বরণমালা: নায়ক ও দর্শককে কাছাকাছি এনেছে এ বছর। কলকাতা, সেপ্টেম্বর ২০২৩।
আজকের দিনে হল-এ গিয়ে সিনেমা দেখে কে? জোর তর্ক হচ্ছিল চা-দোকানে। আর কে না জানে, দিনকাল জমানা-বাহানার হালহদিস পেতে পাড়ার চা-ঠেক এখনও নির্বিকল্প, এই অ্যালেক্সা গুগল এআই-যুগেও! সেখানেই কথা উঠেছিল, একটা আস্ত বছর যে মুড়োতে চলল, এ বার এই সিদ্ধান্তে থিতু হওয়া যায় কি না যে কোভিড-উত্তর ‘নিউ নর্মাল’-এ ওটিটি-ই হয়ে দাঁড়িয়েছে সিনেমাহল? হল-এ গিয়ে ছবি দেখে তো দুই কিসিমের লোকে: ‘ভক্ত’রা, আর ‘শাহরুখ ও সলমন খানের ভক্ত’রা!
ভক্তিতেও তফাত, সে কী রকম? বিলক্ষণ আছে, আলবত আছে। গোঁড়া ভক্ত, পাগল ভক্ত, রাগী ভক্ত, মৃদু ভক্তে ফারাক নেই? দ্য কেরালা স্টোরি-কে হল-এ গিয়ে হিট করালে কারা? গুগল খুলে দেখে নিন মশাই, রকি অউর রানি কি প্রেম কহানি-র ট্যাঁকে যেখানে ৩৫৫ কোটি, কেরালা স্টোরি সেখানে প্রায় ৩০৪ কোটি কামিয়ে দুধের সর খেল বছরের মধ্যিখানে। রাজনীতি কী করতে পারে তার মোক্ষম ও নগদ প্রমাণ। যাঁরা ‘আমি বাপু রাজনীতিতে নেই’ আওড়ে বেড়ার উপর বসে পা নাচাচ্ছিলেন, তাঁরাও চুপিচুপি সে ছবি দেখে নিয়েছেন পরে ওটিটি-তে। সেই লাভের গুড়ের আবার আলাদা হিসাব।
চায়ের ঠেকের অঘোষিত নিয়মই হচ্ছে টুক করে উস্কে দেওয়া, যাতে ঝড় ও নির্ঝর দুইয়েরই স্বপ্নভঙ্গ হয়ে প্যাশনের হড়পা বান নেমে আসে। এক জন সোনামুখ করে বললেন, রাজনীতিকেই শুধু কাঠগড়ায় তোলা কেন বাপু, যা সব ছবি চলছে হল-এ! অ্যানিম্যাল নিয়ে কী বলবেন? ওতে তো আর রাজনীতি নেই, পার্টিও ধুয়া তুলে হিট করায়নি, তবে? পিলপিল করে লোকে দেখছে না? ও ছবি যা লাভ করেছে, প্রোডিউসার আর ডিরেক্টর কোন দেশে পা নাচাতে নাচাতে ইয়ারএন্ড কাটাবে তাই দেখুন।
এ-ও ভক্তির জোর, বলতে হবে। পলিটিক্যাল ভক্ত হল-এ গিয়ে (এবং লোক নিয়ে গিয়ে) লাভ জেহাদের ককটেলে কেরলের মেয়েদের আইএস জঙ্গি হওয়ার গপ্প হিট করাচ্ছে এও নাহয় মানা গেল, বছরশেষে অ্যানিম্যাল-এর বক্সঅফিস-কেরদানির পিছনে কোন ভক্তি? আলফা-মেল, টক্সিক ম্যাসকুলিনিটি নিয়ে জনপরিসরে আজকাল এত কথা, তারই অনুরক্তি? ভেবে দেখার মতো।
ডিসেম্বরের এই সময়টায় রাজনীতি অর্থনীতি ব্যবসা-বাণিজ্যের সালতামামির খোঁজখবরের সময়। বিনোদন-দুনিয়ার, বিশেষত সিনেমা-ওটিটি জগতের বিপণন ও বাণিজ্য-প্রবণতার দিকে নজর ফেরালে অবশ্য একটু হকচকিয়ে যেতে হবে। বছরখানেক আগে, খেয়াল করলে দেখবেন, বলিউডে যেন শনির দশা চলছিল। এক দিকে এই ছবি বয়কট করো, অমুক নায়ক বা নায়িকাকে বয়কট করো রব, অন্য দিকে দক্ষিণী ছবির মারকাটারি বাজার, দুইয়ে মিলে সে যেন বলিউডের অস্তিত্ব সঙ্কট। এই আবহেই উঠে আসছিল কথাটা— সিনেমাহলে গিয়ে ছবি দেখার এই বুঝি দি এন্ড, ওটিটি এ বার বাজারে ঝাঁপাবে সর্বশক্তি নিয়ে। এই ভাবনা যে অসার তা মোটেই নয়, হলিউডের বাণিজ্যের খোঁজখবর একটু-আধটু রাখেন যাঁরা জানেন, ২০২০ সালে কোভিডের সময় থেকেই হলিউডের তাবড় স্টুডিয়ো সংস্থাগুলো মরিয়া হয়ে উঠেছিল নিজেদের ‘স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম’ বাজারে আনতে। সিনেমাহল বন্ধ, গোটা দেশ আর পৃথিবীও ঝাঁপ ফেলেছে, খেয়েপরে তো বাঁচতে হবে!
সেই মহাধাক্কা সামলে বেঁচেবর্তে থাকার চ্যালেঞ্জ সামলাতেই বিগত দুটো বছর হুস করে উধাও। ২০২৩ কিন্তু হলিউড বলিউড দুই মুখেই হাসি ফুটিয়েছে, অস্বীকারের উপায় নেই। ‘বার্বেনহাইমার’ তো শুধু পপ-কালচারের বানানো শব্দ নয়, রীতিমতো ঘটনা একটা। বার্বি আর ওপেনহাইমার, দুই সম্পূর্ণ ভিন্ন মেরুর ছবি সিনেমাহলে এমন ব্যবসা দিয়েছে যে চোখে ঝিলমিল লেগে যাওয়ার জোগাড়: তবে যে শুনছিলুম ওটিটি-ই আইডেন্টিটি? ভারতেও একই চিত্র। এ বছর জানুয়ারিতে, ২৬ জানুয়ারির মুখে পঠান মুক্তি পেল, শাহরুখ খান একা হাতে আরও কত কিছুর যে শৃঙ্খলমুক্তি ঘটালেন! বাংলার, ভারতের কত জায়গায় কত সিঙ্গল স্ক্রিন সিনেমাহল বুক ভরে শ্বাস নিল, আম দর্শক ফিরলেন সিনেমাহলে ছবি দেখতে। মাল্টিপ্লেক্সে তিনশো টাকার টিকিটের সঙ্গে সাড়ে ছ’শোর ঢাউস পপকর্ন-বালতি হাতে সেঁটে ছবি-দেখা দর্শক নয়, পঞ্চাশ সত্তর বড় জোর ‘শারুক্ষানের ছবি’ বলে একশো টাকার জ্যালজেলে টিকিট কেটে হল-দাপানো কাঁপানো আম দর্শক। সেই বেলাগাম দর্শক, চলচ্চিত্র-বাণিজ্যের অদৃশ্য ও আসল লাগামটা যাঁদের হাতে।
ভাল-খারাপ ছবির বিচার, ছুতমার্গ, উন্নাসিকতা এখানে কল্কে পায় না। কোন ছবিটা এলোমেলোড্রামা, কোথাকার প্লট কোথায় গড়াচ্ছে, কার অ্যাকশন দেখে বিজ্ঞানও বিছানা নেবে, এই সবই অর্থহীন, কারণ আত্ম ও সমষ্টির দেখনদারি-সর্বস্ব এই কালে ‘স্পেক্ট্যাকল’-ই একাধারে ‘মাস’ ও ‘মার্কেট’-এর আশ্রয় এবং প্রশ্রয়। বছরের সেরা ব্যবসা দেওয়া ছবিগুলি তাই জওয়ান, পঠান, অ্যানিম্যাল, গদর-টু, টাইগার-থ্রি হবে এবং হতেই হবে, সন্দেহ নেই। বছরশেষেও শাহরুখ খান সিনেমাহলে হাজির নতুন ছবি নিয়ে, তার ব্যবসার হিসাবনিকাশ হবে নতুন বছরে, ২০২৪-এর মাঠে বিনোদন-বাণিজ্যকে তা একটা জম্পেশ রান-আপ দেবে, ধারণা করাই যায়।
এই সমগ্রচিত্রের মধ্যে ওটিটি-র স্থান ও অবদান কী, কতটুকু? দু’রকম মত ও তার পক্ষে যুক্তি-প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে। প্রথম মত, স্টার নায়ক-নায়িকা আর বড় পরিচালকের তৈরি ছবিও দেখা গেছে ওটিটি-তে মুক্তি পেয়ে তেমন সুবিধা করতে পারেনি। সাধারণত ফিল্মি কুকথা বা তা ঘিরে বিতর্ক ছবি ঘিরে এক রকম উত্তেজনা ও আগ্রহের জন্ম দেয়। বছরের মাঝে একটা ছবি নিয়ে একপ্রস্ত হইচই হল, সেখানে একটা ফ্যান্টাসি-দৃশ্যে নায়ক-নায়িকাকে দেখা যায় গ্যাস চেম্বারে বন্দি, নায়িকা বলে: “আমরা সবাই ভিতরে ভিতরে একটু হিটলারের মতো, না?” আর এক জায়গায় বলে, “প্রত্যেকটা সম্পর্কের মধ্যেই একটা করে অউশভিৎজ় থাকে।” হলোকস্ট-এর ভয়ঙ্করতাকে এ ভাবে খেলো করার মানে কী, এ সব তর্ক পেরিয়ে দেখা গেল, ছবিটা ওটিটি-রিলিজ়েও দর্শক টানতে পারেনি। বিখ্যাত জাপানি রহস্যোপন্যাস-আধারিত এক ছবি নিয়ে আর এক বিরাট ওটিটি-প্ল্যাটফর্মে বেশ ‘আসছে আসছে’ ভাব তৈরি হল সেপ্টেম্বরে, করিনা কপূরের ‘কামব্যাক ফিল্ম’, সঙ্গে দুই তুখোড় চরিত্রাভিনেতার অভিনয় ইত্যাদি। কিন্তু তার পর? ‘তরঙ্গ মিলায়ে যায়, তরঙ্গ উঠে’— এর বেশি কী-ই বা?
