Death of Children Due To Conflicts

মৃত্যুর প্রহর গুনছে শৈশব

রাষ্ট্রপুঞ্জেরই হিসাবে, সুদানে গোষ্ঠীসংঘর্ষে প্রতি ঘণ্টায় ৭ শিশু নিহত বা আহত হচ্ছে। ইউনিসেফ-এর মতে ২০০৫ থেকে গত ১৬ বছরে সংঘাতে জর্জরিত আফগানিস্তানে ২৮,৫০০’র বেশি শিশু নিহত হয়েছে।

Advertisement

মালবী গুপ্ত

শেষ আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৭:৫৬
Share:

—প্রতীকী চিত্র।

আত্মরক্ষার কোনও কৌশলই যাদের জানা থাকে না, সেই রকম হাজার হাজার শিশুর রক্তে এই মুহূর্তে ভিজে যাচ্ছে গাজ়ার মাটি। শুধু গাজ়া কেন, সংঘর্ষদীর্ণ আফগানিস্তান, ইয়েমেন, সিরিয়া, ইরাক, মালি, নাইজিরিয়া, সোমালিয়া, সাউথ সুদান, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক ও ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর মতো বিশ্বের অন্তত ১০টি দেশও কয়েক দশক ধরে শিশুহত্যায় রক্তস্নাত। যদিও আজ আর কোনও সহিংস মৃত্যুর খবরই, সে শিশুর হোক, সে মৃত্যুর সংখ্যা মাত্র কয়েক দিনেই হাজার ছাড়িয়ে যাক— আমাদের তেমন আর স্পর্শ করে না। না হলে গাজ়ার গণহত্যা ও নৃশংস শিশুহত্যার প্রতিবাদে সবাই রাস্তায় নামতাম।

Advertisement

‘সেভ দ্য চিলড্রেন’ সংস্থার মতে, ২০১৯ থেকে পৃথিবীতে ঘটে চলা সমস্ত যুদ্ধ বা সংঘর্ষে বছরে যত শিশুর মৃত্যু হয়েছে, ৭ অক্টোবর শুরু হওয়া হামাস-ইজ়রায়েল সংঘর্ষে শুধু গাজ়া স্ট্রিপেই মাত্র ৩ সপ্তাহে ইজ়রায়েলি হানায় নিহত হয়েছে তার থেকে অনেক বেশি। ধ্বংসস্তূপের নীচে চাপা পড়া সহস্রাধিক শিশুর কান্না স্তব্ধ হয়ে গেছে। কখনও কখনও কোনও শিশুর আর্তি হয়তো ভেসে আসছে। ধ্বংসস্তূপে পড়ে থাকা নিহত মা বাবা পরিজনদের রেখে, ২ বছরের লারিন হোসেন বা নিজের দু’টি পা হারানো ৩ বছরের আহমেদ শাবাতের মতো অসংখ্য একাকী শিশু, হাসপাতাল বা শরণার্থী শিবিরে স্থানান্তরিত হচ্ছে। কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না, সেখানে তাদের পরমায়ু ক’মিনিট, ক’ঘণ্টা বা ক’দিন।

পারছেন না, কারণ শরণার্থী শিবির ও হাসপাতালগুলিকেও ইজ়রায়েলি যুদ্ধ বিমান অহরহ গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। যদিও দ্য জেনিভা কনভেনশন এবং শিশু অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রপুঞ্জের কনভেনশন অনুযায়ী, স্কুল, হাসপাতাল, শরণার্থী শিবিরে কোনও অজুহাতেই হামলা চালানো যায় না। কিন্তু তাতে কী? দেখা যাচ্ছে যুদ্ধের আইন বা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার রক্ষার আইন লঙ্ঘনে কী সন্ত্রাসবাদী, কী তাদের দমনকারী রাষ্ট্র, সকলের ভূমিকাই সমান।

