বিকাশ সিংহ। —ফাইল চিত্র।
আশির দশকের গোড়ার কথা। বিকাশ সিংহ তখন ভেরিয়েবল এনার্জি সাইক্লোট্রন সেন্টার (ভিইসিসি)-র ডিরেক্টর। তখনও তিনি একই ক্যাম্পাসের অন্তর্গত সাহা ইনস্টিটিউট-এর ডিরেক্টর হননি। শহরের এক জন রিপোর্টার গিয়েছেন ওঁর ইন্টারভিউ করতে। কথাবার্তার ফাঁকে বিকাশ জানালেন, ভারতে পরমাণু গবেষণার প্রাচীনত্বের কথা। কথা প্রসঙ্গে উঠে এল পাকিস্তানের কথা। ও দেশে পরমাণু গবেষণা অনেক পরে। ভারতে হোমি জাহাঙ্গির ভাবার হাতে পরমাণু গবেষণা শুরু হওয়ার অনেক পরে। ভারত আর পাকিস্তানের পরমাণু গবেষণার তুলনামূলক আলোচনা করতে গিয়ে হঠাৎ বিকাশ ফস করে বলে বসলেন, গবেষণায় দেরি করে ফেলায় অনেক অসুবিধে। বিদেশ থেকে চুরি করে আনতে হয় গবেষণা।
অবশ্যই বিকাশ আবদুল কাদির খানের কথা বলছিলেন। খান হলেন পাকিস্তানের পরমাণু গবেষণার জনক। কট্টর ভারত-বিদ্বেষী। ভোপাল শহরে জন্মানো এই ভারতীয় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার প্রত্যক্ষদর্শী। সম্ভবত সেই কারণেই তিনি সাম্প্রদায়িক। আমেরিকান সাপ্তাহিকে সেই জন্য সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় বলেছিলেন, হিন্দু আর মুসলিম কোনও দিন এক হবে না। হিন্দুরা গরুকে পুজো করে, আর মুসলমানেরা গরুর মাংস খায়। হিন্দুরা পুব দিককে শুভ বলে মানে, আর মুসলমানরা পশ্চিম মুখে নমাজ পড়ে।
এই কাদির খান হল্যান্ডে ইরেনকো কোম্পানিতে চাকরি করার সময় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্রযুক্তি চুরি করেন। সে কথাই সে দিন সাংবাদিককে বলেছিলেন বিকাশ। বিজ্ঞানী হয়েও রাজনীতিতে বেফাঁস কথা বলার জন্য ভারতের অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন-এর কর্তাব্যক্তিদের কাছে ধমক খেয়েছিলেন তিনি। বিকাশ তখন উদীয়মান বিজ্ঞানী।
এই হচ্ছে বিকাশ। ঠোঁট-কাটা, ভারতে বিজ্ঞান গবেষণার একনিষ্ঠ সমর্থক। ওঁর প্রত্যক্ষ মদতেই সুইৎজ়ারল্যান্ডের জেনিভা শহরের কাছে কণা পদার্থবিজ্ঞানের যে পেল্লায় গবেষণাগার আছে (সার্ন), সেখানকার বিজ্ঞানী দলের সঙ্গে জুড়েছেন কলকাতার বিজ্ঞানীরা।
ভারতে পরমাণু বিদ্যুতের বড় সমর্থক ছিলেন বিকাশ। সেই জন্য হরিপুরে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা বানচাল হলে তিনি দুঃখ পেয়েছিলেন। নানা অছিলায় প্রায়ই বলতেন যে, পরমাণু বিদ্যুৎ মানে পরমাণু বোমা নয়। ওই দুটোতে অনেক তফাত। মুশকিল হল, অনেকে ও দুটোকে এক করে ফেলেন।
মুর্শিদাবাদে কান্দি শহরে বিখ্যাত সিংহ পরিবারে জন্ম ওঁর। নিজের বাড়িতে বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সংস্পর্শে এসেছিলেন। বিজ্ঞান পড়ার আগ্রহটা তাঁর থেকেই। ফিজ়িক্সের স্নাতক প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে। কেমব্রিজে গিয়ে পড়াশোনা করেন। শ্যামল সেনগুপ্ত, অমল কুমার রায়চৌধুরী, সমর ঘোষালের এই ছাত্র কেমব্রিজের বিখ্যাত কিংস কলেজে গিয়ে ভর্তি হন। কিন্তু বাবার মৃত্যুর কারণে পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখেই ওঁকে ফিরতে হয় দেশে। ফিরে গিয়ে পড়ায় মনোনিবেশ করা কঠিন জেনেও তিনি কৃতকার্য হন।
দ্বিতীয় বার দেশে ফিরে তিনি দেখা করেন ভারতীয় বিজ্ঞানী রাজা রামান্নার সঙ্গে। রামান্নাও কিংস কলেজের ছাত্র। তা ছাড়া, তিনি তখন বম্বের ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টার (বিএআরসি)-র ডিরেক্টরও বটে। বিকাশ বিএআরসি-তে যোগ দেন। সেখান থেকে কলকাতায় সাইক্লোট্রনে। প্রথমে রিসার্চ গ্রুপের প্রধান হিসাবে। পরে ডিরেক্টর।
বিগ ব্যাং বা এক মহাবিস্ফোরণে ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির পর থেকেই যখন তৈরি হয়েছে কোয়ার্ক কণা, সে সময়টার খবর সংগ্রহের চেষ্টা করেছেন বিকাশ। এ কাজে তাঁর সহযোগী ছিলেন ভিইসিসি-তে তাঁর উত্তরসূরি দীনেশ শ্রীবাস্তব। এ ব্যাপারে তাঁর পেপার ছাপা হয়েছে ফিজ়িক্স লেটারস বি পত্রিকায়।
সত্যেন্দ্রনাথের ছাত্র শ্যামাদাসের সাধের প্রকল্প বক্রেশ্বরের উষ্ণ প্রস্রবণ বিকাশ দেখিয়েছেন অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন-এর নানা কর্তাব্যক্তিকে। বক্রেশ্বরের গরম জলে, যেখানে স্নান করে দর্শনার্থীরা আরাম পান, তা নিয়ে গবেষণার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে ওঁর ভাল লাগত না।
ভিইসিসি থেকে অবসর গ্রহণের পরে বিকাশ ছিলেন হোমি ভাবা ফেলো। এ কাজে সেমিনারে বক্তৃতা, বিভিন্ন কাগজে লেখা ছিল ওঁর কাজ। সেই সব লেখার সংগৃহীত রূপ ওঁর দুই বই। সৃষ্টি এবং কৃষ্টি: বন্ধনহীন গ্রন্থি এবং স্থান, কাল ও বিশ্বলোক।