‘পপুলার কালচার’ বিষম বস্তু, ওতে কোন ছবি কোন সংলাপ কোন দৃশ্য কখন কোন পথে ঢুকে পড়বে বলা মুশকিল। কিন্তু ওই ঢুকে পড়তে পারাটাই সাফল্য, ওতেই কেল্লা ফতে। ইরানি লোকগান ‘জামাল কুদু’র সুর ধরে বিস্মৃত নায়ক বড় পর্দায় সগৌরবে ফিরে এলেন, ‘লেটেস্ট অ্যান্ড আনলিমিটেড কনটেন্ট’-এর পেশি ফুলিয়ে বছরভর ছবি আর ওয়েব সিরিজ় উগরে যাওয়া ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো কি চলচ্চিত্র বা তার কুশীলবদের সেই উড়াল দেওয়ার রানওয়ে জোগাতে পারছে? ওটিটি ঘিরে দ্বিতীয় মতপন্থীরা এই জায়গাটাতেই যুক্তি শাণাচ্ছেন। ছবি মানে শুধু স্টার নয়, শুধু বিগ বাজেট নয়। ছোট বাজেটের ছবি, যেখানে ইয়াব্বড় তারকা নেই, বিপণনের চোখ-ধাঁধানো গিমিক নেই, তারা বেশ জায়গা করে নিয়েছে ওটিটি-তে, এবং গৃহকোণে দর্শকমনেও। ওয়েব সিরিজ়ের ক্ষেত্রে তো এ কথা আরও বলতে হবে, কেননা চরিত্রাভিনেতার জন্য সে খুলে দিয়েছে একটা বিরাট মাঠ। ছোট শহর মফস্সল বা গ্রামের রাজনীতি মাদক প্রেম চাকরি অসম্মান এমনকি অপরাধের মধ্যে কাটানো মানুষের মধ্যে যে অ-হিরোসুলভ সাধারণত্ব, তা-ই হয়ে উঠেছে তার তুরুপের তাস। কলকাতা বা কোচবিহারে বসে আপনি দেখে নিচ্ছেন রাজস্থানের গ্রামে সিরিয়াল কিলারকে ধরতে চাওয়া নিচু জাতের এক নারী-পুলিশের অভিযান, বুঝতে পারছেন ব্যক্তি বা সমষ্টির সঙ্কটে পঞ্জাব উত্তরপ্রদেশ গুজরাত তামিলনাড়ুর প্রত্যন্তেও বাংলার সঙ্গে কী এক অসম্ভব মিল।
ওটিটি-তে লাভ-ক্ষতির অঙ্কটা জটিল, আর বহুধাবিভক্ত ‘কনটেন্ট’ থাকে বলে তার হিসাব কষার মাপকাঠিও ভিন্ন। সিনেমাহলের ছবি-বাণিজ্যের প্রকরণ আলাদা, সেখানে ব্যবসার নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ করে বা ব্যর্থ হয়ে ছবির গায়ে সেঁটে যায় বিশেষণ: সুপার-ডুপার হিট, সুপারহিট, হিট, অ্যাভারেজ, প্লাস, ফ্লপ, লুজ়িং। হল-এ মুক্তি পাওয়ার কত দিন পর কোন ছবি ওটিটি-তে আসবে সে-ও নিয়মে বাঁধা, বা সুপরিকল্পিত। রণবীর কপূরের যে ছবি এখন হল কাঁপাচ্ছে, মধ্য-জানুয়ারিতেই হয়তো তাকে দেখা যাবে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে। তখন ফের চর্চা, ফের লাভ।
আর বাংলা ছবি, ওটিটি-র বাংলা কনটেন্ট? বছরশেষের হিসাব-খাতায় তার কী হাল? কে জানে কেন, বাংলা ছবির ব্যবসা নিয়ে স্পষ্ট তথ্য মেলে না। দর্শকও খুব জানতে আগ্রহী নন, নির্মাতারা তো ননই। মাঝে-মাঝে ফেসবুকে ঠাট্টা চলে, সমাজমাধ্যমের অপরিহার্য নিয়ম মেনে তা অচিরে গড়ায় কলতলার কাজিয়ায়। আর ওটিটি? কিছু দিন আগে ওটিটি-তে আসা এক বাংলা ওয়েব সিরিজ়ের খুব নাম করছিলেন এক বন্ধু। ভাল-লাগার কী ও কেন নিয়ে চেপে ধরতে তাঁর উত্তর, “এখন তো বাংলা কনটেন্ট ‘দেখা’ যায় না, এটা তুলনায়...” বছরশেষে হাতে ব্যবসা না থাক, শিল্পের পেনসিলটুকু রইল, কম কী!