Advertisement

অন্য দিকে, রাষ্ট্রপুঞ্জেরই হিসাবে, সুদানে গোষ্ঠীসংঘর্ষে প্রতি ঘণ্টায় ৭ শিশু নিহত বা আহত হচ্ছে। ইউনিসেফ-এর মতে ২০০৫ থেকে গত ১৬ বছরে সংঘাতে জর্জরিত আফগানিস্তানে ২৮,৫০০’র বেশি শিশু নিহত হয়েছে। সেভ দ্য চিলড্রেন-এর রিপোর্ট বলছে, বিশ্বে ২০১৩ থেকে ২০১৭-র মধ্যে এক বছরের কমবয়সি ৫ লক্ষ ৫০ হাজারের বেশি শিশুর মৃত্যু হয়েছে ভয়ঙ্কর সংঘর্ষের প্রভাবে। দেখা যাচ্ছে আজ পৃথিবীর প্রায় ৪২ কোটি শিশুই সশস্ত্র সংঘাতে বিপর্যস্ত এলাকায় বাস করতে বাধ্য হচ্ছে।

প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মতোই সংঘর্ষ বা যুদ্ধের শিকার সবচেয়ে বেশি হয় শিশু ও নারী। আত্মরক্ষায় অসমর্থ শিশুরা আপনজনকে হারিয়ে কোনও মতে বেঁচে গেলেও, ইয়েমেনের ওয়াফা-র মতো তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ছে। ২০১৮ সালে বন্দর শহর হোদেইদাহ’তে বিমানহানায় চার বছরের ওয়াফা-র বাবা-মা’সহ পরিবারের সবাই নিহত হয়। মাথায় গভীর ক্ষত নিয়ে ওয়াফা ও তার ২ বছরের বোন শাদিয়া সে দিন বেঁচে যায় বটে, তবে আজও ওয়াফা ঠিকমতো দাঁড়াতে পারে না। ঘুমোতে পারে না। দুঃস্বপ্নে চিৎকার করে জেগে ওঠে।

যদিও গাজ়ার আকাশ এখনও শকুনের ডানায় ঢাকা পড়ে যায়নি। এখনও সেখানে নেমে আসেনি শ্মশানের স্তব্ধতা। কারণ এখনও সেখানে মুহুর্মুহু ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় বা বোমার আঘাতে ক্রমাগত ঘর বাড়ি হাসপাতাল শরণার্থী শিবির ভেঙে পড়ার শব্দ। যা ছাপিয়েও কখনও কখনও উঠে আসছে শিশু নারী-সহ মৃত্যুর প্রহর গোনা হাজার হাজার আহত নাগরিকের যন্ত্রণা ও কান্নার আওয়াজ।

এমনিতেই গত ১৬ বছর ধরে স্থল, জল ও আকাশপথ ইজ়রায়েলি অবরোধে অবরুদ্ধ গাজ়ার কোনও নাগরিকেরই স্বাভাবিক জীবনযাপনের অধিকার নেই। তার উপর লাগাতার আক্রমণের কী মারাত্মক প্রভাব পড়ছে সেখানকার শিশুমনের উপর, তা ভাবাই দুষ্কর। সেভ দ্য চিলড্রেন-এর ২০২২-এর রিপোর্ট বলছে, মানসিক আঘাতে সেখানকার প্রতি ৫ জন শিশুর মধ্যে ৪ জনই আতঙ্কে, উৎকণ্ঠায়, বিষাদে এখন বিপর্যস্ত। যুদ্ধের নামে সেখানে চলতে থাকা গণহত্যা ও বীভৎস ধ্বংসের মধ্যে থেকে বেঁচে ফেরা শিশুরা নিয়ত যে ভাবে তাদের বাবা মা ভাই বোন বন্ধুদের মৃত্যু প্রত্যক্ষ করছে, শিশুমন সেই অমানুষিক দুঃখ ও যন্ত্রণার ধাক্কা সইতে পারবে কি?

এবং এই উন্মত্ত হিংসার পৃথিবীতে ওয়াফা-র মতো লক্ষ লক্ষ শিশু শেষ পর্যন্ত যদি বাঁচার সুযোগ পেয়েও যায়, তা হলেও কি তারা কোনও দিন পুরোপুরি সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের নাগাল পাবে? সময় কি তাদের সংঘর্ষের আতঙ্ক ও বিষাদ স্মৃতি মুছিয়ে দিতে পারবে?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement