স্বপ্ন: ২০৪৭ আসতে আসতে দেশের সব মানুষ পেট ভরে খেতে পাবে।
ভারতবর্ষের স্বাধীনতার শতবর্ষে বেঁচে থাকলে আমার বয়স হবে সাতানব্বই বছর। ‘অমৃতকালের’ মহিমায় ব্যক্তিগত অমরত্বের আশা নেই, ইচ্ছাও নেই। কিন্তু দেশটা থাকবে, থাকবে পরবর্তী প্রজন্মেরা। তাদের হয়ে আমিও কিছু স্বপ্ন দেখি। লিখতে বসে মনে হচ্ছে, এ যেন স্কুলছাত্রের ‘আমার আদর্শ রাষ্ট্র’ নিয়ে রচনা। সকলে আমার ছেলেমানুষি কৃপার চোখে দেখবেন।
প্রথমে একটা সহজ স্বপ্ন। রাষ্ট্রপুঞ্জের রিপোর্ট বলছে, ২০২০-তে ভারতে চার বছরের কমবয়সি শিশুদের ৩১% ছিল বাড়ে কম (স্টান্টেড), ১৭% ওজনে কম (ওয়েস্টেড)। ওজনে ২০১৪ থেকে ২০২০-র মধ্যে অবনতি ঘটেছে। ২০১৬-তে পাঁচ থেকে উনিশ বছরের ২৭% শিশু-কিশোর ছিল অপুষ্ট, ২৪% নারী ওজনে কম। ২০২১-এর বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে (গ্লোবাল হাঙ্গার ইন্ডেক্স) সোমালিয়া ইয়েমেন মধ্য-আফ্রিকা প্রমুখ মাত্র চোদ্দোটি দেশের অবস্থা ভারতের চেয়ে খারাপ— দক্ষিণ এশিয়ার একটিরও নয়। স্বপ্ন দেখা যাক, ২০৪৭ আসতে আসতে দেশের সব মানুষ পেট ভরে খেতে পাবে।
অমৃতের মহোৎসবে ভাত-ডাল-দুধের কথা বলতে সঙ্কোচ হয়; তবে কেউ তো বলছে না, অন্তত একটা নূতনত্ব হল। টাকার আনুপাতিক হিসাবে ভারতের অর্থনীতি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম, বাড়ছে সবচেয়ে দ্রুত। সকলের ভরপেট খাবার জোগানো অসম্ভব হওয়া উচিত নয়। গুদাম-উপচে-পড়া চাল-গমের রেশন যথেষ্ট উদ্যোগ বলা চলে না।
পরের স্বপ্ন: স্বাধীনতার একশো বছরে দেশের একশো ভাগ মানুষ লিখতে পড়তে পারবে। একশো বছরে মাত্র এইটুকু? আমাদের সংবিধান-রচয়িতারা সাদাসিধে মানুষ ছিলেন। তাঁরা ধরে নিয়েছিলেন, দশ বছরের মধ্যে দেশের সব ছেলেমেয়ে স্কুলে যাবে, লেখাপড়া শিখবে। সরকারের সদিচ্ছায় তাঁদের এতই আস্থা ছিল যে, ব্যাপারটা তাঁরা নির্দেশক নীতির স্তরে রেখে দিয়েছিলেন। নানা ব্যস্ততায় কাজটা হয়ে ওঠেনি। পঞ্চাশ বছর বাদে শিক্ষা হল সাংবিধানিক অধিকার। কিছুটা বরফ গলল। ২০২০-তে অষ্টম শ্রেণি অবধি প্রায় ১০০ ভাগ ছেলেমেয়ে স্কুলে যাচ্ছিল। ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা যাচ্ছিল বেশি।
তার পর এল অতিমারি। ঠিক কতটা ধস নামল কেউ জানে না। তবে বিপুল সংখ্যক ছেলেমেয়ে আজ স্কুলছুট— রোজগারের তাগিদে, বিয়ে হয়ে, পাচার হয়ে, নিছক হতোদ্যম হয়ে। যারা রয়ে গেছে, তাদের শিক্ষার ঘাটতি বিপুল, আগেই যথেষ্ট উদ্বেগজনক ছিল। এই ভয়াবহ শূন্যতা পূরণ করতে দেশ জুড়ে যে উদ্যোগ করা হচ্ছে, তা ছেলেখেলার স্তরে। ভারতের জনসংখ্যায় কমবয়সিদের অনুপাত শীঘ্রই হবে সারা বিশ্বে সর্বাধিক। আমাদের সামনে দু’টি পথ: এই যুবশক্তিকে লালন করে শিক্ষিত করে তাদের এবং দেশের সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা, নয়তো তাদের অশিক্ষায় নিক্ষেপ করে সকলের অমঙ্গল ডেকে আনা। আমরা দ্বিতীয় বিকল্পের দিকে ঝুঁকছি। সে ক্ষেত্রে স্বাধীনতার শতবর্ষ খুব সুখের হবে না।
এই সূত্রে একটা আনুষঙ্গিক স্বপ্ন। সংশোধিত সংবিধান বলছে, রাষ্ট্র ছয় থেকে চোদ্দো বছরের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থা করবে, কিন্তু ছয় বছর অবধি শিশুদের দেখভাল আর শিক্ষার ‘চেষ্টা করবে’ মাত্র। সেই চেষ্টায় যে আদৌ ফল হচ্ছে, তার কৃতিত্ব অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের। পাশাপাশি আছেন আশা-কর্মীর দল, যাঁরা দিনভর বছরভর জনস্বাস্থ্যের সমস্ত প্রাথমিক দায় সামলান। রাষ্ট্রপুঞ্জ এঁদের সম্মান দিয়েছে, কিন্তু আমরা দেশবাসীরা দিইনি, স্বেচ্ছাসেবকের তকমা দিয়ে উভয় কর্মী-বাহিনীকে লজ্জাকর ভাবে বঞ্চিত করে চলেছি। স্বপ্ন দেখা যাক, পঁচিশ কেন, পাঁচ বছরেই দেশের মাটির সবচেয়ে কাছের এই জনসেবকদের সম্মানজনক দক্ষিণার ব্যবস্থা হবে।
একদম অন্য একটা স্বপ্ন: স্বাধীনতার শতবর্ষে দেশের কারাগারে বিচারাধীন কোনও বন্দি দীর্ঘ দিন থাকবে না। এই মুহূর্তে ভারতের ৭৬% জেলবন্দি মানুষ বিচারাধীন, দণ্ডপ্রাপ্ত নন; ২৭% নিরক্ষর, আরও ৪১% স্কুলছুট। ৩০% বন্দি আছেন এক বছরের উপর। ছত্তীসগঢ়ে সম্প্রতি ১২১ জন ব্যক্তি পাঁচ বছর আটক থেকে বেকসুর খালাস পেলেন; ২০১৯-এ কাশ্মীরের তিন অধিবাসী তেইশ বছর পর। সুপ্রিম কোর্টের অনুজ্ঞা সত্ত্বেও দেখা যায় বহু মানুষ যত দিন বিনা বিচারে বন্দি আছেন, ওই অপরাধে সর্বাধিক সাজার মেয়াদ তার চেয়ে কম।
তাই স্বপ্ন দেখা যাক, তিন মাসের মধ্যে মামলা দায়ের না হলে সকলেই জামিন পাবে। অতি বিশেষ কারণ ছাড়া সেই মামলার নিষ্পত্তিও হবে ছয় মাসে, নয়তো অভিযুক্ত ক্ষতিপূরণ পাবে। যে কথাটা কিছু দিন মুখে মুখে ফিরছে, ভারতের প্রধান বিচারপতি স্বয়ং সে দিন তা বলেছেন, বলছেন তাঁর সতীর্থেরাও— বিচারের প্রক্রিয়াটাই শাস্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে, ‘দ্য প্রসেস ইজ় দ্য পানিশমেন্ট’। ফলে আইন হয়ে উঠেছে দুর্জনের অস্ত্র, আর কিছু না হোক, স্রেফ বিপক্ষকে হাজতে পচিয়ে। এই পরিণতির জন্য যেমন আইনের জটিলতা ও মহার্ঘতা দায়ী, তেমনই দায়ী বিচারক ও পরিকাঠামোর অভাব। এই অভাবের কথা বিদায়ী প্রধান বিচারপতি বার বার বলেছেন। আগামী পঁচিশ বছরে এই ঘাটতি পূরণ হলে শুধু বিচারপ্রার্থীরাই বাঁচবে না, বিচারব্যবস্থার সক্রিয়তায় রাষ্ট্রের জীবনে রূপান্তর আসবে।
ভীমা কোরেগাঁও মামলার অভিযুক্তেরা প্রায় সকলে চার বছরের উপর বন্দি। এক জন সেই অবস্থায় মারা গেছেন। বিচারপ্রক্রিয়া শুরুই হয়নি। এঁরা আটক আছেন এক বা একাধিক বিশেষ আইনবলে, যাতে সাধারণ আইনি রক্ষাকবচগুলো খাটে না। এমন একটি আইনের প্রয়োগ আপাতত আদালতের নির্দেশে বন্ধ, অন্যগুলি যথারীতি চালু। শতবর্ষের ইউটোপিয়ায় এটাও আশা করব, ‘এই আইন অন্যান্য আইন ও সংবিধানের আওতার বাইরে’, এই স্ববিরোধী দাবি কোনও আইনেথাকতে পারবে না। অর্থাৎ, সাধারণ বিচারনীতি ও মানবিক অধিকারের বিরুদ্ধে কোনও কিছু আইনবলে করা চলবে না।
সেই সঙ্গে, সরকারের সমালোচনা, এমনকি সক্রিয় কিন্তু অহিংস বিরোধিতার সঙ্গে সন্ত্রাসবাদের তফাতটা আইনে এত স্পষ্ট করে বোঝানো থাকবে, এবং তা সত্ত্বেও ধরপাকড় করলে কর্তাব্যক্তিদের এত কঠোর সাজা নির্দিষ্ট থাকবে, যে ছাত্র শিক্ষক সাংবাদিক সমাজসেবীরা স্বচ্ছন্দে নিঃশ্বাস নিতে পারবেন। ‘আবেগে আঘাত দেওয়া’ কোনও অবস্থাতেই ফৌজদারি অপরাধ বলে গণ্য হবে না। এতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, অনেক নজির আছে। ক্ষমতাবান লোক বা গোষ্ঠী যা খুশি বলে দিব্যি পার পেয়ে যাচ্ছে, খারাপ লাগছে বলার সাধ্য কার।
