—ফাইল চিত্র।
কোনও খ্যাতির জন্য শংসাপত্র অর্জন অতি পরিচিত বিষয়। ফলে, নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর যোগাযোগে কারও শংসাপত্র প্রাপ্তি নিশ্চয় অভিনন্দনযোগ্য বিষয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বিধি বাম, সে জন্য কিছু কথার অবতারণা।
সম্প্রতি এক জন বঙ্গ গায়িকা তাঁর গানের জন্য দেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা পেয়ে বিতর্কের মধ্যে জড়িয়ে গেলেন। গত কয়েক সপ্তাহ জুড়ে অযোধ্যায় রামমন্দির পুনঃপ্রতিষ্ঠা উপলক্ষে চলেছে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সারা দেশের বিভিন্ন শিল্পীর কর্মের উপস্থাপনায় এই ভারতীয় মহোৎসব প্রোজ্জ্বল হয়েছে। ২০ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী মোদী তাঁর ‘এক্স’ হ্যান্ডল-এ লিখেছেন: পশ্চিমবঙ্গের মানুষের প্রভু শ্রীরামের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা রয়েছে, এই রইল প্রসিদ্ধ নজরুল গীতি “মন জপ রাম”। সঙ্গে গায়িকার ছবি-সহ গানটির একটি সিডির ছবি ও তার ইউটিউব সংযোগের ঠিকানা।
আশা করা গিয়েছিল যে এতে বাংলার নজরুল-প্রেমীরা উচ্ছ্বসিত হবেন। রামমন্দির পুনঃপ্রতিষ্ঠার মতো এমন দেশবিদেশে সাড়া জাগানো অনুষ্ঠানের আবহে দেশের প্রধানমন্ত্রী বাংলার নজরুল ইসলামের গানকে দেশের কোটি কোটি মানুষের সামনে তুলে ধরলেন, তুলে ধরলেন বাংলার এক নজরুলগীতি গায়িকাকে— এর ফলে নজরুল আকাদেমি ধন্যবাদ জানাবেন প্রধানমন্ত্রীকে, সংবর্ধিত করবেন গায়িকাকে। কিন্তু ঘটল উল্টোটাই। আকাদেমির প্রধান জানালেন, এটি একটি রাজনৈতিক চাল এবং ঘৃণ্য কাজ। পরিচিত বুদ্ধিজীবীরা প্রায় সবাই চুপ। রাজনীতির লোকেরা বললেন নজরুল নিয়ে সাম্প্রদায়িক মোদীর কিছু বলবার অধিকার নেই। লক্ষণীয়, বাংলার মানুষের শ্রীরামের প্রতি যে অপরিসীম শ্রদ্ধা রয়েছে, সে-কথার বিরোধিতা কেউ করেননি। সমস্যা একটি বিতর্কিত শংসাপত্র নিয়ে, ফলে এক জন কৃতী বাংলা গায়িকা এখানে সম্মানিত হলেন না।
সত্যিই কি নরেন্দ্র মোদীর নজরুল ইসলামের কথা বলার অধিকার রয়েছে? কিংবা বিজেপির বা হিন্দুত্ববাদীদের? এ সবের কয়েক দিন আগে কলকাতা ময়দানে লক্ষ কণ্ঠে গীতাপাঠের শুরু হয়েছিল নজরুল ইসলামের গান দিয়ে: হে পার্থসারথি! বাজাও বাজাও পাঞ্চজন্য শঙ্খ, চিত্তের অবসাদ দূর কর, কর দূর, ভয়-ভীত জনে কর হে নিঃশঙ্ক। এই নজরুলই লিখেছেন: তওফিক দাও খোদা মুসলিম-জাহাঁ পুনঃ হক আবাদ।/ দাও সেই হারানো সুলতানত, দাও সেই বাহু, সেই দিল আজাদ। সেই নজরুলের হিন্দুত্ববাদীদের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন? ১৯৪২ সাল, ঋণগ্রস্ত নজরুল ইসলাম, অসুস্থ নজরুল ইসলাম, তাঁর অসুস্থ স্ত্রী শয্যাশায়ী। সাহায্যের হাত বাড়ালেন না কেউ, এগিয়ে এলেন হিন্দু মহাসভার কার্যনির্বাহী সভাপতি। নজরুলকে শুশ্রূষার জন্য নিয়ে তুললেন তাঁর মধুপুরের (ঝাড়খণ্ড) বাড়িতে, ঋণমুক্ত করলেন। নজরুল তাঁকে মধুপুর থেকে চিঠি লিখছেন, “শ্রীচরণেষু, আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম গ্রহণ করুন। মধুপুরে এসে অনেক relief & relaxation অনুভব করছি। মাথার যন্ত্রণা অনেকটা কমেছে। জিহ্বার জড়ত্ব সামান্য কমেছে। আপনি এত সত্বর আমার ব্যবস্থা না করলে হয়ত কবি মধুসূদনের মত হাসপাতালে আমার মৃত্যু হত। আমার স্ত্রী আজ পাঁচ বৎসর পঙ্গু হয়ে শয্যাগত হয়ে পড়ে আছে। তাকে অনেক কষ্টে এখানে এনেছি।... আপনার মহত্ত্ব, আপনার আমার উপর ভালবাসা, আপনার নির্ভীকতা শৌর্য সাহস আমার অণুপরমাণুতে অন্তরে, দেহতে মিশে রইল। আমার আনন্দিত প্রণাম, পদ্ম শ্রীচরণে গ্রহণ করুন। প্রণত নজরুল ইসলাম”।
এর দশ বছর পর, ১৯৫২ সালে, চিকিৎসার জন্য নজরুল ইসলামকে পাঠানো হল ইউরোপে। এই প্রচেষ্টার প্রধান উদ্যোগী ছিলেন উপরোক্ত ব্যক্তিই। তিনি তখন জনসঙ্ঘ দলের কর্ণধার। নজরুল অবশ্য তখন একেবারেই অসুস্থ, অপ্রকৃতিস্থ। চিঠি লেখা আর সম্ভব ছিল না। ব্রাহ্মণ বিদ্যাসাগরের খ্রিস্টান মধুসূদনকে অর্থসঙ্কট থেকে বার বার রক্ষার কাহিনি সুবিদিত, কিন্তু আর এক মানুষের মৃত্যুপথযাত্রী নজরুল ইসলামকে রক্ষার কাহিনি বাংলায় খুব কম লোকই জানেন এবং বলেন। এই মানুষটি হলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।
শ্যামাপ্রসাদ ছিলেন জনসঙ্ঘ দলটির প্রতিষ্ঠাতা, যে জনসঙ্ঘ ১৯৮০ সালে পরিবর্তিত হয়ে ভারতীয় জনতা পার্টি, বিজেপি। বিজেপির সব প্রতীকেই থাকে শ্যামাপ্রসাদের ছবি। সুতরাং আজকের বিজেপির কর্ণধার নজরুল ইসলামের গান, নজরুলের রামভক্তি স্মরণ করতেই পারেন! তিনি প্রশংসা করতেই পারেন বাংলার নজরুলগীতি গায়িকার!
এই সুকণ্ঠী গায়িকা এক জন অধ্যাপিকা, নিজগুণে গানের জগতে, বিশেষত নজরুলগীতির দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত। উনি কোনও দলে নাম লেখাননি, দল পরিবর্তন করেননি, কোনও আকাদেমির শংসাপত্রের জন্য আবেদন করেননি বা কোনও দলের মন্ত্রীর চেয়ার নিজের রুমাল দিয়ে পরিষ্কার করেননি। সুতরাং রাজ্যের শংসাপত্র বিতরণের একমাত্র অধিকারীরা চিন্তিত, তাঁরা বহিরাগত শংসাপত্র স্বীকার করতে পারেন না। এর স্বীকার মানে কি নজরুলের রামভজনের মধ্যে যে ভারতীয় সংস্কৃতি, তাতে স্নান করে নিজেদের শুদ্ধ করা নয়?