এক কথায় স্বামী বিবেকানন্দ শিবসাধক, বৈদান্তিক সন্ন্যাসী। তাঁকে সে ভাবে শক্তিসাধক শ্রীরামকৃষ্ণের যোগ্য উত্তরসাধক বলা যাবে না। শ্রীরামকৃষ্ণের সাধনার প্রতিনিধি নেই। তিনি অনন্য। তাঁকে শক্তিসাধক বলি এই কারণে যে, তন্ত্রের সব বিভাগে তাঁকে সাধনা করতে হয়েছে, এমনকি মারণ, উচাটন, বিভূতি লাভ, সব হয়েছে। তিনি সে সবের প্রয়োগ করেননি। গুরু ভৈরবী ব্রাহ্মণীর প্রখর নির্দেশনায় কেবল তন্ত্রের মাধ্যমে চৈতন্যশক্তির জাগরণ হয়েছে। তাঁর কাছে তন্ত্র ও বেদান্তের সাধনার ফল একই। অন্য দিকে, স্বামীজির উপাস্য উমানাথ, সর্বত্যাগী শঙ্কর, মন্ত্র ছিল ‘শিবোহম্’ আর লক্ষ্য ছিল পূর্ণ মনুষ্যত্ব ও তার পরে দেবত্বের স্ফুরণ।
সে যুগে ব্রাহ্ম আন্দোলন বা রেনেসাঁসের কর্তারা সদাচার-সংস্কৃতির উজ্জীবন চেয়েছিলেন। তাঁদের ভিত্তিমূলটি ছিল বিদেশে। রবীন্দ্রনাথও ১৯১৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি চিঠিতে জামাতা নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে লিখেছেন: “দুর্ভাগ্যক্রমে এতকাল ব্রাহ্মসমাজ আমাদের জাতীয় জীবনের সঙ্গে আপনাকে বিচ্ছিন্ন বলে পরিচয় দিয়ে এসেছে... সমস্ত দেশের সঙ্গে আমাদের নাড়ির যোগ স্বীকার করে স্বদেশের মধ্যে আমাদের স্থান গ্রহণ করতে হবে।... সেই স্থান ছেড়ে দিয়ে খৃস্টানের পোষ্যপুত্র হতে গিয়েছিলুম বলেই আজ বিবেকানন্দের দল ব্রাহ্মসমাজকে একপাশে সরিয়ে ফেলে দিয়ে দেশের হৃদয়ে সমস্ত জায়গা সম্পূর্ণ জুড়ে বসবার উপক্রম করছে... মাটিকে নীচ জ্ঞান করে মাটির থেকে শিকড় তুলে নিলে গাছ কোনো দিন বাঁচতে পারে না... অতএব কাজ হচ্ছে স্বদেশের হৃদয়ের মধ্যে ব্রাহ্মসমাজকে প্রতিষ্ঠা করে তার লক্ষ্মীছাড়া বাপ-মা মরা ভিক্ষুকদশা ঘুচিয়ে দেওয়া।”
আসল কথা এই, অধ্যাত্মচেতনার স্পর্শ ছাড়া কোনও সংস্কৃতি কেবল সদাচারকে আশ্রয় করে বাঁচতে পারে না। প্রাচ্যে বা পাশ্চাত্যের অবসাদক্লিষ্ট মানুষ অধ্যাত্মভিত্তির জন্যই স্বামীজিকে চান। তিনি শিবচেতনার, শক্তিমহিমার— দেবত্বের প্রচারক, বলেন: মানুষের অন্তর্নিহিত দেবত্বের বিকাশসাধনই তাঁর জীবনের লক্ষ্য। সব কাজের মাধ্যমে এই সুপ্ত দেবতার ক্রমবিকাশ ঘটবে। শুদ্ধ কাজ চাই, অলস চিন্তা নয়। বিবেকানন্দের বেদান্ত খুব সহজ, সরল। দেবতাকে থাকতে হলে এই জগতেই থাকতে হবে। বস্তুত তিনি জগতেই আছেন, প্রতিটি জীবে, প্রতিটি ধূলিকণায়— জীবই শিব। এই ‘শিবত্ব’ই জগতের সব কিছুকে যুক্ত করেছে অচ্ছেদ্য বন্ধনে, বহুরূপে সম্মুখে তোমার, সেই দেবতাকে ছেড়ে অন্য কোথায় ঈশ্বরকে খুঁজে বেড়াও! শিবের অন্বেষণ জীবের ভিতরেই করতে হবে। মানুষের জন্য যে কাজ, সে কাজ এই শিবত্ববোধে করলে কোনও জীবিকাই শাসন, শোষণ, বঞ্চনার মধ্যে সাধিত হতে পারে না। অদ্বৈত বেদান্ত এই ধর্মই শেখায়। আমরা তা বুঝতে না পেরে তাকে মিথ্যা, জীবনবিমুখ বলে প্রত্যাখ্যান করেছি। ব্রহ্মই চৈতন্য, আর তা সত্য, সেই সত্যে জগৎ প্রতিষ্ঠিত। শিক্ষক ভাববেন, ছাত্রদের ভিতর ‘হরি’ আছেন; তাদের পড়ানোর সময় এ বিশ্বাস সঙ্গে থাকলে পড়ানোর ‘কাজ’টা ‘পূজা’য় পরিণত হয়। এই বোধে স্বার্থপরতার ভাবটি মন থেকে একেবারে চলে যায়, আমরা নিঃস্বার্থ ও সহমানুষের সুখ-দুঃখের ভাগী হই, আমাদের জীবিকা তখন হয়ে ওঠে মানুষ ও দেবতার মিলনভূমি।
বিবেকানন্দ ছিলেন এই তত্ত্বের সিদ্ধপুরুষ। ‘সেবা’ তাঁর কাছে ‘মুক্তি’র উপায় হয়েছে। তাঁর পক্ষেই তাই ভারত-উদ্ধারের বার্তা বয়ে আনা সম্ভব। তিনি তা করেছেনও। সেই সময়ে পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির কাছে আমরা মাথা বিকিয়ে দিয়েছিলাম, ফলস্বরূপ ভয়ানক দারিদ্র, দুর্ভিক্ষ, অশিক্ষা নিয়ে ছিলাম। আত্মশ্রদ্ধা, আত্মবিশ্বাস বলে কিছু ছিল না। দেশ ছিল লজ্জিত, আত্মগ্লানিতে দীর্ণ।
তাঁর জয়ে ও কর্মে ভারত জেগে উঠল নূতন এক ধর্মে। সে ধর্ম কাউকে পাপী বলে না। শিকাগোয় বিশ্ব-ধর্মমহাসভায় তাঁর ওই বক্তৃতার আগে, ১৮৯৩-এর আগে ‘হিন্দুধর্মচিন্তা’-র কোনও সংজ্ঞা ছিল না— বৈষ্ণবরা বলতেন তাঁরাই হিন্দু, শাক্তরাও তা-ই দাবি করতেন। ত্যাগ ও সেবার আদর্শে, বেদান্তের আলোয় তিনি হিন্দুধর্মকে বোঝালেন, প্রতিষ্ঠা দিলেন। তিনি শ্রদ্ধা শিখিয়েছেন, কর্ম শিখিয়েছেন (কর্ম বা জীবিকাকে শুদ্ধ করলেই সত্য অর্জনের দ্বার খোলে), ত্যাগ শিখিয়েছেন (আমরা ভোগের দ্বারা ত্যাগ বুঝে নিয়েছিলাম, কিন্তু বিবেকানন্দের রামকৃষ্ণ নামাঙ্কিত সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠার মূলে ছিল সত্যিকারের ত্যাগ কী তা দেখানো, পরার্থে সব বিসর্জন, সবর্তো ভাবে স্বার্থত্যাগ), সেবা শিখিয়েছেন (সেবাযোগ তাঁর মনমতো সাধনপথ, গীতায় কর্মযোগ যে ভাবে ব্যক্ত হয়েছে তা অনেকেই বোঝেন না)।
আমরা বিবেকানন্দকে চাই কেন? বিপদে পড়লে আমরা পুলিশ ডাকি। কিন্তু লোভ, কামনা, ক্রোধের বশবর্তী হয়ে যখন নানাবিধ কুকাজে লিপ্ত হয়ে পড়ি, তখন কাকে ডাকব? কে পরিত্রাতা? আজ যখন আমাদের ব্যক্তিধর্ম কুৎসিত আকারে প্রকাশিত হয়ে নিজের ও অন্যের সর্বনাশ ডেকে আনছে, তখন দাঁড়াবার জায়গা কোথায়? দাঁড়াতে হবে স্বামীজির মহাজাগতিক ধর্মের দুয়ারে। মানুষের কোনও পতনেই তাঁর বিকার নেই, আছে অনন্ত প্রয়াস— মানুষকে তার স্তর থেকে উপরে তোলার, ওঠানোর। এ-ই তাঁর কাজ, এ না হলে তিনি থামবেন না। তাঁর প্রাসঙ্গিকতা বুঝতে পারলে চার পাশের অনেক কিছুরই অপ্রাসঙ্গিকতা ধরা পড়ে যায়।