কী দিন পড়ল, অ্যাঁ! কাল বিকেলে পিসিমার কাছে শুনলুম, মিউচুয়াল ফান্ডে ইনভেস্ট করেছে। এসআইপি, মাসে মাসে টাকা কেটে নেবে,” ঘোষণা করল তপেশ। পিসিমার গোটা পনেরো বাড়ি, ব্যাঙ্কের লকারে গয়না-টয়না মিলিয়ে হুলস্থুল অবস্থা। বলেছেন, তপেশ বিয়ে করলে বৌয়ের নামে সব লিখে দেবেন; তপেশের কাণ্ডজ্ঞানের উপর পিসিমার ভরসা নেই।
“ও দিকে ঋতুপর্ণা আমার মাথা খেয়ে ফেলল এসআইপি করার জন্য। যত বলছি যা বুঝি না, তাতে না ঢোকাই ভাল, ও তত চটে যাচ্ছে— পরশু ডরপোক বলেছিল, কাল বুঝদিল বলেছে। পিসিমার কথা শুনলে আর রক্ষে থাকবে না,” শিশির দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ওর বউ বিয়ের আগে অবধি বাংলার বাইরে বাইরেই থেকেছে; বিশেষ করে শিশিরকে ধমকানোর সময় ওর কথায় হিন্দি ঢুকে পড়ে।
শিবুদা মন দিয়ে শব্দছক করছিলেন— আপন মনেই বললেন, ‘কলহের পর সদ্ভাব, তিন অক্ষরের, পাশাপাশি... শেষ অক্ষর ন... মিলন, হ্যাঁ মিলনই হবে’। শব্দটা লিখে কাগজটা টেবিলের উপর রেখে বললেন, “নোবেল দেওয়া উচিত, বুঝলি।”
“ক্রসওয়ার্ড সলভ করার জন্য নোবেল?” প্রশ্ন করে তপেশ।
“আজকাল যা সব শব্দ দিচ্ছে, তাতে নোবেল দিলে মন্দ হয় না।” মুচকি হাসেন শিবুদা। “অবিশ্যি, নোবেল দেওয়ার কথা বলছি তাঁকে, এসআইপি বস্তুটা যাঁর মাথা থেকে প্রথম বেরিয়েছিল।”
“আপনি শুনছিলেন? মাথা শব্দসন্ধানে, আর কান আড্ডায়?” সূর্যের কণ্ঠস্বরে বিস্ময়।
শিবুদা স্মিত হাসেন, “ভেবে দেখ, যে শেয়ার বাজারের কথা শুনলেই বাঙালির চোখের সামনে গন্ডেরিরাম বাটপারিয়ার ছবি ভেসে উঠত, তাকে খলে বেটে মধু দিয়ে মেড়ে তামা তুলসী ছুঁইয়ে পুরিয়া বানিয়ে ঘরে ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া কি মুখের কথা? শুধু বাঙালি বলে তো নয়, দুনিয়ার সর্বত্র শেয়ার বাজারের সঙ্গে এক কালে যাদের ভাশুর-ভাদ্রবৌ সম্পর্ক ছিল, সবাই এসআইপি করছে এখন।”
চায়ে চুমুক দিয়ে একটা সিগারেট ধরালেন শিবুদা। সেই ফাঁকে একটা প্রশ্ন গুঁজে দেয় শিশির, “সেটা ভাল হয়েছে, না মন্দ?”
“প্রশ্নটা ভাল-মন্দের নয়, যদিও ব্যাঙ্ক-পোস্ট অফিসে ইন্টারেস্ট রেট কমতে কমতে যেখানে গিয়ে ঠেকছে তাতে শেয়ার বাজার ছাড়া সম্ভবত গতি নেই,” এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে উত্তর দিলেন শিবুদা। “প্রশ্ন হল, যে জিনিসটায় মানুষ বেমক্কা ভয় পেত— সেটাকে এমন আটপৌরে ব্যাপার বানানো গেল কোন মন্ত্রে? বিশেষ করে, শেয়ার বাজারের চরিত্র তো পাল্টায়নি। বুঝতেই পারছিস, বিহেভিয়রাল ইকনমিক্স ছাড়া এই প্রশ্নের উত্তর হবে না।” এক চুমুকে কাপের বাকি চাটুকু শেষ করলেন শিবুদা।
বাকি তিন জন চেয়ার টেনে গুছিয়ে বসল। শিবুদা আরম্ভ করলেন, “মোদ্দা কথা হল ভয়টা কাটিয়ে ফেলা। প্রথম ভয়, একলপ্তে মোটা টাকা ইনভেস্ট করা। তা ব্যবস্থা হল, মাত্র পাঁচশো টাকা দিয়েও কোনও কোনও স্কিমে ইনভেস্টমেন্ট শুরু করা যাবে। বলতেই পারিস, এক বারে ষাট হাজার টাকা লগ্নি করা, আর মাসে মাসে পাঁচ হাজার টাকা করে রাখা— ফারাক কোথায়? বছরের শেষে তো একই টাকা যাচ্ছে, একই জায়গায় যাচ্ছে। একটা ফারাক তো জলের মতো সহজ— একবারে ষাট হাজার টাকা ক’জনেরই বা হাতে থাকে? কিন্তু, তার চেয়েও বড় ফারাক হল, মানুষের মনের কাছে ওই দুটো এক খরচ নয়। পকেট থেকে টাকা বার করতে সবারই খারাপ লাগে— সেই অঙ্কটা যত বড় হয়, খারাপ লাগার মাপও ততই বড়। এসআইপি এই ভয় আর খারাপ লাগাকে একেবারে গোড়ায় মেরে দেয়।
“তার চেয়েও সাংঘাতিক ব্যাপার হল— প্রতি মাসে ভয় পাওয়া, খারাপ লাগার পাটও চুকিয়ে দেওয়া গেল অনেকখানি। এক বার এসআইপি চালু করে দিলে তুই ঝাড়া হাত-পা। প্রত্যেক মাসে নিজে থেকেই টাকা কেটে নেবে অ্যাকাউন্ট থেকে। ভেবে দেখ, প্রত্যেক মাসে যদি সবাইকে উদ্যোগ করে এই টাকা লগ্নি করতে হত, শেষ অবধি ক’জন দিয়ে উঠতে পারত টাকা? একে তো শেয়ার বাজারে টাকা লাগানোর ভয়। তার উপর আলিস্যি— ‘আজ করব, কাল করব’ করে ফেলে রাখত অনেকেই। তার চেয়েও বেশি লোক ‘পরের মাসে করব’ বলে এই মাসের টাকাটা অন্য কিছুতে খরচ করে ফেলত। অ্যাকাউন্ট থেকে আপনাসেই টাকা কেটে যাওয়ায় আমরা এর কোনওটাই করলাম না— টাকাটা লগ্নি হয়ে গেল মার্কেটে। বিহেভিয়রাল ইকনমিক্সের দুনিয়ায় এ যে কত বড় বিপ্লব, সেটা বুঝতে গেলে রিচার্ড থেলারের শরণাপন্ন হতে হবে।”
“নাজ-এর কথা বলছেন কি? মানে, মানুষকে তার নিজের ভালর দিকে আলতো করে ঠেলে দেওয়া?” শিবুদা থামতে প্রশ্ন করল সূর্য।
“একমাত্র সূর্যই আমার কথাগুলো মন দিয়ে শোনে,” খুশি হন শিবুদা। “আমেরিকায় আইআরএ ৪০১কে নামে একটা ব্যবস্থা আছে— অনেকটা আমাদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের মতো। মাইনে থেকে পয়সা কাটিয়ে এই স্কিমে রাখা যায়— কর্মী যত টাকা দেয়, কোম্পানিও অনেক ক্ষেত্রে তত টাকাই দেয়, অনেক ক্ষেত্রে একটু কম দেয়। ফারাক হল, আমাদের এখানে পিএফ আপনাআপনিই চালু হয়, ও-দেশে কর্মীদের একটা ফর্ম পূরণ করে জানাতে হয় যে, এ বার সে পয়সা কাটাতে রাজি। ভেবে দেখ, ৪০১কে-তে পয়সা রাখলে মাইনের উপর কোম্পানির থেকে বেশ খানিকটা টাকা বাড়তি পাওয়া যায়— তবুও প্রায় ৩০% কর্মী চালু করত না এই প্ল্যান। রিচার্ড থেলার বহু দিন ধরে বলে বলে ব্যবস্থাটাকে সামান্য পাল্টে দিলেন— নিয়ম হল, এ বার থেকে কর্মী যদি নিজে না জানান যে তিনি এই ফান্ডে টাকা রাখতে চান না, তা হলে প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই প্রথম মাইনে থেকে টাকা কাটা হবে। নিয়মের এইটুকু বদলে আমেরিকায় অনেক লোকের ভবিষ্যৎ বেঁচে গেল— যে টাকা তারা বেভুল খরচ করে ফেলত, সেটা রিটায়ারমেন্ট ফান্ডে জমা হতে থাকল।”
“আপনি বলছেন, এসআইপি মানুষের এতখানিই উপকার করছে?” প্রশ্ন করে সূর্য।
“না, তা বলছি না।” আর একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে ঘাড় নাড়েন শিবুদা। “সরকারের ঘরে নিশ্চিত টাকা, আর শেয়ার বাজারের চরিত্রগত অনিশ্চয়তার মধ্যে রাখা টাকা এক হতে পারে না। মিউচুয়াল ফান্ড থেকে তোর লাভ হতে পারে নিশ্চয়ই— অনেকেরই হচ্ছে, না হলে অ্যাদ্দিন চলতই না ব্যাপারটা— কিন্তু তোর লাভের কথা ভেবে ফান্ড ব্যবসা করে না, করে নিজেদের লাভের কথা ভেবে। আমি থেলারের উদাহরণটা দিলাম এটা বোঝাতে যে, যদি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভারটা মানুষের উপর থেকে সরিয়ে নেওয়া যায়— গায়ের জোরে নয়, এমন ভাবে যাতে কেউ চাইলে নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতেই পারে, কিন্তু না নিলেও অসুবিধা নেই— তাতে খেলাটা সম্পূর্ণ পাল্টে যেতে পারে। এসআইপি সেটাই করেছে।
“মিউচুয়াল ফান্ডগুলো আরও বেশি টাকার লগ্নি পেতে পারে, তেমন দুটো আইডিয়া দিই, শোন।” চেয়ারের উপর পা তুলে বাবু হয়ে বসলেন শিবুদা, “কেউ যখন এসআইপি করে, সেটা একটা নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য হয়— এক বছর, তিন বছর, পাঁচ বছর এই রকম। মেয়াদ ফুরোলে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা কাটাও বন্ধ হয়ে যায়। কোনও ফান্ড হাউস যদি একটা স্কিম করে, যেখানে কাস্টমার যত দিন না বন্ধ করছে, তত দিন এসআইপি-র টাকা কাটা হয়ে চলবে, সেটা একটা গেম চেঞ্জার হতে পারে। কেন জানিস? কারণ, মানুষ যেমন উদ্যোগ করে কোনও জিনিস চালু করে উঠতে পারে না, ঠিক তেমন ভাবেই কিছু বন্ধও করতে পারে না। এই আমার কথাই ধর— গোটা তিনেক বিদেশি ম্যাগাজ়িন গত সাত বছর ধরে আমার বাড়িতে আসছে। মাসে মাসে ক্রেডিট কার্ড থেকে পয়সাও কেটে নিচ্ছে। উল্টে দেখি না একটাও, অথচ উদ্যোগ করে ওদের ওয়েবসাইটে গিয়ে বন্ধও করিনি। নিতান্ত বাজে খরচ হচ্ছে। এসআইপি তো সেই তুলনায় অনেক ভাল— আমি জানি, ভাগ্য নিতান্ত অপ্রসন্ন না হলে আজ না হোক কাল, ও টাকা ফুলেফেঁপে আমার ঘরে ফিরবে। বন্ধ করার তাগিদ এমনিতেই কম থাকবে।”
“মোক্ষম! আর অন্য আইডিয়াটা কী?” তপেশ জানতে চায়।
“আগের আইডিয়াটা আমার, অন্যটা থেলারের থেকে টোকা, বুঝলি।” গোপাল চা দিয়েছে, তাতে চুমুক দিয়ে বললেন শিবুদা। “সেভ মোর টুমরো বলে একটা প্ল্যান চালু করেছিলেন থেলাররা, যাতে লগ্নিকারীরা মাইনে বাড়লে লগ্নির পরিমাণও সমানুপাতে বাড়াতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন। গুগল করলেই দেখতে পাবি, সে এক প্রকাণ্ড কাণ্ড। এ বার, কোনও ফান্ডওয়ালা যদি একটা স্কিম করে, যাতে প্রতি বছর সামান্য পরিমাণে হলেও লগ্নির অঙ্কটা বাড়বে— বাড়ানোর সময় আর গ্রাহকের অনুমতি নিতে হবে না, স্কিমটা কেনার সময় সই করে দিলেই হল— তা হলে কী হবে, বুঝতে পারছিস?”
“আর কিছু না হোক, পিসিমা কিছু দিনের মধ্যেই ধনকুবের হয়ে উঠবেন,” উত্তর দিল তপেশ।