আঘাত দেওয়ার অভিযোগ সবচেয়ে বেশি উঠছে ধর্ম নিয়ে। ভারতবাসীর দুর্ভাগ্য, সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার বিধান, অর্থাৎ প্রত্যেক ধর্মের নির্বিরোধ স্বাতন্ত্র্যের বিধান, কোন অশুভ জাদুতে পরিণত হয়েছে ধর্মে-ধর্মে সংঘাতের কুমন্ত্রে। স্বাধীনতার একশো বছরে যেন সব নাগরিকের থাকে বিবাহ অন্ত্যেষ্টি উত্তরাধিকার ইত্যাদি বিষয়ে আইনের চোখে এক অভিন্ন বিধি। তার অতিরিক্ত কে কী ধর্মীয় প্রথা মানবেন, তা একান্ত তাঁদের ব্যক্তিগত ব্যাপার, রাষ্ট্রের চোখে গ্রাহ্য নয়।
এ কথাটা যাঁদের মনে ধরবে, আমার পরের স্বপ্নটা তাঁদের পছন্দ হবে না। সেটা হল, ধর্মের ব্যাপার সবটাই হবে ব্যক্তিপরিসরের বিষয়। কে কী ধর্ম অনুসরণ করবে, পাল্টাবে কি না, কী আচার অনুষ্ঠান পালন করবে বা করবে না, সেটা একান্ত সেই ব্যক্তি ঠিক করবে— রাষ্ট্র নয়, অন্য ব্যক্তি বা গোষ্ঠী তো নয়ই। অতএব এ নিয়ে আইন রচনার প্রশ্ন উঠবে না। এক জনের ধর্মে বাধে বলে অন্য কারও আচার-অভ্যাস নিষেধ করা যাবে না। অন্যায় চাপ দিয়ে ধর্মান্তরণের অভিযোগ উঠলে ভীতিপ্রদর্শন ব্ল্যাকমেল ইত্যাদির মোকাবিলায় সাধারণ আইন প্রয়োগ করা হবে। ধর্মের ভিত্তিতে বিভেদ সৃষ্টি করলে তার বিরুদ্ধেও সাধারণ আইনের অভাব নেই, সমদৃষ্টিতে প্রয়োগ নিয়ে কথা।
লিখতে বসলে কত কিছুই মনে হয়, ‘উইশ লিস্টে’ ঢোকাই। নারী শিশু দলিত সংখ্যালঘু, কাদের বঞ্চনা-লাঞ্ছনা বাদ দিয়ে কার কথা বলব? অন্যান্য সাধারণ নাগরিকই কি উজ্জ্বল আগামীর আশা করছেন? তবু শেষ করি একটা বেয়াড়া স্বপ্ন দিয়ে: স্বাধীনতার শতবর্ষে কোনও সাংসদ বা বিধায়ক দল বদলালে পদ ছাড়তে বাধ্য হবেন। এ বিধানের কোনও অবস্থায় ব্যতিক্রম হবে না।
ভাষ্যকাররা বলছেন, ভারতীয় গণতন্ত্রের আজ নির্বাচনে শুরু আর শেষ; বাকি সময় নাগরিক স্বার্থ শিকেয় তোলা থাকে। নির্বাচনের মাধ্যমে তবু পাঁচ বছরে এক বার শাসকদের কাছে একটা বার্তা পাঠানো যেত। সেই বার্তা আজ হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচিত সদস্যেরা খুশিমতো শিবিরে-শিবিরে ঠাঁই বদলাচ্ছেন। যে পক্ষকে হটাবার জন্য ভোট দিলাম, দেখা যাচ্ছে দু’দিন বাদে তারাই সদর্পে ক্ষমতায় ফিরল। এ সম্বন্ধে নাকি আইন আছে। নিজেদের দ্বন্দ্বে রাজনীতিকরা সেই আইনকে অস্ত্র করতে পারেন, নাগরিকের কাছে সেটা তালপাতার তরোয়াল।
রাজনীতিক গোষ্ঠীর এই অবাধ স্বাধীনতার ফলে সাধারণ মানুষের স্বাধিকার ধূলিসাৎ হওয়ার উপক্রম। হারিয়ে যেতে পারে স্বাধীনতালব্ধ আর সব প্রাপ্তি, সব অধিকার। সমস্যা এই, প্রতিকারের ক্ষমতা যাদের হাতে, তারাই এই অনাচারে পুষ্ট হচ্ছে। আর পঁচিশ বছরে তাদের খিদে কতটা মিটবে, কতটা দেশের ছেলেমেয়েদের?
ইমেরিটাস অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ,যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়