দুর্নীতির অভিযোগের চেয়ে কি জনমুখী প্রকল্পের গুরুত্ব বেশি
West Bengal Panchayat Election 2023

লোকসভার পূর্বাভাস?

এ বারের ভোট গ্রামীণ ক্ষেত্রে, কোচবিহার ও সদ্যগঠিত জেলা আলিপুরদুয়ার বাদে, ফের তৃণমূল কংগ্রেসের একাধিপত্যকে প্রতিষ্ঠা দিল।

Advertisement

শিবাজীপ্রতিম বসু

শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০২৩ ০৪:২৫
Share:

নাগরিক: মুর্শিদাবাদে পঞ্চায়েত ভোটের লাইনে অপেক্ষমাণ জনতা। ৮ জুলাই, ২০২৩। —ফাইল চিত্র।

এই পৃথিবীর রণ রক্ত সফলতা সত্য; তবু শেষ সত্য নয়।

Advertisement

‘সুচেতনা’, জীবনানন্দ দাশ

কবি-সতর্কবাণী ‘হিংসায় উন্মত্ত’ গ্রামবাংলা মনে রাখল কই? রবীন্দ্রনাথের রাজর্ষি উপন্যাসে মন্দিরে শ্বেতপাথরের উপরে রক্তের ধারা দেখে ফুলের মতো বালিকা ‘হাসি’ রাজাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, “এত রক্ত কেন?” গত পাঁচ দশক ধরে এ রাজ্যে গণতন্ত্রের সোপানতলে শুধু রক্ত নয়, মৃত্যুর যে ধারা অব্যাহত, যার রক্তাক্ত সাক্ষ্য বহন করল গত সপ্তাহের ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত নির্বাচন, তাতে প্রশ্ন করা যায়, ‘এই মারণোৎসবের শেষ কোথায়’?

Advertisement

শেষের কথা জানি না, শুরুর কথাও কি জানি? এর উৎস কি ১৯৪০-এর দশকের প্রাক্-স্বাধীন বাংলায় সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী রাজনৈতিক সংগ্রাম ও জমির অধিকারের লড়াইয়ে শামিল হওয়া গ্রামীণ মানুষের সশস্ত্র প্রতিরোধে? না কি, স্বাধীনতা-উত্তর খণ্ডিত বাংলায় ১৯৫০-এর দশক থেকে শুরু হওয়া বামপন্থীদের জঙ্গি আন্দোলনে, যা ১৯৬০-এর দশকের মধ্যবর্তী পর্যায় থেকে সূচনা করেছিল অতিবামপন্থার রক্তক্ষয়ী অধ্যায়? ১৯৭২-এর বিধানসভায় সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের নেতৃত্বে থাকা কংগ্রেসের ‘বিরোধী-নিকেশি’ নির্বাচনী সন্ত্রাসে? বা, প্রথম দশ বছর বাদ দিয়ে বামফ্রন্টের দীর্ঘ নিরঙ্কুশ শাসনে? উৎস যা-ই হোক, তা যে বাংলার নির্বাচনী রাজনীতির— বিশেষত গ্রামবাংলায়— সাংস্কৃতিক পরম্পরায় পরিণত হয়েছে, তাতে সন্দেহ কী! ফলে, গ্রামগুলি নানান রাজনৈতিক দাপটের ‘এলাকা’য় পরিণত হয়েছে, যা ‘দখল’-এর জন্য নানা দল ও উপদলের মধ্যে নিরন্তর ‘লড়াই’— সারা বছরব্যাপী চোরা লড়াই, বা নির্বাচনের মরসুমে প্রত্যক্ষ ভাবে— চলতেই থাকে। আগেও তা ছিল, এখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উন্নয়নের জন্য গ্রাম পঞ্চায়েতের হাতে আসা কোটি কোটি টাকা নিয়ন্ত্রণের আকুলতা, ফলে এখন তার লড়াইয়ের রূপটিও হিংস্র থেকে হিংস্রতর!

কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে, এ বারের গ্রামীণ ভোটে রাজ্যে যে তৃণমূল কংগ্রেসের আধিপত্য কায়েম থাকবে, তার ইঙ্গিত প্রাক্-নির্বাচনী সমীক্ষাতেই ছিল। তবু কেন এত রক্ত ঝরল? প্রধান কারণ, গত পঞ্চায়েত ভোটে (২০১৮) প্রায় ৩৪% আসন শাসক দল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছিল, এ বার তা নেমে ১২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ, ৮৮% আসনে ‘বহুমুখী লড়াই’ হয়েছে। এই ‘বহুমুখ’-এ তৃণমূল ছাড়াও রয়েছে প্রধান বিরোধী দল বিজেপি ও বাম-কংগ্রেস জোট (কোথাও তারা জোটবদ্ধ, কোথাও পৃথক ভাবে লড়েছে)। তিন প্রধান পক্ষ ছাড়া ছিল এসইউসিআই বা নওসাদ সিদ্দিকির আইএসএফ, এবং কোথাও ছিলেন তৃণমূলের ‘বিদ্রোহী’, কোথাও কং-বাম-বিজেপি সমর্থিত নির্দল প্রার্থীরা।

পরিণামে, গ্রামস্তরে তৃণমূলের সংখ্যার প্রায় তিন গুণ প্রার্থী ছিলেন বিরোধী ও নির্দলদের। এবং তাঁরা নিজ নিজ এলাকায় ‘সামর্থ্য’ অনুসারে ও দাবি (বিশেষত, বামেদের) অনুযায়ী শাসক দলের ‘হিংসা’কে ‘রুখে দিতে’ (সংবাদপত্রেও এই ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে) ‘সক্ষম’ হয়েছেন। ভোটের শেষে শাসক দলের অভিযোগেও তার পরোক্ষ স্বীকৃতি মিলেছে— নির্বাচনের দিন যে ১৭ বা ১৮ জন হিংসার বলি হয়েছেন, তৃণমূল নেতৃত্বের দাবি, তাঁদের অধিকাংশই শাসক দলের কর্মী-সমর্থক। বুথ ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলে কেবল তৃণমূলই নয়, এলাকাবিশেষে বিরোধীরাও তাঁদের দাপট দেখিয়েছেন। মুর্শিদাবাদ, জলপাইগুড়ির বেশ কিছু অঞ্চলে শাসক দলই বিরোধীদের বিরুদ্ধে থানায় বিক্ষোভ দেখিয়েছে, কেন্দ্রীয় বাহিনীর সুরক্ষা চেয়েছে। তবে, তৃণমূল নেতৃত্ব নির্দিষ্ট অতি-অল্প সংখ্যক বুথে মাত্রাছাড়া হিংসার কথা বললেও, সোমবার ৬৯৭টি বুথে পুনর্নির্বাচনের নির্দেশে অনিয়ম ও হিংসার তত্ত্বেই সিলমোহর পড়ল।

এ বারের ভোট গ্রামীণ ক্ষেত্রে, কোচবিহার ও সদ্যগঠিত জেলা আলিপুরদুয়ার বাদে, ফের তৃণমূল কংগ্রেসের একাধিপত্যকে প্রতিষ্ঠা দিল। বিজেপিও দল হিসাবে দ্বিতীয় স্থানাধিকারীই রইল। তবে হিসাবটা এত সরল নয়। বহু জায়গাতেই বাম ও কংগ্রেস বিজেপির ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে। পঞ্চায়েতের সর্বোচ্চ ও মধ্যবর্তী স্তর জেলা পরিষদ ও পঞ্চায়েত সমিতিতে না হলেও, গ্রাম পঞ্চায়েতের স্তরে তারা জোর লড়াই দিয়েছে বলেই বামেদের দাবি। আসন তেমন না পেলেও এই ‘লড়াই’ ভবিষ্যতে বাম সংগঠনকে আবার চাঙ্গা করবে, বিজেপিতে চলে যাওয়ার ‘ধুম’ কমে দলীয় ‘রক্তক্ষরণ’ বন্ধ হবে, তাঁদের আশা। ভোট শতাংশের পাকা হিসাব পেতে কিছু সময় লাগবে। কিন্তু এই ঘটনার কিছু গুরুত্বপূর্ণ অভিঘাত আছে।

এই ভোটের আগে, বিজেপি, বিশেষত বিধানসভার বিরোধী দলের নেতা চেয়েছিলেন, গত বিধানসভা ভোটের আগে যেমন বিজেপির বিরুদ্ধে ‘নো ভোট টু বিজেপি’ প্রচারের ফলে নানা রাজনৈতিক রঙের, এমনকি অনেক বামমনস্ক মানুষও বিজেপিকে ‘রুখতে’ তৃণমূলকে ভোট দিয়েছিলেন, এ বার তেমনই ‘নো ভোট টু মমতা’ প্রচারকে সামনে রেখে তৃণমূল-বিরোধীরা ‘একের বিরুদ্ধে এক’ প্রার্থী দিক। অর্থাৎ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যাকে ‘রাম-বাম-শ্যাম’ জোট বলেন, নিচুতলায় সেই সমঝোতা হোক। বেশ কিছু জায়গায় তেমনটা হলেও অনেক জায়গাতেই হয়নি।

বিশেষত সাগরদিঘির উপনির্বাচনে বাম-কংগ্রেসের সাফল্য ও কর্নাটক নির্বাচনে বহু দিন পর কংগ্রেসের প্রশ্নাতীত সাফল্যে এই জোট অনেকটাই মানসিক জাড্য কাটিয়ে উঠেছে বলে জোট-নেতাদের দাবি। যদিও মালদহ ও মুর্শিদাবাদের বহু আসনেই জোট কাজ করেনি। করলে, বামেদের মতে, ফলাফল আরও ভাল হত। সম্প্রতি পটনায় বিজেপি-বিরোধী দলগুলির বৈঠকে রাহুল গান্ধী ও সীতারাম ইয়েচুরির সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতির ছবিকে সামনে রেখে বিজেপি অবশ্য কং-বাম ও তৃণমূলের মধ্যে ‘বোঝাপড়া’র অভিযোগ তুলে দাবি করেছিল যে, মমতাবিরোধী ভোটের হকদার তারাই। তা যে নয়, সেই প্রমাণ দিতে এ বার ছিল এই জোটের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। তবুও প্রশ্ন ওঠে, উত্তরবঙ্গের বহু জায়গায় বামপন্থীরা তেমন ভাবে মাঠে না থাকাতেই কি বিজেপি অনেকটা সাফল্য পেল?

গ্রামীণ বাংলায় তৃণমূলের নির্বাচনী আধিপত্য পরোক্ষে এ কথাও বুঝিয়ে দিল যে, নিয়োগ ও অন্যান্য ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ, আন্দোলন ও তা নিয়ে কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলির তদন্তের রেশ গ্রামে পৌঁছলেও, সাধারণ গ্রামবাসী, বিশেষত মহিলারা দিনের শেষে রাজ্য সরকারের নানান জনমুখী প্রকল্পের প্রতিই বোধ হয় আস্থা ব্যক্ত করলেন। তাই, গণনা শেষে তৃণমূলের জয়জয়কারের পাশেবিজেপি আর জোটের আসন দূরবিন দিয়েদেখতে হচ্ছে।

বরং, নানা রঙের নির্দলদের সংখ্যা কিছুটা ভদ্রস্থ। বিরোধীরা ক্ষমতায় এলে কি এ সব প্রকল্প তুলে দেবেন? দীর্ঘ দিনের পরিচিত এক প্রবীণ বামপন্থী নেতার উত্তর, “ওরা সাইকেল দিয়েছে, আমরা স্কুটি দেব!” আর রাজ্য বিজেপি সভাপতি তো ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’-এর অনুদান বাড়িয়ে দু’হাজার টাকা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাই, জনকল্যাণ প্রকল্পগুলির যথাযথ বিতরণ ও মাটির-স্তরে সংগঠনের মাধ্যমে মানুষের সঙ্গে নিয়ত যোগাযোগ রাখা— এই দুইয়ের যোগই এখনও গ্রামে সিদ্ধিলাভের চাবিকাঠি। পশ্চিমাঞ্চলে গত লোকসভায় (২০১৯) সরে যাওয়া জনজাতিদের ভোট যে ভাবে তৃণমূল ‘ফিরিয়ে আনতে’ পারল, তাও লক্ষণীয়। জঙ্গলমহল কি ‘আদিবাসী’ ও জনজাতি-তকমা পেতে আন্দোলনরত ‘কুড়মি’দের দু‘টি শিবিরে ভাগ হয়ে গেল? লোকসভা ভোটের আগে এই ভোট সব রাজনৈতিক দলের পক্ষেই গ্রামীণ ক্ষেত্রে ‘বাস্তব পরিস্থিতি’ বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যৎ রণনীতি ও কৌশল স্থির করারসুযোগ দেবে। গত বার ৩৪% আসনে ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ জয়ী হয়ে তৃণমূল যা করতে অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছিল।

তবে, ভোটের আগে ও পরে, বিরোধী দলের নেতা যে ভাবে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে বুথে নিয়োগ বিষয়ক অসন্তোষ প্রকাশ থেকে রাজ্যে সংবিধানের ৩৫৫/৩৫৬ ধারার প্রয়োগের দাবি জানালেন, যে ভাবে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে ‘ভারত সরকার’ বা ‘দিল্লির নেতাদের’ ‘কড়া পদক্ষেপ’ করার বিষয়ে সন্দেহ ব্যক্ত করলেন, তথা ‘ঝান্ডা ধরে বা ছেড়ে’ তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা করলেন, তাতে কিন্তু রাজনৈতিক মহল অনেক চিন্তাভাবনার খোরাক পেয়ে গেল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement