Shyamal Sengupta

শিক্ষকতা, আর সঙ্গে সন্ধিৎসা

নরম কেন? সকলেই জানে, বিদ্যাসাগরের শেষ জীবনটা সুখের হয়নি। আত্মীয়-পরিজন বিপক্ষে গিয়েছিল। কর্মাটাঁরে এক রকম নির্বাসিতের জীবন যাপন করছিলেন তিনি।

Advertisement

পথিক গুহ

শেষ আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০২৪ ০৮:৪৩
Share:

—ফাইল চিত্র।

তখন কল্যাণীতে প্রেসিডেন্সি কলেজের মাস্টারমশাই শ্যামল সেনগুপ্তের পাশের বাড়িতে ছিলেন দিলীপ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর শ্যামল সম্পর্কে মন্তব্য: বিদ্যাসাগর মশাইকে আমি চোখে দেখিনি। ওঁর সম্পর্কে যেটুকু পড়েছি, তাতে আমার এটুকু মনে হয়েছে যে, আমি যেন বিদ্যাসাগর দেখেছি। নরম বিদ্যাসাগর।

Advertisement

নরম কেন? সকলেই জানে, বিদ্যাসাগরের শেষ জীবনটা সুখের হয়নি। আত্মীয়-পরিজন বিপক্ষে গিয়েছিল। কর্মাটাঁরে এক রকম নির্বাসিতের জীবন যাপন করছিলেন তিনি। ঋজু, মাথা নোয়াননি কারও কাছে। শ্যামল সেনগুপ্ত অতটা একরোখা না হলেও, স্পষ্ট বক্তা ছিলেন। এ জন্য ধর্মবিশ্বাস এবং বিজ্ঞান গবেষণার মধ্যে— যে দুই আইডিয়ার মধ্যে দ্বন্দ্ব খুঁজে পান সকলে— মিল দেখেছিলেন। অথচ, গান্ধীজি যখন ১৯৩৪ সালে ভারতে ভূমিকম্পের কারণে অনেক লোক মারা যাওয়ার উৎসসন্ধানে মন্তব্য করেন যে, “এই ভূমিকম্প আমাদের সমাজে (অস্পৃশ্যতার) পাপের জন্য ঈশ্বর-প্রেরিত শাস্তি,” তখন শ্যামল গান্ধীজির নিন্দা করেন।

রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী সম্পর্কে বক্তব্য: “তিনি যদি অদ্বৈত দর্শনের প্রতি শ্রদ্ধাবান হয়েও, জড়জগৎ সম্বন্ধে ঐ দর্শনের বক্তব্য উপেক্ষা করতে পারতেন, তবে হয়ত আজ আমরা জগদীশচন্দ্র-প্রফুল্লচন্দ্রের সঙ্গে আর এক জন বিজ্ঞান মনীষীর নাম উচ্চারণ করতে পারতাম।... যে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে প্রত্যেক প্রতিভা পরিপূর্ণ ভাবে প্রস্ফুটিত হয়ে দেশের সংস্কৃতি সমৃদ্ধ করতে না পারে, ধরে নিতেই হবে সেই সাংস্কৃতিক আবহাওয়ায় কিছু ত্রুটি আছে।”

Advertisement

শিক্ষাদানের ব্যাপারে ‘হতাশা’ আরও আছে। বাঙালি সমাজে সংবাদমাধ্যমে মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকে ফার্স্ট-সেকেন্ড হওয়া ছাত্রছাত্রীদের সাক্ষাৎকার প্রকাশের একটা চল আছে। কিন্তু সে সব সাক্ষাৎকারে কী ধরনের প্রশ্ন করা হয়? “এমন সব প্রশ্ন করা হয় যার উত্তরে ছাত্রদের নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা প্রকাশের কোনও সুযোগই থাকে না। তুমি প্রতি দিন কত ঘণ্টা পড়েছ, কত জন গৃহশিক্ষক ছিল, একটি বিষয়ে ক’টি পাঠ্যপুস্তক পড়তে, অন্য কী কী হবি আছে, পরবর্তী কালে তুমি কী হতে চাও ইত্যাদি সব প্রশ্ন। এই সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য কৃতী ছাত্র হওয়ার প্রয়োজন হয় না। এই সাক্ষাৎকার কি আরও সার্থক ভাবে পরিচালনা করা যায় না?”

জন্ম ২১ জুলাই ১৯২৪, বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার রাজবাড়িতে। জন্মশতবর্ষ চলছে এখন। শিক্ষা কলকাতার মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনে। তার পর প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। অধ্যাপনা করেছেন কৃষ্ণনগর গভর্নমেন্ট কলেজ, দার্জিলিং গভর্নমেন্ট কলেজ, হুগলি মহসীন কলেজ, মৌলানা আজাদ কলেজ, প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রেসিডেন্সিতে আইএসসি-তে পড়ার সময় বিয়াল্লিশের আন্দোলনে জেলবাস। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে বাবা মারা গিয়েছিলেন। মা ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। জেলে গিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্সি থেকে অবসর গ্রহণের পর মা-র নামে ‘চারুপ্রভা দেবী শিক্ষা সংসদ’ প্রতিষ্ঠা করে সমাজসেবামূলক কাজে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন।

পিএইচ ডি নিউক্লিয়ার ফিজ়িক্সে। গবেষণার বিষয় সলিড স্টেট ফিজ়িক্স ও কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মৌলিক দিক নিয়ে। ১৯৭৪ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে সলিড স্টেট রিসার্চ সেন্টার স্থাপন করেন। ১৯৯০ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং তাঁর প্রাক্তন ছাত্র অশোকনাথ বসুর উদ্যোগে ওই গবেষণাকেন্দ্র যাদবপুরে স্থানান্তরিত হয়। ১৯৯৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘টিচার অব এমিনেন্স’ সম্মান প্রদান করে।

যে কোনও শিক্ষকই বেঁচে থাকেন তাঁর ছাত্রছাত্রীর মাধ্যমে। অনুপ্রেরণা দিয়ে যাঁরা তাঁর কাজ এগিয়ে নিয়ে যান। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যানের মাস্টারমশাই জন আর্চিবল্ড হুইলার-এর মন্তব্য। তিনি বলতেন, মাস্টারমশাই হওয়ার একটা সুবিধে হচ্ছে এটা বুঝতে পারা যে, আমি কত কম জানি। দেশেবিদেশে ছড়িয়ে আছে শ্যামল সেনগুপ্তের ছাত্রছাত্রীরা। চারুপ্রভা দেবী শিক্ষা সংসদের উদ্যোগে শ্যামল সেনগুপ্তের এই জন্মশতবর্ষে দুটো অনুষ্ঠান হয়ে গেল। একটি রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে, অন্যটি প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে। দু’টি অনুষ্ঠানেই হাজির ছিলেন শ্যামল সেনগুপ্তের ছাত্রছাত্রী ও শুভানুধ্যায়ীরা। এসেছিলেন মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ-এর বিজ্ঞানী শ্রীরূপ রায়চৌধুরী এবং গৌতম মণ্ডল। চারুপ্রভা দেবী শিক্ষা সংসদের উদ্যোগে দুই অনুষ্ঠানের প্রাক্কালে প্রকাশিত হয় ‘শ্রদ্ধাঞ্জলি’। ছাত্রছাত্রীরা লেখেন মাস্টারমশাইয়ের সম্পর্কে। প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা। এক জন ছাত্র বসু বিজ্ঞান মন্দিরের বিজ্ঞানী দীপঙ্কর হোম। লিখেছেন, “এসএসজি (ওই নামেই দীপঙ্কর ডাকেন শ্যামল সেনগুপ্তকে) সব সময় উৎসাহ দিতেন কোয়ান্টামের মৌলিক বিষয়ে কাজ করতে।”

এমন এক মানুষ আত্মহত্যা করলেন ২১ অক্টোবর, ২০০৩-এ। লিখেছেন দীর্ঘ দিনের সহকর্মী প্রয়াত অধ্যাপক অমলকুমার রায়চৌধুরী (যাঁর নামে ‘রায়চৌধুরী ইকোয়েশন’), “ভেবেছিলাম শ্যামলবাবুকে জেনেছি, তাঁর মনের গভীরে প্রবেশ করতে পেরেছি, কিন্তু তিনি যে ভাবে নিজের জীবনের যতি টেনে দিলেন, তাতে আজ মনে হয়, তাঁর মনের অনেকটাই অজানা ছিল। তিনি আমার সীমিত বুদ্ধির অতীত এক জগতের মানুষ।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement