Sexual Harassment of Women at Workplaces

সাম্যময় কর্মক্ষেত্রের সন্ধানে

ভারতে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে কঠোর আইন আছে— কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি (প্রতিরোধ, নিষিদ্ধকরণ ও প্রতিকার) আইন, ২০১৩। ইংরেজি আদ্যক্ষরগুলি জুড়ে এই আইনকে সাধারণত ‘পশ’ আইন বলা হয়।

Advertisement

আর্শিয়া শেঠ

শেষ আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২০২৪ ০৮:১০
Share:

—প্রতীকী চিত্র।

বড় রকমের একটা সাড়া পড়ে গিয়েছে দেশে। শিল্পের দুনিয়ায় যৌন হয়রানি নিয়ে জোরালো কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে চারিদিকে। ২০২০ সালে ভোপালের ‘ধ্রুপদ সংস্থান’-এর কিছু শিক্ষার্থী যৌন হয়রানির অভিযোগ আনেন একাধিক গুরুর বিরুদ্ধে। তার কয়েক মাসের মধ্যেই নয়াদিল্লির কত্থক কেন্দ্রের পাখোয়াজ গুরুর বিরুদ্ধে একই অভিযোগ আসে। ২০২৩ সালে এসে দেখা গেল, প্রতিবাদ নেমে এসেছে রাস্তায়। রাজধানীর পথকে প্রতিবাদের মঞ্চ করে তুলে সবার নজর টানলেন মহিলা কুস্তিগিররা। ভারতের কুস্তি ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট ব্রিজভূষণ সিংহের হাতে তাঁদের নির্যাতন, হয়রানির বিরুদ্ধে এক যোগে সরব হলেন তাঁরা। আর একটি ঘটনাও জানাজানি হয়েছে, সেটির ঘটনাস্থল চেন্নাইয়ের ‘কলাক্ষেত্র’।
রুক্মিণী দেবী অরুণ্ডেল প্রতিষ্ঠিত এই বিখ্যাত নৃত্য শিক্ষায়তনে একশোটিরও বেশি অভিযোগ দায়ের হয়েছে। ফলে চারুশিল্পে যৌন হয়রানির ইতিহাসে কলাক্ষেত্র এখন সবচেয়ে এগিয়ে।

Advertisement

ভারতে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে কঠোর আইন আছে— কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি (প্রতিরোধ, নিষিদ্ধকরণ ও প্রতিকার) আইন, ২০১৩। ইংরেজি আদ্যক্ষরগুলি জুড়ে এই আইনকে সাধারণত ‘পশ’ আইন বলা হয়। এই আইনে অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য একটি অভ্যন্তরীণ কমিটির কথা বলা হয়েছে, যার সদস্য থাকবেন পাঁচ জন, এবং অধিকাংশকেই মহিলা হতে হবে। এর সভাপতিত্ব করবেন ওই সংস্থারই এক মহিলাকর্মী, থাকতে হবে ওই সংস্থার বাইরের এক সদস্য, যিনি সাধারণত কোনও অসরকারি সংস্থার (এনজিও) সঙ্গে যুক্ত থাকেন বলে তাঁকে ‘এনজিও সদস্য’ বলা হয়। তিনি আইনি অধিকার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হবেন, এমনই প্রত্যাশিত। অভ্যন্তরীণ কমিটির দায়িত্ব তার সংস্থার সকলকে প্রশিক্ষিত করা, কাজের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করা, এবং অভিযোগের তদন্ত করে নিষ্পত্তি করা।

আজ যে এত অভিযোগ সামনে আসছে, তা এমনই ইঙ্গিত দেয় যে মেয়েরা প্রতিবাদের সাহস পাচ্ছেন। কোথা থেকে এই সাহস সংগ্রহ করছেন তাঁরা? তা কি ‘পশ’ আইন থেকে? সমাজ কি এতটাই বদলে গিয়েছে যে, মেয়েরা বিরূপ সমালোচনা, অপবাদের ভয় কাটিয়ে উঠেছেন?

Advertisement

না কি, এত অজস্র অভিযোগকারিণীর অস্তিত্ব শেষ পর্যন্ত এটাই বোঝায় যে, আইনটি কাজের বেলায় নিষ্ফল, তাকে বাতিল করাই দরকার?

