সরকারি টাকার সুব্যবহার: ডিএ, না লক্ষ্মীর ভান্ডার বা উজ্জ্বলা
Duare sarkar

একটা গণভোট হয়ে যাক

শুরু করা আর চালু রাখা এক নয়। ফলে, ইতিমধ্যে গ্যাসের দাম বেড়েছে অনেক, কেন্দ্রীয় সরকারের এই প্রকল্পে সেই গরিব মেয়েরা আর গ্যাস কিনতে পারছেন না।

Advertisement

মোহিত রায়

শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০২৩ ০৬:১৩
Share:

অধিকার: দুয়ারে সরকার শিবিরে বিভিন্ন সরকারি পরিষেবা পাওয়ার জন্য লাইনে অপেক্ষারত নাগরিকরা। ছবি: সুমন বল্লভ।

১৯৮১ সালে যখন পরিবেশ নিয়ে কেউ মাথাই ঘামাত না, তখন ঘোষিত বামপন্থী মৃণাল সেন একটি পরিবেশ চলচ্চিত্র উপহার দেন, চালচিত্র। পরিবেশবাদী বললে কম বলা হবে— সেটি ছিল প্রথম নারী-পরিবেশবাদী চলচ্চিত্র, বাংলায় এবং সম্ভবত ভারতেও। ছবিতে একটি সংবাদপত্রের তরুণ সাংবাদিক একটা গরম স্টোরি হিসাবে গরিব মানুষের বাড়ি বাড়ি উনুনের ধোঁয়ার সমস্যা নিয়ে সম্পাদককে বললে তিনি তাঁকে উৎসাহ দেন। মৃণাল সেনের চরিত্র কলকাতার দর্শককে জানাচ্ছেন, ধোঁয়ার সমস্যা এখন গ্লোবাল ফেনোমেনন। সম্পাদকের মুখ দিয়ে মৃণাল সেন জানাচ্ছেন যে, এটি জনস্বাস্থ্যের ব্যাপার— ছবিতে এই সমস্যা ও তা নিয়ে মৃণালীয় ঢঙে প্রতিবাদে এসেছেন হাজার হাজার বস্তির মেয়ে, সবার হাতে ঝাঁটা আর সামনে ধোঁয়া ওঠা জ্বলন্ত উনুন। এই ছবিতেই দেখানো হল সমস্যার সমাধান বাড়িতে একটি গ্যাসের উনুন। সুখের কথা, মৃণালবাবু দেখে গেছেন যে, পরিবেশ ও নারী-স্বাস্থ্যের এত বড় সমস্যার সমাধানের কাজ শুরু করল নরেন্দ্র মোদীর সরকার, ২০১৬ সালের মে দিবস থেকে। শুরু হল উজ্জ্বলা যোজনা। লক্ষ্য, দারিদ্রসীমার নীচে থাকা আট কোটি পরিবারের মেয়েদের বিনামূল্যে গ্যাসের উনুন ও ভর্তুকিতে গ্যাস দেওয়া হবে, যে লক্ষ্যমাত্রা ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যেই পূরণ হয়েছে। আন্তর্জাতিক মহলে এই প্রকল্প প্রশংসিত হয়েছে।

Advertisement

শুরু করা আর চালু রাখা এক নয়। ফলে, ইতিমধ্যে গ্যাসের দাম বেড়েছে অনেক, কেন্দ্রীয় সরকারের এই প্রকল্পে সেই গরিব মেয়েরা আর গ্যাস কিনতে পারছেন না। এখন প্রতি সিলিন্ডারে ৪০০ টাকা সরকার ভর্তুকি দেবে, কিন্তু সেটা দেবে হাজার টাকার গ্যাস সিলিন্ডার কেনার পর। সুতরাং, মৃণাল সেনের নারীবাহিনী আবার সঙ্কটে, তাঁরা ফিরে গেছেন কাঠকুটো, ঘুঁটে, কেরোসিনের দূষণের জগতে। উপায়? কেন্দ্রীয় সরকারকে আরও ভর্তুকির টাকা জোগাড় করতে হবে।

এ রকমই পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম জনপ্রিয় যোজনা রাজ্য সরকারের লক্ষ্মীর ভান্ডার। এতে রাজ্যের গরিব মহিলাদের মাসিক ভাতা দেওয়া হবে। তফসিলি জাতি ও জনজাতির নারীরা পাবেন মাসে ১০০০ টাকা, অন্যরা মাসে ৫০০ টাকা। মাত্র ৫০০ টাকার জন্য মানুষ দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াচ্ছেন, এ নিয়ে ব্যঙ্গ-রসিকতাও হয়েছে। সরকার কি আরও টাকা দিতে পারে না? সে টাকা আসবে কোথা থেকে?

Advertisement

অর্থনৈতিক সমস্যা সবারই কিছু থাকে বইকি। যে কোনও সরকারের তা নিয়ে কিছু করারও থাকে। কিন্তু কারা অগ্রাধিকার পাবে? এটা বেশ আশ্চর্যজনক যে, সরকার কেন্দ্রে বা রাজ্যে, সব মানুষেরই সরকার, কোনও বিশেষ গোষ্ঠীর নয়। সরকার টাকা পায় সবার কর থেকেই, দরিদ্রতম মানুষটিও যখন একটা সাবান বা রুটি কেনেন, তখন তিনি কর দেন, যে টাকা সরকার পায়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে বলে সরকার কেন শুধু সরকারি কর্মচারীদেরই মহার্ঘ ভাতা বা ডিএ দেবে, তা বোঝা দায়। শুধু দেয় না, তা আবার মাঝে মাঝে বৃদ্ধিও হয়। বাকি জনসাধারণ বাদ। তা হলে কি সরকারি কর্মচারীরা খুব অর্থকষ্টে আছেন?

যাঁরা ডিএ-র দাবিতে এত কষ্ট করে আন্দোলন করছেন, তাঁদের কষ্টকর অর্থনীতি একটু জেনে নেওয়া যাক। প্রথমেই বলে নেওয়া ভাল যে, বিষয়টি সম্পর্কে সাধারণ ধারণার জন্য কিছু গড় তথ্যই এই আলোচনায় বলা হবে। বিজেপি সরকারের সপ্তম পে কমিশন কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারীদের এক লাফে অনেকটাই (২০ শতাংশের বেশি) বেতন বাড়িয়ে দেয়। ফলে, পাশাপাশি রাজ্যগুলির উপরও চাপ বাড়ে বেতন বৃদ্ধির। তা ছাড়া নিরাপত্তা এবং পেনশন তো আছেই। এই সব বৃদ্ধির ফলে সরকারি চাকরি এখন সারা দেশেই একটি সোনার খনি। এত সব আন্দোলন, অনশন এই সোনার খনিতে প্রবেশ বা আরও বেশি সোনা উত্তোলনের ব্যাপারস্যাপার। বাকি দেশবাসীর তা শুধু দেখে যাওয়া ছাড়া আর কী করার আছে।

কেন্দ্রীয় সরকারের একেবারে নীচের গ্রেডের এক জন মাঝারি মানের শহরের কর্মচারী (বেসিক পে ১৮০০০ টাকা) দশ বছর পর তাঁর বার্ষিক ৩% বৃদ্ধি, ২৪% বাড়িভাড়া, যাতায়াত খরচ ও ৪২% ডিএ নিয়ে প্রায় ৪৩ হাজার টাকা মাসে বেতন পান। ধরা যাক, কেন্দ্রীয় সরকার ডিএ-র হার কমিয়ে ২১% অর্থাৎ অর্ধেক করে দিল। কর্মচারীটির বেতন কমে দাঁড়াবে ৩৮ হাজারের মতন। একটু উচ্চ পদের (বেসিক পে ২৮০০০ টাকা) কর্মচারী ১০ বছর পর আয় করবেন মাসে ৭৫ হাজার টাকা। ডিএ-র হার অর্ধেক করে দিলে পাবেন ৬৬ হাজার টাকা। এঁরা কি খুব গরিব হয়ে গেলেন? আবার বলে রাখি, হিসাবটি খুব পুঙ্খনাপুঙ্খ নয়, আয়কর ধরা হয়নি এবং দশ বছরের চাকরির ব্যাপারটি ধরা হয়েছে যে, তখন কেউ পারিবারিক দায়দায়িত্ব পুরোপুরি বহন করা শুরু করেন। আর সবচেয়ে বড় কথা, এ সব চাকরি একেবারে পাকা, অবসরের পর ভাল পেনশন ও চিকিৎসার যাবতীয় খরচ। এ বার মনে করিয়ে দেওয়া ভাল, ভারত সরকারে ই-শ্রম পোর্টালে নাম লেখানো প্রায় ২৮ কোটি অসংগঠিত শ্রমিকের ৯২ শতাংশের মাসিক আয়, ২০২২-এর তথ্য অনুযায়ী, ১০ হাজার টাকার কম। আরও বলা দরকার যে, ডিএ-র হার অর্ধেক করে দিলেও এক জন সরকারি কর্মচারীও পদত্যাগ করবেন না।

কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়েছে যে, তারা আরও ৪% ডিএ বাড়াবে— তাতে খরচ হবে বছরে ১২,৮১৫ কোটি টাকা। এখন সরকার যদি ২১% ডিএ বন্ধ করে দেয়, তবে কেন্দ্রীয় সরকার বাঁচাতে পারবে বছরে প্রায় ৬৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। উজ্জ্বলা যোজনার সুবিধা এখন পায় সাড়ে ন’কোটি নারীর পরিবার। এই টাকায় প্রত্যেককে সরকার দিতে পারবে বছরে ৭১০০ টাকা বা ৭-৮টি বিনামূল্যের গ্যাস সিলিন্ডার। সুতরাং আশা করতেই পারি, ডিএ সঙ্কোচনের সমর্থনে দাঁড়িয়ে যাবেন মৃণাল সেনের পক্ষের সব বামপন্থীরা, সব নারীবাদী ও পরিবেশবাদীরা।

অবশ্যই তুলনামূলক ভাবে রাজ্য সরকারি কর্মচারীরা একই বেতন স্কেলে থাকলেও কম বাড়ি ভাড়া ভাতা ও ডিএ-র জন্য কম বেতন পান। সবচেয়ে কম মাইনের কর্মচারী মাসিক বেতন পান ২৮ হাজারের মতো। এক জন অধ্যাপক কলেজে ঢুকেই পান ৬০ হাজার টাকার মতো, দশ বছর পর সেটা হয়ে দাঁড়ায় ৮০ হাজারের মতো। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক কাজে ঢুকেই পান মাসিক প্রায় ৩৫ হাজার টাকা, আর হাই স্কুলে তা হবে মাসিক ৫০ হাজার টাকা। অবসরের পর পেনশন আছেই। আরও গুরুত্বপূর্ণ যে, ক্লাসের সব ছাত্র ফেল করলেও শিক্ষক বা অধ্যাপকের বেতন কিন্তু কমবে না।

কিন্তু রাজ্যের বাকি বাসিন্দাদের আয় কেমন?‌ রাজ্য সরকারের একটি তথ্য অনুযায়ী রাজ্যের গড় পরিবার পিছু মাসিক খরচের পরিমাণ ৫২৪৯ টাকা। যে লক্ষ্মীর ভান্ডারের ৫০০ টাকা নিয়ে ব্যঙ্গ শোনা গেছে, তা নির্ধারিত হয়েছে সেই মাসিক খরচের ১০ শতাংশ পূরণ করতে। এই খরচে একটি হিসাবে পরিবারের মাসিক আয় সাড়ে ৭ হাজার টাকার মতো। সুতরাং, সরকারি কর্মচারীর ২৮ হাজার টাকা ও ভবিষ্যৎ পেনশন খুব খারাপ অর্থনৈতিক অবস্থা নয়। শিক্ষক-অধ্যাপকদের তো কোনও অর্থনৈতিক সমস্যাই নেই। রাজ্য সরকার ঘোষিত আবার ৩% ডিএ না দিলে সরকারি কর্মচারীদের কোনও অর্থনৈতিক সঙ্কটও দেখা দিচ্ছে না। রাজ্য সরকার আগের বার ৩% ডিএ ঘোষণার সময় জানিয়েছিল যে, তাদের মাসিক খরচ বাড়বে ১০ হাজার কোটি টাকা। নতুন ডিএ না দিলে সরকার হাতে পাবে এই ১০ হাজার কোটি টাকা। প্রায় দু’কোটি গরিব নারীর জন্য লক্ষ্মীর ভান্ডার চালাতে সরকারের খরচ বছরে ১১ হাজার কোটি টাকা। ডিএ না বাড়ালে এই গরিব নারীদের ভাতা দ্বিগুণ করা যেতে পারে সহজেই।

এক কথায় বলা যেতে পারে যে, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের জন্য সরকারের ডিএ বা মহার্ঘ ভাতা দেওয়া খুবই সঙ্কীর্ণ চিন্তার প্রকাশ। তা হলে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির হইচই কি শুধুই ভোটের জন্য? কিন্তু ভোটের হিসাবে সরকারি কর্মচারীদের ভোট বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নয়। তা ছাড়া যোগী আদিত্যনাথ ও হিমন্তবিশ্ব শর্মা দেখিয়ে দিয়েছেন, তোষণ ছাড়াও নির্বাচনে জেতা যায়।

গণতন্ত্রে জনগণই শেষ কথা, সুতরাং একেবারে তাঁদেরই প্রশ্নটা করা হোক— জনসাধারণের টাকায় মহার্ঘ ভাতা, না উজ্জ্বলা যোজনা এবং লক্ষ্মীর ভান্ডার? একটা গণভোট হয়ে যাক।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement