পাকিস্তানের বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী তাহিরা আবদুল্লা। ফাইল চিত্র।
খেলা মেলা কার্নিভালের মোচ্ছবময় জীবনে যথাসম্ভব গা-বাঁচিয়ে চলা আমরা যে কোনও বিপদে ত্রাতা মধুসূদনের মতো বুদ্ধিজীবীর শরণাগত হই, শীতল রক্তের প্রাণীর মতো কোন অসময়ে তাঁরা শীতঘুমে তলিয়ে গেলেন, এই নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় মিম সক্রিয় হয়ে ওঠে। তখন মনে পড়ে না যে, দায়বদ্ধ বুদ্ধিজীবী আর সাধারণ বুদ্ধিজীবীর তফাত আছে। হাতে কলম থাকলেই স্থিতাবস্থার বিপক্ষে, স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রশ্ন ওঠানোর সাহস হয় না। বিশেষত বর্তমানে যখন প্রকাশ্য চেতাবনির মতো ঘোষিত হয়— সমালোচনার কলম তোলা নাশকতার মাইন পোঁতার মতোই সমান অপরাধ, তখন কি আতঙ্কের চোরা স্রোত হাড়ে কাঁপন ধরিয়ে দেয় না? সে কাঁপন ঠেকিয়ে শঙ্খ ঘোষের মতো ক’জন কবি পথে, মিছিলে নেমে যেতে পারেন? বুদ্ধিজীবী মানেই দায়বদ্ধ ভেবে নিয়ে গণহারে কবি গদ্যকার নাট্যকর্মী চিত্রশিল্পীদের সমাজের মুখপাত্র ভাবলে গুলিয়ে যায় সব। ‘পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল’-এর প্রতিনিয়ত প্রশ্ন করার ঐতিহ্য যেমন প্রাচীন, বুদ্ধিজীবীর রাজানুগ্রহের ইতিহাসও সুপ্রাচীন।
চূড়ান্ত প্রতিকূল পরিস্থিতিতে এমনই এক রুখে দাঁড়ানো মানুষ ইসলামাবাদ নিবাসী পাকিস্তানের বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী তাহিরা আবদুল্লা (ছবিতে)। বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা নিয়ে বলতে গিয়ে পাকিস্তানের সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয় বাংলাদেশ বিষয়ে বলেন, “অনেকেই জানেন পাকিস্তানের দু’এক জন কবির প্রতিবাদের কথা। কিন্তু শুধু এই কবিরা নন, আমরা গর্বিত যে পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের সময় সাংবাদিক, নারী অধিকার রক্ষা কর্মী, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সাধারণ নাগরিক পথে নেমে প্রতিবাদ করেছিলেন। সে সময় সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না বলে সহজে দেশের বাইরের লোকের চোখে পড়েনি তা। পাকিস্তানের মানবাধিকার মোটেই সোনার পাথরবাটি নয়। যে সময়ে পাকিস্তানে কঠোর সামরিক শাসন চলছে, কিছু মানুষ জীবনের কতটা ঝুঁকি নিয়ে এই কাজ করেছিল ভাবো?”