ঠিকই যে চারশো নারীপুরুষের মধ্যে একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষা (কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি আইন সম্পর্কে সচেতনতায় পরিবর্তন) দেখিয়েছে যে, ৩৭ শতাংশ মেয়ে কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির শিকার। এঁরা সকলেই ছিলেন উচ্চশিক্ষিত মহিলা, যাঁরা কর্পোরেট জগতে কাজ করছিলেন। কর্পোরেট সংস্থাগুলি যদি চাইত, তা হলে অনায়াসেই তাঁদের যৌন হয়রানির প্রয়োজনীয় দিকগুলি নিয়ে প্রশিক্ষিত করতে পারত। সমীক্ষায় উত্তরদাতাদের ১১ শতাংশ জানিয়েছেন, তাঁরা বরং কাজ ছেড়ে দেবেন, কিন্তু পশ আইনের অধীনে অভিযোগ দায়ের করবেন না। তাঁরা দেখেছেন, যে মেয়েরা অভিযোগ দায়ের করেছেন, তাঁদের সামাজিক ও আর্থিক ভাবে কতখানি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে বোঝা যাচ্ছে যে, বিষয়টা কেবল আইনের সম্পর্কে অজ্ঞতার থেকে অনেক গভীর ও জটিল।

আসল সমস্যা হল বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়া, নানা ধরনের অজুহাত দিয়ে দায় এড়ানো। যেমন, আমি প্রায়ই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে বলতে শুনি, “আমরা গুরুকুল বিদ্যালয়, কর্মক্ষেত্র নই।”
তাঁরা কি সত্যিই জানেন না শিল্প শিক্ষায়তন,
এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে যৌন হয়রানির ঘটনা কত ঘটে চলেছে?

সমাজে নারী-বিদ্বেষী, পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাভাবনার প্রাবল্য এই সঙ্কটকে আরও গভীর করছে। মেয়েদের প্রতি ন্যায়, পুরুষ-মহিলা সাম্য, এ সবই সমাজের কাছে কেবল কথার কথা। সমস্যা আমাদের মনোভাবে, যা মনে করে, ‘পুরুষ তো পুরুষের মতোই থাকবে’, মেয়েদের চরিত্র নিয়ে অপবাদ দেওয়ার প্রবণতা, মেয়েদের যে কোনও সিদ্ধান্তকে ‘ছেলেমানুষি’ বলে দেখানো, মেয়েদের দেহকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং পোশাক সম্পর্কে মন্তব্য করা, এ সব একটি লিঙ্গের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করা এবং অন্যটিকে হেয় করার উপায়।

যে-হেতু আমরা সকলেই আজীবন এই অন্যায়কে দীর্ঘায়িত করে চলেছি, মানসিক ভাবে এবং প্রাতিষ্ঠানিক উপায়ে, তাই পশ আইনের লঙ্ঘন নিয়ে কখনওই খুব একটা বিচলিত হই না। অতএব যদি বা আক্ষরিক অর্থে পশ আইন মানা হয়, তাতে আইনটি বাস্তবিক কার্যকর হবে কি?

বিভিন্ন সংস্থার আধিকারিকদের কাছে অনুরোধ, পশ আইনে যেগুলি করতে বলা হয়েছে— প্রশিক্ষণ, আলোচনা প্রভৃতি— সেগুলিকে একটা বাড়তি বোঝা হিসাবে না দেখে, সাম্য ও ন্যায়পূর্ণ সমাজ তৈরির একটা সুযোগ হিসাবে দেখা দরকার। আইনটি অভ্যন্তরীণ কমিটির গঠন ও কাজকে এতই
নমনীয় রেখেছে যে, কর্মক্ষেত্রকে নিরাপদ রাখার কাজে সব লিঙ্গ-পরিচয়ের মানুষকেই ‌শামিল করা যায়। বিপুল সংখ্যায় অভিযোগের নিরসন যদি সত্যিই করতে হয়, তা হলে আইনটিকে তার নিজের কাজ করতে দিতে হবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement