরীক্ষা।”
তবুও ফি বছর কেন টেট-এর আয়োজন করা হচ্ছে? তিনি বলেন, মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার মতো প্রতি বছরই ‘টেট’ বাধ্যতামূলক। হয়তো তাই। কিন্তু সে ক্ষেত্রে আইনি জটিলতায় নিয়োগের বিষয়ে অপারগতা জানিয়ে তাঁর দফতর সুপ্রিম কোর্টের কাছে বাধ্যতামূলক বার্ষিক টেট-সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণটি পুনর্বিবেচনা করে প্রয়োজনভিত্তিক টেট নেওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করতেই পারে।
কারণ, প্রথমত, যে কোনও সরকারি চাকরির জন্যে ঘোষিত শূন্যপদের ভিত্তিতে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা গ্রহণ করা হয় এবং তারই ভিত্তিতে চূড়ান্ত মেধাতালিকা প্রস্তুত করা হয়। টেট-এর ক্ষেত্রে বিষয়টি কিঞ্চিৎ ভিন্ন। যে-হেতু ২০১৪ এবং ২০১৭-র টেট-এর ভিত্তিতে নিয়োগ এখনও অসম্পূর্ণ, তাই একমাত্র ওই দু’টি টেট-এর নিয়োগ সম্পূর্ণ হওয়ার পরই (আদৌ যদি কখনও সম্ভব হয়!) ২০২২ সালে অনুষ্ঠিত টেট পরীক্ষার ক্ষেত্রে ঠিক কতগুলি শূন্যপদে নিয়োগ সম্ভব হবে, তা নির্ভর করছে। একই ভাবে ২০২৩ সালে যে টেট হতে যাচ্ছে, বদলে যেতে পারে সেটির ঘোষিত শূন্যপদ। ফলে ২০১৪-পরবর্তী প্রতিটি টেট-এর মাধ্যমে ঠিক কত শূন্যপদ পূরণ হবে, সেটা নিশ্চিত নয়।
দ্বিতীয়ত, টেট-এ বসতে হলে এক জন প্রার্থীকে ২৫০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা ফি দিতে হয়। এ ছাড়া যাতায়াতের খরচ তো আছেই! আপাতদৃষ্টিতে এই খরচ সামান্য মনে হলেও বহু বেকার যুবক-যুবতীকে অনেক কষ্ট করে এই খরচটা মেটাতে হয়।
২০২২ সালের টেট-এ আবেদনকারীর সংখ্যা ছিল ছ’লক্ষ নব্বই হাজার, পরীক্ষায় বসেছিলেন প্রায় ছ’লক্ষ কুড়ি হাজার প্রার্থী। ২০২৩ সালের টেট-এ আবেদনকারীর সংখ্যা কিঞ্চিৎ কম। প্রতিবেদনের শুরুতে উল্লিখিত গল্পে কমলকুমার লিখছেন, “এ খেলার মধ্যে নিশ্চয়ই পেটভরা বা তৃপ্তির আনন্দ ছিল না, একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল তাদের দক্ষতার কারণে মা-বাবাকে গর্বিত করা।”
আইনি জটিলতা অতিক্রম করে স্বচ্ছ এবং দুর্নীতিমুক্ত নিয়োগ নিশ্চিত না করে শুধুমাত্র পরীক্ষার স্বার্থে পরীক্ষার আয়োজন যে আদতে কাউকে গর্বিত করবে না, এই সত্যটি উপলব্ধি করতে পারলেই সকলের মঙ্গল।