Bangladesh Liberation War

‘বীরাঙ্গনা’ নয়, মুক্তিযোদ্ধা

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের নারী মানেই নির্যাতিত নারী, অথবা আহত পুরুষ যোদ্ধাদের সেবার কাজে যুক্ত নারী বলেই গণ্য হয়েছেন। অথচ, অনেকেই সরাসরি যুদ্ধে নেমেছেন।

Advertisement

আফরোজা খাতুন

শেষ আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৮:৪৬
Share:

—ফাইল চিত্র।

আর দুই দিন পর, ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় দিবস। একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা বলতে সাধারণত মনে করা হয় বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য যে সব পুরুষ লড়াই করেছেন, তাঁদের কথা। নারীও যে মুক্তিযুদ্ধের শরিক ছিলেন, তা তেমন ভাবে স্বীকৃত হয়নি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে যে কথাটা জুড়ে আছে তা হল, ত্রিশ লাখ শহিদ এবং দু’লাখ নারীর ইজ্জতের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে। লিঙ্গ রাজনীতির ভাষায় ধর্ষণের সঙ্গে ‘ইজ্জত’ শব্দ যুক্ত হয়। এ ভাবে চিন্তাকে প্রভাবিত করায় বিপদ বাড়ে নির্যাতিতা নারীদের। মুক্তিযোদ্ধা নারীরা দেশ স্বাধীন করার স্বপ্ন নিয়েই যুদ্ধে যোগদান করেছিলেন। তাঁদের উপর নেমে এসেছিল যৌন নির্যাতন। বুলেটের আঘাতে যে পুরুষ যোদ্ধা আহত হয়েছেন, সমাজ তাঁকে নিয়ে গর্বিত। কিন্তু যৌন আঘাতে যে নারীযোদ্ধা আহত হলেন, সমাজ তাঁকে নিয়ে লজ্জিত। দুটোই নির্যাতন, তবু পিতৃতান্ত্রিক ভাবনার জন্য যুদ্ধ-পরবর্তী নারীদের জীবনে শোচনীয় অবস্থান নির্ধারিত হল।

Advertisement

বলা হয়, বাংলাদেশের দু’লাখ নারী পাকিস্তানি সেনা বা রাজাকারদের যৌন হিংস্রতার শিকার হয়েছিলেন। এঁদের কেউ কেউ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে সেনাদের গতিবিধির খবর পৌঁছে দিয়েছেন। কেউ সশস্ত্র যুদ্ধেও যোগ দিয়েছেন। কেউ অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছেন, বা তাঁদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন, তাঁদের খাবার তৈরি করে দিয়েছেন। মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে গিয়ে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের শুশ্রূষা করেছেন অনেক মেয়ে। সাংস্কৃতিক কর্মীর ভূমিকায় গান, কবিতার মাধ্যমে যোদ্ধাদের মনোবল বাড়িয়েছেন। কোনও দল আবার ঘুরে ঘুরে প্রচার চালিয়ে যুদ্ধের জন্য অর্থ, যোদ্ধাদের প্রয়োজনীয় কাপড় বা ওষুধ সংগ্রহ করেছেন। এই সব করতে গিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে নারীরা নির্যাতিত, এমনকি খুনও হয়েছেন। দেশের মুক্তির জন্য নারীরা এমন নানা কাজে যুক্ত ছিলেন। মৃত্যুভয় এবং শরীর ‘শুদ্ধ’ রাখার ভাবনাকে তুচ্ছ করে যাঁরা এ ভাবেই যুদ্ধের ময়দানে যোগ দিয়েছিলেন, তাঁরা কি মুক্তিযোদ্ধা নন?

অথচ, যুদ্ধশেষে নারী মুক্তিযোদ্ধারা অদৃশ্য হয়ে গেলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে বহু নারীর জীবনে নেমে এল এক কালো অধ্যায়। শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধকালীন ধর্ষিত নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধি দেন, তাঁদের নানাবিধ সুবিধা দিয়ে সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। ‘বীরাঙ্গনা’ শব্দটি কিন্তু সামাজিক দৃষ্টিতে বীরত্বের স্বীকৃতি বলে গণ্য হয়নি। বরং এই শব্দ মেয়েদের ‘অপর’ একটি গোষ্ঠী হিসাবে চিহ্নিত করেছে। তাই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফেরত স্বাধীন বাংলাদেশের নারীরা বাবা, স্বামী, সন্তানের কাছ থেকে বিতাড়িত হয়ে নিজেদের মুক্তির জন্য আবার এক যুদ্ধের সম্মুখীন হলেন। আর্থিক নিরাপত্তা, সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে তাঁদের খুঁজে নিতে হল গোপন ডেরা, লোকচক্ষুর আড়াল।

Advertisement

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের নারী মানেই নির্যাতিত নারী, অথবা আহত পুরুষ যোদ্ধাদের সেবার কাজে যুক্ত নারী বলেই গণ্য হয়েছেন। অথচ, অনেকেই সরাসরি যুদ্ধে নেমেছেন। শিরিন বানু মিতিল মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদার রুখতে সম্মুখ সমরে যোগ দিয়েছিলেন। পুরুষের পোশাক পরে তিনি সহযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেন। মিতিল মনে করেন “নারীদের যোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি না পাওয়ার কোনও ব্যাখ্যা আমি খুঁজে পাই না। কেন আর একটা নাম দিয়ে সমাজে চিনিয়ে দেওয়া হলো, বীরাঙ্গনা। তাতে আমরা আরও দুর্বল হলাম। আমাদের পরিচয় হারিয়ে গেল” (উদিসা ইসলাম: সাক্ষাৎকার, বীরাঙ্গনার জীবনযুদ্ধ)। ১৯৭২ সালে ‘বীর প্রতীক’ পুরস্কার পাওয়া তারামন বিবির যোদ্ধা হিসাবে দেশবাসীর কাছে দৃশ্যমান হতে তেইশ বছর লেগেছে। অস্ত্র হাতে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প থেকে তিনি যুদ্ধ করেছিলেন। ‘বীর প্রতীক’ পুরস্কার পাওয়া ক্যাপ্টেন সিতারা মুক্তিযোদ্ধাদের হাসপাতালে চিকিৎসক ও নার্সের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তাঁকে অবশ্য তুলনায় বেশি মনে
রাখা হয়েছে।

পরাজিত হয়ে চলে যাওয়ার সময় বাঙ্কারে নির্যাতিত নারীদের কাছে রেখে দিয়ে যায় পাক সেনারা। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে তথ্য পাচারেও তাঁদের সহযোগিতা ছিল। বাঙ্কার থেকে বেরিয়ে নিজের জীবনের সত্য ঘটনা কাউকে বিশ্বাস করাতে পারেননি সেই নারীরা। কলঙ্কিতের তকমা আর অপমানের বোঝা নিয়ে বাড়ি ছেড়েছেন। তাঁরা নিজেদের নাম প্রকাশেও অনিচ্ছুক। কারণ তাঁদের পরিবারকেও যে সামাজিক কটূক্তির মধ্যে পড়তে হবে। কোনও অপরিচিত পরিমণ্ডলে আত্মপরিচয় গোপন করে জীবনটা কোনও রকমে কাটিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তাঁরা।

তবে সামাজিক আন্দোলনের কর্মী, গবেষক, সকলের প্রচেষ্টা হোক তাঁদের কাজের সঠিক মূল্যায়ন করা। তাঁরা বীরাঙ্গনা নয়, মুক্তিযোদ্ধা: এই দাবিতে সরব হয়ে তাঁদের বর্তমান অবস্থান ও অতীতের অত্যাচারের কথা লিপিবদ্ধ করা শুরু হয়েছে। তবে সে সংখ্যাটাও বেশি নয়। স্বাধীনতা অর্জনের পঞ্চাশ বছর পার করে দেওয়া বাংলাদেশ এই মুক্তিযোদ্ধা নারীদের অবসাদ, অভিমান আর আত্মহত্যার স্মৃতি বহন করছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement