বেশ কয়েকটি ‘প্রথম বার’ জুড়ে গিয়েছে পহেলগাম ঘটনার সঙ্গে। তার মধ্যে একটি, কেন্দ্রীয় সরকারের ভুল স্বীকার। সর্বদলীয় বৈঠকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ নিজমুখেই বলেছেন বিচ্যুতির কথা। সংসদীয় বিরোধী নেতা মল্লিকার্জুন খড়্গে অবশ্য জরুরি প্রশ্নটি তুলেছেন— দেশের এত বড় সঙ্কটের সময়ও প্রধানমন্ত্রী বৈঠকটিতে অনুপস্থিত থাকলেন কেন। বর্তমান ভারতে বিরোধী রাজনীতিকদের গলার স্বর ক্ষীণ— সংবাদমাধ্যম ও সমাজমাধ্যমের যৌথ ব্যবস্থাপনায় শাসক দলের প্রবল ডেসিবেল-প্লাবন বিরোধীদের ক্ষীণ স্বরকেও নিমজ্জিত করে দেয়। ফলে খড়্গের প্রশ্নটির যে তীব্রতায় অনুরণিত হওয়ার কথা ছিল, তা দেখা গেল না। এমন নৃশংস ঘটনার জন্য সারা দেশে লাগাতার ঘৃণা বর্ষিত হয়ে চলেছে জঙ্গিদের প্রতি, কাশ্মীরের সন্ত্রাসদীর্ণ পরিবেশের প্রতি, কাশ্মীর ও বাকি দেশের সংখ্যালঘুর প্রতি, এবং সর্বোপরি ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ সমাজের প্রতি—অথচ তার মধ্যে এই প্রয়োজনীয় প্রশ্নটি প্রায় হারিয়ে যেতে বসল যে, এই ঘটনার প্রাথমিক দায়টি আসলে কার। সর্বদলীয় বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর অনুপস্থিতির কারণ— এই ভ্রান্তি ও বিচ্যুতির সঙ্গে যাতে তাঁর কোনও ব্যক্তিগত সংযোগ না তৈরি হয়— এমন যদি কেউ অনুমান করেন, তাঁকে বিশেষ দোষ দেওয়া যায় না। তবে ইতিমধ্যে স্পষ্ট যে, এ বারের সন্ত্রাসে গোয়েন্দা ব্যর্থতার পরিমাণটি বিরাট, ঠিক যেমন ২০২৩ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ইজ়রায়েলে হামাস আক্রমণের সময়ে নেতানিয়াহু সরকারের ক্ষেত্রে ঘটেছিল।
ইজ়রায়েলের তুলনাটি বিরোধী শিবির থেকেও ধ্বনিত হয়েছে। কংগ্রেস সাংসদ শশী তারুরের বক্তব্য, কোনও দেশেরই গোয়েন্দা তথ্য সর্বদা–অভ্রান্ত হতে পারে না, ইজ়রায়েলও পারেনি। বাস্তবিক, এ বিষয়ে দ্বিমত হওয়া অসম্ভব। কূটনীতিজ্ঞ মাত্রেই আগাম তথ্যের এই স্বাভাবিক সীমা বিষয়ে সচেতন। তা সত্ত্বেও বলতে হয় যে, এত বড় ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর তা নিয়ে উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ, আশঙ্কা, আতঙ্কের বদলে ‘হতেই পারে’ মার্কা দায়হীনতা বিপজ্জনক। কেননা, এ কোনও সাধারণ ভুল নয়, এর সঙ্গে নাগরিকের প্রাণের নিরাপত্তা জড়িত। তদুপরি, শাসকের বদলে তা যদি বিরোধীর দিক থেকে আসে, তা হলে তো এমন মন্তব্য বিপজ্জনকও বটে। সরকারের কোন স্তরে সংযোগ-সমস্যা হল, কেন তথ্য-সংগ্রহের যথেষ্ট ব্যবস্থা হল না— এ সব প্রশ্ন তোলা তো বিরোধীদেরই কাজ। প্রসঙ্গত মনে করা যেতে পারে, ২০০৮ সালে মুম্বইয়ে তাজ হোটেলে ঐতিহাসিক জঙ্গি হানার পর মনমোহন সিংহ সরকারের বিরুদ্ধে বিজেপির তীব্র প্রচারের কথা। তার এক মাসের মধ্যেই দিল্লি ও রাজস্থানের বিধানসভা নির্বাচনের মুখে, গুজরাতের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মুম্বইতে অকুস্থলে দাঁড়িয়ে দেশরক্ষায় সরকারের ‘তুমুল ব্যর্থতা’র কথা তুলেছিলেন। এ বারের কাশ্মীরের ঘটনাও বলে দেয়, সন্ত্রাস প্রশ্নে এক বিন্দু আত্মতুষ্টি বা অন্যমনস্কতার অবকাশ নেই, কোনও সরকারেরই নয়।
এই বিরাট সঙ্কটমুহূর্তে জরুরি, সকল পক্ষের একযোগে জাতীয় স্বার্থ ও জাতীয় নিরাপত্তায় মনোযোগ প্রদান। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দেশের ‘সামগ্রিক ইচ্ছাশক্তি’ দেখানোর সময় এখন। সংসদীয় বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী কিরেন রিজিজু ও বিরোধী নেতা মল্লিকার্জুন খড়্গেও সুস্পষ্ট উচ্চারণে মনে করিয়েছেন সমস্ত রাজনৈতিক দলের সহযোগিতার প্রয়োজনটি। অথচ হিন্দুত্ববাদী নেতারাই আবার ধর্মের ভিত্তিতে বিবাদবিরোধ, সংঘাতবিদ্বেষকে তুঙ্গে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। পশ্চিমবঙ্গের নেতৃমুখসমূহ মনে করলেই বোঝা যায়, বিজেপির ভূমিকাটি এ ক্ষেত্রে কেমন। দেশকে বৃহত্তর বিপদের মধ্যে ঠেলে দিচ্ছেন এঁরা। এই উস্কানি রাজনীতি এখনই বন্ধ হোক। বিদ্বেষপ্রচারে দৃষ্টান্তযোগ্য শাস্তির ব্যবস্থা করুন নেতারা, কথা ও কাজের দূরত্ব ঘুচান— দেশবাসীর নিরাপত্তা ও স্থিতির স্বার্থে। অনেক, অনেকটা ক্ষতি হয়ে গিয়েছে।
প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর
সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ
সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে