প্রতীক্ষা: গান্ধীমূর্তির পাদদেশে চাকরিপ্রার্থীদের অবস্থান বিক্ষোভের সহস্রতম দিন। ৯ ডিসেম্বর, ২০২৩। রণজিৎ নন্দী।
শহর এবং শহরতলির কম-বেশি সব বাংলা মাধ্যম ইস্কুল ধুঁকছে। এক সময় যেখানে সন্তানকে ভর্তি করানোর জন্য রাত জেগে লাইন দিতেন বাবা-মায়েরা, সেই সব ইস্কুলের উঁচু ক্লাসেও এখন পারতপক্ষে ফেল করানো হয় না কাউকে, পাছে সে অন্য ইস্কুলে চলে যায়। পঠনপাঠনের মাধ্যম নিঃশব্দে বাংলা থেকে ইংরেজি হয়ে যাচ্ছে বেশ কিছু ইস্কুলে, ইংরেজিতে সব বিষয়ে পাঠদানের যোগ্য শিক্ষক-শিক্ষিকা থাকুন বা না থাকুন। কারণ, অর্থনৈতিক শ্রেণি-নির্বিশেষে প্রত্যেকেই নিজের সন্তানকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াতে চাইছেন। বেদনার বালুচরে একমাত্র সুখের প্রদীপ হয়ে জ্বলছে সন্তানের স্কুলব্যাগের ভিতরকার ইংরেজি বইগুলি।
বিরাট বড় যে হাইরাইজ়গুলো উঠেছে এবং উঠছে, তার কোনও একটাতেও ভ্যান নিয়ে স্বাধীন আনাজ বিক্রেতাদের প্রবেশাধিকার নেই। রাত্রি দশটায় শহরের অনেক রাস্তা একদম শুনশান, একা ভয় করে; কিন্তু ফ্ল্যাটবাড়ির গেটে, বাসন মাজতে কিংবা কাপড় কাচতে ঢোকা মানুষীদের নিরন্তর তল্লাশি চলছেই। একেই ‘সিকিয়োরিটি’ বলে। আর ওই নিরাপত্তার তাগিদেই হয়তো দরিদ্র বাপ-মা ভাবেন, ইংরেজি শিখলে সন্তান একটা হোটেল বা হাসপাতালে চাকরি জুটিয়ে ফেলবে ঠিক।
বেশির ভাগ ছাত্রই দরিদ্র পরিবার থেকে আসে, এমন একটি ইস্কুলের মাস্টারমশাই একটু অন্য ব্যাখ্যা দিলেন এই প্রবণতার। তাঁর এক ছাত্র, দশ বছর আগে, ক্লাসরুমে অপমানিত হয়ে বলেছিল, “আমার মা অন্যের বাড়িতে ঘর মোছে, এটা কেবল আমারই অপমান নয়। যে আমায় ব্যঙ্গ করছে, তারও অপমান।” সেই মাস্টারমশাইয়েরই এক বর্তমান ছাত্র, পরীক্ষার রচনায় লিখেছে “আমি বড় হয়ে, ‘অ্যানিম্যাল’ হব। তখন সবাইকে শিক্ষা দিয়ে দেব।” মাস্টারমশাই অসহায়ের মতো ভেবেছেন, কেন ছাত্রটির মনে হল যে, সবাইকে শিক্ষা দিতে গেলে ‘অ্যানিম্যাল’ হতে হবে? উত্তরের খোঁজে, (সিনেমাহলে না গেলেও) মনে মনে আসমান-জমিন ঘুরে এসে মাস্টারমশাইয়ের উপলব্ধি হয়েছে যে, আগে মানুষ— অবস্থানির্বিশেষে— নিজের দুঃখে অন্য কাউকে পাশে পেত। শোনার লোক ছিল, কাঁদার কাঁধ ছিল। কিন্তু এখন ‘সকলে প্রত্যেকে একা’। তাই মানুষ, নিজের সুখ কিংবা দুঃখ অনেকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ হতে চাইছে। নিজেকে প্রকাশ করার জন্যও পুঁজি চাই এখন, চায়ের দোকান কিংবা চণ্ডীমণ্ডপের আড্ডার পরিসর আর কোনও মঞ্চ দেয় না। মঞ্চটা পাওয়ার জন্যই হয়তো ওই কিশোরের ও রকম চাওয়া— কারণ এখন খারাপ হতে গেলেও এমন ভাবে ও ভাষায় হতে হবে, বিশ্ব জুড়ে যার দাম আছে।
দাম তো সবেরই রয়েছে। চাকরির, প্রোমোশনের, বদলির, পারমিটের। কিন্তু সেই দাম একেবারে আজ রয়েছে, তা তো নয়। বহু দিন ধরেই তা চালু। জ্যোতি বসু ১৯৫৮ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় দেওয়া একটি ভাষণে বলছেন, “আমাদের মন্ত্রিমণ্ডলী… তাঁরা তাঁদের নিজেদের আত্মাকে সম্পূর্ণ ভাবে বিক্রি করেছেন… সোনা পাওয়া গেল, হীরা পাওয়া গেল বিভিন্ন জায়গায়… কিন্তু তার কী ফল হল?