প্রযুক্তি আমাদের এখন যেন খানিকটা স্মৃতির মতো শক্তিশালী করেছে। প্রতীকী ছবি।
আর কত টুকরো করবে? প্রতি মুহূর্তে কাটছি, টুকরো করছি, ছিন্ন করছি আমরা। অপরকে, নিজেকে। তাই এই জিজ্ঞাসা প্রযুক্তিবিদ ও প্রযুক্তিপরায়ণ ‘দাসানুদাস’ মানুষের প্রতি ছুড়ে দিতে ইচ্ছে করে। এই মানুষের দলে আমরা সবাই কম-বেশি আছি, আমি-তুমি-আমরা-তোমরা সবাই। আপাত নিরাপদ, আপাত নির্দোষ অভ্যাসবশত ঢুকে পড়েছি। বিশ্বাস হচ্ছে না?
পুজোর ছুটিতে বেড়াতে গিয়ে তোলা অজস্র ছবি কি সমাজমাধ্যমে আপলোডের সময় ‘ক্রপ’ করেননি? করেছেন, করেছেন। ভাল লাগবে বলেই করেছেন। আশপাশের যা কিছুকে অতিরিক্ত, অবাঞ্ছিত মনে হচ্ছে আপনার, ক্রপ করে বাদ দিয়েই তো কেন্দ্রে এনেছেন ঈপ্সিত অবয়ব। এই ছাঁটা-কাটার ফলে বাস্তব মুহূর্তের চেয়ে অন্য রকম হয়ে উঠল আপলোড করা ছবির মুহূর্ত। যেমন ধরুন সমুদ্রতীরে যে দোকানে চা, ডাব খেলেন সেটি এসেছিল ছবির এক পাশে। আকাশ-সমুদ্রের উদার ব্যাকগ্রাউন্ডে দোকানটা যেন বেমানান। যদিও স্নানের পর চা আর ডাব ভাল লেগেছিল, তবু ছবিতে কি রাখা চলে! তাই বাদ দেওয়া যাক। দেখবে যারা, ভাববে কী আশ্চর্য সমারোহে সমুদ্র ও আকাশে অপরিমেয় সৌন্দর্যে মিশে গেলেন আপনি! অসুন্দর, বেমানান কিচ্ছু নেই।
ছবির কথায় আর একটু জটিলতর পথে এগিয়ে যাওয়া যাক। এখন অনেকেই পারেন ফোটোশপের দুর্দান্ত কেরামতি। তাতে বাস্তব শরীর ছবিতে হয়ে ওঠে অপরূপ। কমিয়ে-চাপিয়ে যেমনটি চাই, তেমনটি করে তোলার আশ্চর্য সহজলভ্য কারিগরি। আপনি নিজেকে, অর্থাৎ নিজের ছবিকে কেটে-মুছে অপরূপ করে তুলছেন। শিল্পীর তুলির চেয়ে আলাদা এই পন্থা। সে তুলি কাগজে রেখা ও রং দিয়ে দেওয়ার পর নির্ভুল উদাসীনতায় মুছতে পারে না দাগ। ফোটোশপ পারে। কী নির্মোহ ও নির্মম এই ‘আনডু’ প্রক্রিয়া। যা করলাম, পছন্দ না হলেই মুহূর্তে মুছে ফেলা সম্ভব। ফলে, এ কায়দায় কাটতে কাটতে মুছতে মুছতে উদাসীন শয়তানের মতো এক সময় শুধু নিজের নয়, অন্যের ছবি-শরীরে জুড়ে দেওয়া যায় কত কিছু! নিজের শরীরের ছবি নিয়ে করেছেন বলে, অপরের শরীরের ছবি নিয়ে করার সময় অপরাধবোধ জাগে না। আত্মহত্যার অধিকার আর হত্যার অধিকার এক যেন! নিজেকে কাটতে পারেন ছবিতে, তাই অন্যকেও কেটে অন্যের সঙ্গে যোগ করতে পারেন সহজে। একের স্তন, অন্যের নিতম্ব, আর এক জনের মুখ, অন্য কারও পয়োধর! শুধু নারীশরীর কেন, দৃশ্যসুখকাতর যে কোনও লিঙ্গের মানুষ যে কোনও লিঙ্গের মানুষের ছবির কাটাকুটি দিয়ে তৈরি করে নিতে পারেন তাঁর ক্ষণকালীন সুখের উপকরণ! মানুষের শরীর নিয়ে হাতে করে বানানো সেই খেলনায় যদিও উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে মানুষের ছবি, তবু কি এই কাজে পারঙ্গম, এই সুখে রতিক্ষম ‘শিল্পী’রা ভার্চুয়ালের বাইরে আসল মানুষকে খেলনার উপাদানই ভাবতে শুরু করছেন ক্রমশ? হয়তো নিজের অজানতেই!
এই প্রক্রিয়ায় আমরা আর একটি জিনিস নিয়ে ক্রমশই ছিনিমিনি খেলতে খেলতে হয়ে উঠছি আশ্চর্য যন্ত্র। স্মৃতির আপন ধর্ম থেকে ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছি। টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে আমাদের স্মৃতির বোধ। স্মৃতিতে ধারণ করার জন্য তো বস্তুটিকে, অবয়বটিকে আমাদের ইন্দ্রিয়সমূহের সামনে খানিকটা সময় দাঁড়াতে দিতে হয় তার সমগ্রে। যখন ‘কার্টুন নেটওয়ার্ক’ এ দেশে আত্মপ্রকাশ করেছিল, তখন ‘রক্ষণশীল’, ‘সাবধানি’ মনোবিদদের কেউ কেউ জানিয়েছিলেন, অতি দ্রুত যদি চোখের সামনে দিয়ে চলে যায় দৃশ্যমান ছবির ফ্রেমগুলি, তা হলে তা স্মৃতিধার্য হয় না। শিশু-কিশোর দর্শকেরা এক অভ্যাস-বিপর্যয়ের শিকার হতে পারে। তারা কিছু দিনের মধ্যেই ‘দেখছি কিন্তু দেখছি না’ অভ্যাসের দাস হয়ে উঠবে। দ্রুত ধাবমান দৃশ্যাবলি তাদের কোনও কিছু দেখা-ভাবা ও মনে রাখার মানবিক-বৌদ্ধিক প্রক্রিয়া থেকে দূরে ঠেলে দেবে একটু একটু করে। তখন তারা আর দেখবে না, ভাববে না, মনে রাখবে না— সব কিছু তাদের চোখের সামনে দিয়ে বয়ে যাওয়া কার্টুনকল্পদৃশ্য বলে মনে হবে।
কথাটা অবশ্য আমরা পাত্তা দিতে চাইনি। শুচিবায়ুগ্রস্ত ভাবুকেরা তো চিরকালই নতুন প্রযুক্তির বিস্তারের সময় কত কী বলেন! সব শুনলে-ভাবলে হয়? কথাটা অবশ্য যে ফেলে দেওয়ার মতো ছিল না, বোঝা যাচ্ছে। ব্রাউজ় করার সময়ই তো দেখি কিন্তু দেখি না, মনেও রাখি না। চোখে দেখার চেয়েও মোবাইলের ফ্রেমে চোখ-রাখাই এখনকার অভ্যাস। দু’চোখে হিমালয়, কিংবা সাগর আর দেখি কত ক্ষণ! ক্যামেরার লেন্সে ‘জ়ুম’ করে নানা ভাবে ‘ক্যাপচার’ করার পর সমুদ্রতীরে কিংবা পাহাড়ের সানুদেশে আমাদের চোখ আটকে যায় মুঠোযন্ত্রে। এ আমাদের প্রযুক্তি-প্রদত্ত হাতের দর্পণ। আমার শরীর বসে আছে হিমালয়ের পায়ের তলায়, সমুদ্রের বালিতে আর চোখ আর মন চলে গিয়েছে মোবাইল-দর্পণে। আমরা নিজেকে টুকরো করে নিয়ে যোগ করে দিচ্ছি অন্য জায়গায় থাকা অন্য টুকরো মানুষের সঙ্গে।
এই টুকরো-যাপন আমাদের স্মৃতির সামর্থ্যকে বিনষ্ট করছে না তো! রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতি-তে স্মৃতির খামখেয়ালিপনাকে নির্দেশ করে লিখেছেন, স্মৃতি তার পটে কোন ছবিকে রাখবে আর কোন ছবিকে রাখবে না, তা কে বলতে পারে! প্রযুক্তি আমাদের এখন যেন খানিকটা স্মৃতির মতো শক্তিশালী করেছে। নিজেরাই ঠিক করছি কতটুকু দেখব ও দেখাব। তা করতে গিয়ে কি ক্রমশ স্মৃতি নামক সামর্থ্যকেই দুর্বল করে তুলছি! পরে, আপলোড করা ছবি ফিরিয়ে দিচ্ছে সমাজমাধ্যম। অতীতের ছবি দেখে খুশি হচ্ছি, স্মৃতির ছবি দেখে খুশি হওয়ারই কথা। কিন্তু ‘ক্রপ করা’, ফিরে আসা ছবি কতটুকু স্মৃতি ফেরাবে, তা আগেই কেটেকুটে ছবিটিকে ধরে রাখার সময় আমরাই ঠিক করে দিয়েছিলাম। আমাদের কারিকুরিবাহিত ছবি, নির্মম ভাবে কেটে রাখতে পারে স্মৃতির সামর্থ্য।
