—প্রতীকী ছবি।
কিছু দিন আগে সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হল চল্লিশটি শব্দের একটি ছোট্ট চিঠি। এক জন শ্রমজীবী নারী লিখছেন, তিনি ক্যাবচালক, কাজের কারণে তাঁকে সারা দিন রাস্তায় থাকতে হয়। পাবলিক টয়লেটের সামনে পার্কিংয়ের জায়গা নেই। গাড়ি রাখলে পুলিশ ফাইন করে দেয়।
এরই মধ্যে সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে কানাডিয়ান নৃত্যশিল্পী, মডেল, অভিনেত্রী ও গায়িকা নোরা ফতেহির সাক্ষাৎকারের একটি অংশ। যে অংশে তিনি বলছেন, নারীবাদ জিনিসটা প্রাথমিক ভাবে ভাল, কিন্তু তার একটা সীমা থাকা দরকার। র্যাডিক্যাল নারীবাদ সমাজের সর্বনাশ করছে। নারী স্বাধীন হতেই পারেন, তাঁর পড়াশোনার অধিকার আছে, কাজেরও অধিকার আছে। কিন্তু সেই সবের একটা সীমা আছে।
পশ্চিমি আলোকায়ন আমাদের শিখিয়েছে মানুষ হবে স্বাধীন এবং স্বাবলম্বী। এই কথা অনস্বীকার্য যে, প্রযুক্তি নারীকে বহু ধরনের বন্ধন ও অধীনতা থেকে মুক্ত ও স্বাবলম্বী করেছে। যা-ই হোক, আমাদের উত্তর-আধুনিক বাস্তবতার দিকে তাকিয়ে দুটো মূল প্রশ্ন ওঠে। অধিকার কী? তার সীমা কত দূর? খুবই সাধারণ ভাবে অধিকারকে কিছু সুযোগ-সুবিধার সমষ্টি বলে মনে করা হয়, যা ব্যক্তির বিকাশের ক্ষেত্রে সহায়ক। এর সঙ্গে আর একটা বিষয় জুড়ে থাকে— তা হল স্বীকৃতি। অর্থাৎ, ব্যক্তির জন্য স্বীকৃত সুযোগ-সুবিধা। আর তার সীমা? যেখানে এই সুযোগ অপ্রতুল, সেইখানেই অধিকারের সীমা।
নারীর কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের অধিকার আছে। সংবিধানে স্বীকৃত যে লিঙ্গের ভিত্তিতে কোনও বৈষম্য চলবে না। এখন সেনার বিভিন্ন বাহিনীতে নারীদের যোগদান ফলাও করে উদ্যাপন করা হয়। রাজধানী শহরে কোনও মেয়ে বাস বা ট্যাক্সি চালালে তাও উদ্যাপিত হয়। খবর হয়। সেইখানে তাঁর অধিকার কী? পুরুষ সহকর্মীদের সমান বেতন পাওয়ার অধিকার। নিগৃহীত না হওয়ার অধিকার।
কিন্তু এটুকুই শেষ কথা নয়। শ্রমজীবী নারী কোনও একমাত্রিক অস্তিত্ব নয়। তাই, শুধুমাত্র সমান বেতন বা নিগ্রহ থেকে সুরক্ষাই শেষ কথা নয়। শ্রমজীবী নারীর ক্ষেত্রে অধিকার ব্যাপারটার অনেক প্রেক্ষিত আছে। শৌচালয় তার মধ্যে আরও একটা। যে নারী শহরে ক্যাব বা টোটো চালান, তিনি তাঁর পুরুষ সহকর্মীর মতো একটু ফাঁকা জায়গা দেখে গাড়ি দাঁড় করিয়ে, ঝোপের পাশে গাছের নীচে বা হাইড্রেনের উপর সুবিধামতো নিজেকে হালকা করে নিতে পারেন না। এই ক্ষেত্রে তাঁকে একটি শৌচালয়ই ব্যবহার করতে হয় এবং সেই কারণে শৌচালয়ের কাছাকাছি গাড়িটি নিয়ে যেতেই হয়, আইনের দৃষ্টিভঙ্গিতে যা আবার অপরাধ।
শহরে তবু শৌচালয় আছে, হাইওয়ে ধরে যেতে যেতে পেট্রল পাম্প পড়ে, কিন্তু মফস্সলের রাস্তা ও তার বাজারগুলিতে জরিপ করলে দেখা যাবে— কোথাও শৌচালয় নেই, কোথাও ব্যবহারের অযোগ্য, কোথাও একটি থেকে আর একটির দূরত্ব অনেক বেশি। ধরে নেওয়া হয়েছে— পুরুষেরা, অনাকাঙ্ক্ষিত এবং দৃষ্টিকটু ভাবে হলেও, কাজ চালিয়ে নেবে। আর, মেয়েদের বাজারে আসার তেমন দরকার নেই।
আবার শৌচালয় থাকলেই যে নারী তা ব্যবহার করতে পারেন, এমনও নয়। যে নারী পনেরো বা পঁচিশ কিলোমিটার দূর কোনও গ্রাম থেকে মফস্সলের বাজারে আসেন আনাজ অথবা মাছ বিক্রি করতে, দেখা যায় বাজারের শৌচালয় থাকা সত্ত্বেও, তিনি তা ব্যবহার করতে পারেন না। করতে গেলে হয়তো তাঁকে চাবির জন্য হাত পাততে হয় পাশের পান-দোকানির কাছে।
রাষ্ট্রীয় প্রকল্পের আওতায় গ্রাম, মফস্সল ও পুরসভায় যে শৌচালয়গুলি তৈরি হয়, সেগুলির প্রবেশের মুখ থাকে রাস্তার দিকে। গবেষণায় দেখা গেছে, শৌচালয়গুলির এমনতর অবস্থানের কারণে মেয়েরা সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা নিয়েও খোলা স্থানে গেছেন, তবু শৌচালয় ব্যবহার করেননি। এখন অবশ্য কোথাও কোথাও সামনে একটা কম উঁচু পাঁচিল তুলে দেওয়া হয়।
আমরা সারা বছর ‘জেন্ডার সেন্সিটাইজ়েশন’ নিয়ে সেমিনার-সিম্পোজ়িয়াম করি, কথা বলি। ‘জেন্ডার নিউট্রাল’ কমন টয়লেটের কথা ভাবি। রাজধানী শহরের বিভিন্ন এলিট কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে সেই সব ধারণা রূপায়িত হতে দেখি আর মনে করি নারীস্বাধীনতার ক্ষেত্র, লিঙ্গসাম্যের পরিসর বাড়ছে।
আর বাইরের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, নারীর গোপন ও স্বচ্ছ পরিসরটুকু সুনিশ্চিত করতে পারলে তাঁর অস্তিত্বের বিকাশের পথে অন্তত একটি অন্তরায় সরে যায়। তা হলেও তাঁর অধিকারের সীমার ওই লক্ষ্মণরেখার পরিধিটি বেশ খানিকটা বাড়তে পারে। সেই বিষয়ে আমরা কিছু ভাবছি কি?