এই দু’এক জন কবির মধ্যে অবধারিত ভাবে আছেন ফৈজ় আহমেদ ফৈজ়। জিন্নার স্বপ্ন চুরমার করে পাকিস্তান পাকাপাকি ভাবে একটা অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হলে স্বাধীনতার কয়েক বছর বাদেই যাঁকে দেশদ্রোহিতার কারণে কারারুদ্ধ হতে হয়। ফৈজ়, পূর্ব পাকিস্তানে ভয়ঙ্কর অত্যাচারের বিরুদ্ধে লিখলেন ‘হজর করো মেরে তনসে’। তীব্র ঘৃণায় তাঁর প্রতিবাদ ঠিকরে উঠেছিল, “সাজতেই যদি হয় কী করে সাজবে বলো তো, গণহত্যার এই মেলা/ বলো তো প্রলোভিত করবে কাকে আমার রক্তের এই আর্তনাদ।” ঢাকাতে শৈশব প্রথম যৌবন কাটানো কবি আফজ়ল আহমেদ সৈয়দ নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে ঢাকা ছেড়ে পালিয়ে এসেছিলেন। পাকিস্তানের মাটিতে বসেই লিখলেন এক সাধারণ বাংলাদেশি মেয়ের কথা। “তার দরিদ্র দেশ/ দ্বিতীয়বার স্বাধীন হয়েছে/ সে দুনিয়ার সব্বাইকার/ থেকে বেশি স্বাধীন এবং বেশি খুশি।” (অনুবাদ ঋণ: নীলাঞ্জন হাজরা)
তাহিরা বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের বর্বরতা, গণধর্ষণের খবরে পাকিস্তানের নারী অধিকার সংগঠন উইমেনস অ্যাকশন ফোরাম (ডব্লিউএএফ) দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক মঞ্চে প্রকাশ্যে বাংলাদেশের নারীদের কাছে ক্ষমা চায়। “একাত্তরের অমানবিক এবং বেআইনি কাজের জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে আমরা পাক সেনা এবং রাষ্ট্রের উপর ধারাবাহিক চাপ তৈরি করে যাচ্ছি।”
নারী অধিকার বিরোধী সরকারের সমালোচনায় তীব্র মুখর তাহিরা। দেশের ভিতরেই টেলিভিশনে পুরুষ প্রশ্নকর্তাটিকে তীক্ষ্ণ তিরস্কারে বলেন, নারীবাদ একটি সংগঠনের নাম নয়— সেটা এক বিপ্লবী দৃষ্টিভঙ্গি। পাক সংবিধানে নারীর ন্যায়বিচারের অধিকার আছে, আইন হয়েছে— কিন্তু আইন প্রণয়নই তো যথেষ্ট নয়, তা কার্যকর করা প্রয়োজন।
বলি, শুনেছি যে সব সরকারই আপনাকে ‘বিশেষ নজরে’ দেখেন! উত্তরে তিনি বলেন, “গত চল্লিশ বছরে আমাকে যে এরা সহ্য করেছে এই অনেক।” সত্যিই। লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস, অপমান, প্রতিটি সরকারের আমলে গ্রেফতার, কিছুই আপনাদের মতো অনেককে দমাতে পারেনি তাহিরা। আপনিই বলছিলেন, আপনার মায়ের জন্ম ১৯২৯ সালে কলকাতায়, প্রবল ইচ্ছা থাকলেও যেখানে তিনি আর ফিরে আসতে পারেননি। মায়ের মুখে কলকাতার পথেঘাটে প্রতিবাদের হাজারো গল্প শুধুই আপনার স্মৃতিতে।
না, প্রতিবাদ বড় সহজ কথা নয়, সকলের কথাও নয়। কবি গালিব ইংরেজদের হাতে ভাইয়ের মৃত্যু, লাঞ্ছনা, মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করেও দস্তম্বু-তে শুধু ইংরেজ সরকার নয়, সৈন্যদেরও প্রশংসা করেন। মহারানি ভিক্টোরিয়ার উপর দীর্ঘ প্রশস্তিমূলক কাসিদা লিখে বই সমাপ্ত করেন। আন্দামানের সেলুলার জেলে দীর্ঘ সময় বন্দি থাকা বারীন্দ্রকুমার ও উল্লাসকরেরা থেকে যান ইতিহাস বইয়ের পাতায়, আর স্বাধীনতা-উত্তর দেশে বিদেশি শাসককে মুচলেকা দেওয়া সাভারকর বীরগর্বে ঝলমল করেন। আর, দায়বদ্ধ বুদ্ধিজীবী আর অবন ঠাকুরের আলোর ফুলকি-র বুদ্ধিজিভী নিয়ে আমরা আম আদমি বিভ্রান্ত থেকে যাই।