কেউ বলতেই পারেন স্মৃতিমেদুরতা তো রোগ, নস্টালজিয়া তো অসুখ বলেই বিবেচিত হত এক সময়। কারণ, স্মৃতিতে ফেরা যায় না, বরং স্মৃতিতে আটকে থাকলেই বর্তমান ও ভবিষ্যৎ উপভোগ করা অসম্ভব। স্মৃতিকাতরতা, স্মৃতিতে আটকে থাকার বিপর্যয় এক জিনিস আর স্মৃতির সামর্থ্যহারা প্রতি মুহূর্তে এক উপকরণ থেকে অন্য উপকরণের দিকে মনকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া আর এক জিনিস।
‘উপকরণ’ কথাটির অর্থ গভীর। উপকরণ বলতে কি কাজের, করণের বস্তুকে বোঝায় শুধু! মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কে কি মানুষই আজকাল মানুষের উপকরণ! পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় গতর খাটানো কর্মী-শ্রমিক যে নিতান্ত নামহারা শ্রমের বিচ্ছিন্ন উপকরণ হয়ে উঠছেন, এ নিয়ে আলোচনা অনেক দিনের। কিন্তু মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কেও কি পরস্পর পরস্পরকে উপকরণ করে তুলছি আমরা! অনেক ক্ষেত্রে দু’জনে দু’জনকে হয়তো, নয় এক জনের কাছে অপর জন হয়ে উঠছেন নিতান্ত উপকরণ। যিনি উপকরণ হয়ে উঠছেন তিনি পুরোটা বুঝে উঠতেও হয়তো পারছেন না। যে ভাবে ফোটোশপে খেলনা বানাচ্ছি আমরা তেমনই মানুষকে, বাস্তব মানুষকে, বানিয়ে তুলছি খেলনার উপকরণ। সেখানে সম্পর্কের প্রেম কিংবা লিভ ইনের খোলস আছে। তবে সে সম্পর্ক এক আশ্চর্য হিমঘর। সেই হিমঘরে যে কোনও মুহূর্তে ছবিকে কাটার মতো কেউ টুকরো টুকরো করতে পারে আপনাকে— নানা অর্থে। পুরো মানুষটিকে না নিয়ে দায়িত্বহীন উপভোগ্য মুহূর্তটি কিছু কাল কেটে রেখে ভোগ করে স্মৃতিহীন নির্মমতায় আপনাকে বাতিল করে দিতে পারে। যে ভাবে বাতিল যন্ত্রের উপকরণের অপ্রয়োজনীয় অব্যবহৃত অবয়ব পড়ে থাকে বাতিলঘরে, সে ভাবে সম্পর্কের হিমঘরে টুকরো টুকরো আপনি। স্মৃতিকাতরতা নেই, স্মৃতিস্পর্শ নেই। ইচ্ছে হলে বাতিল মালের ঘরে ঢুকে টুকরো করে রাখা যন্ত্রাংশ দেখে নেওয়া যেতে পারে, স্মৃতির খাতিরে নয়, অভ্যাসের হঠাৎ কৌতুকে।
রবীন্দ্রনাথের গানে ছিল তবু মনে রাখার আকুতি। সে আকুতি প্রাক্তনের কাতর অভিমানমাত্র নয়, সে আকুতি নিতান্ত মানবিক। এক সম্পর্ক থেকে অন্য সম্পর্কে চলে যেতেই পারে মানুষ, তার হাজারটা কারণ-অকারণ থাকতে পারে। সেই চলে যাওয়া মেনে নেওয়াই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও আত্মমর্যাদার লক্ষণ। কারণ অনিচ্ছুক মানুষের সঙ্গে সংলগ্ন থাকা যায় না! কিন্তু সেই চলে যাওয়ার অর্থ আগের যাপন ও স্মৃতিকে অস্বীকার করা নয়। সম্পর্ক যখন হিমঘরে স্মৃতিহীন টুকরোয় পর্যবসিত, তখন এক জনের কাছে অন্য জন উপকরণ মাত্র, মনের ও চোখের বাইরে থাকা ভার্চুয়ালের বাস্তবরূপ শুধু, কিংবা বাস্তব হয়েও ছায়াবাস্তব। তখন টুকরো করে ফেলাই যায় তাকে যে কোনও সময়। স্মৃতিহীন হয়ে বাইরে এসেই আবার মজে যাওয়া সম্ভব নতুন খেলনায়। সে বড় ভয়ঙ্কর— স্মৃতির মৃত্যু যে মৃত্যুরও মৃত্যু। নির্ভেজাল নিরামিষ খেলার মতো ছবিকাটার প্রযুক্তি ও অভ্যাস কি তবে দানবীয় ভয়ঙ্করের রুদ্ধগৃহের মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে আমাদের— যেখানে মৃত্যুরও মৃত্যু হয়েছে?
বাংলা বিভাগ, বিশ্বভারতী