… একটা ইনকাম ট্যাক্স ফাঁকির ব্যাপার নিয়ে যখন ইনকাম ট্যাক্স ইনভেস্টিগেটিং কমিশন মোটা ট্যাক্সের জন্য দাবি করেন, তখন সেখানে বিধানবাবু বললেন— ‘আমি একটা এগ্রিকালচারাল কলেজ খুলব, আমাকে টাকা তুলে দিতে হবে।’… ফাঁকি দেওয়া ট্যাক্সের বেশির ভাগ পশ্চিমবাংলার— সেটা যদি ধরতে পারতেন, তা হলে প্রয়োজন হত না ভিক্ষে চাইবার এই এগ্রিকালচারাল কলেজের জন্য।… তার পর… বিধানবাবুর ভাইপো, চিত্ত রায় ডেপুটি মিনিস্টার… ওঁরা এখানে নাকি ব্যবসা ফেঁদে বসেছেন এবং প্রিন্সেপ স্ট্রীটে এর অফিস… সেটা বিধানবাবুর ছিল। নানা লোকে সন্দেহ করছে যে, তিনি নাকি বেনামিতে ব্যবসা চালাচ্ছেন… আমার তো সব দেখে মনে হয়… মুখ্যমন্ত্রী মহাশয়… বাংলার বড় বড় কোটিপতি ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধি আর পশ্চিমবাংলা তার ঘাঁটি।”
জ্যোতিবাবুর ওই ভাষণে বিধানবাবুকে চাল চুরি, মাছ-ব্যবসার ভাগ নিয়ে বেআইনি পথে হাঁটা, এবং ট্যাক্সি পারমিট দেওয়া নিয়ে দুর্নীতি করার অভিযোগেও বিদ্ধ করা হয়েছে। তবে ডাক্তার রায়কে ‘ভাইপো’র কথা তুলে আক্রমণ করা হচ্ছে দেখে যে পাঠকরা কিঞ্চিৎ চমকে যাবেন, তাঁরা মনে রাখলে ভাল যে, এই বক্তৃতা করার ত্রিশ বছরের মধ্যেই জ্যোতি বসুকে তাঁর ভাগ্নে এবং পুত্রের দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন বিরোধীরা।
তবু তার পরও ওই ১৯৫৮ কিংবা ১৯৮৮ সালের সঙ্গে গুণগত একটা ফারাক রয়েছে আজকের সময়ের। গৌতম হালদারের নির্দেশনায় রক্তকরবী দেখার সময় সেই ফারাকটা ঝলসে ওঠে যেন। বিরোধীরা শাসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন, অভিযোগ করবেন। তা সত্য হতে পারে, মিথ্যাও হতে পারে। কিন্তু সেই অভিযোগ এক কিংবা কতিপয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে। বা বলা যায়, সেই অভিযোগ মূলত রাজার বিরুদ্ধেই। কিন্তু আজ?
আনাজ বিক্রেতার চটের তলা কিংবা গৃহসহায়িকার আঁচলের খুঁট থেকে দশ-বিশ টাকা প্রত্যহ হাতিয়ে নিয়ে টাকার পাহাড় বানানো চিট ফান্ডকে আমরা দোষী সাব্যস্ত করতে পারি; কিন্তু জেনেশুনে সেই টাকাতেই তৈরি সিনেমার নির্দেশক বা অভিনেতাদের কী বলব? ওএমআর শিটে পরিবর্তন জালিয়াতরা করলে তাদের শাস্তি চাইতে পারি, কিন্তু যখন সেই একই কাজ কোনও অধ্যক্ষ বা উপাচার্য করেন? মুদি দোকানে চোর ধরা পড়লে মার খায়। কিন্তু যখন মিড-ডে মিলের চাল চুরির সঙ্গে জড়িয়ে যান কোনও শিক্ষক বা প্রধান শিক্ষকও? ক্লাসে বসে নকল করছে যে ছাত্র, তাকে তুলে দিতে পারি পুলিশের হাতে। কিন্তু যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রশ্ন ফাঁস করে দেন, বা ইন্টারভিউ বোর্ডে বসে টাকা চান? সর্দাররা রাজাকে সামনে রেখেই দুর্বিষহ অত্যাচার চালিয়ে যেতে পারে, কারণ অত্যাচারের কৌশল তাদের করায়ত্ত। রাজা পাল্টালেই অত্যাচার থেমে যাবে আমরা আশা করি, আশা করে যাই— সর্দাররা তত ক্ষণে নতুন রাজার প্রশাসন দখল করে ফেলে।
হোসে সারামাগোর দ্য ডাবল উপন্যাসে ইতিহাসের এক শিক্ষক এক দিন একটি চলচ্চিত্রে এমন এক জনকে দেখেন, যাঁর চেহারা হুবহু ওই শিক্ষকের পাঁচ বছর আগেকার চেহারার মতো। তিনি তখন তাঁর দ্বৈতকে খুঁজতে শুরু করেন, আর খুঁজতে খুঁজতে একটা প্রশ্নের কাছে এসে পৌঁছন। প্রশ্নটি এই যে, আমরা কি কেবল আমাদের বহিরঙ্গই? সেই প্রশ্নের উত্তর পেতে আয়নার সামনে দাঁড়ালে আজ যদি নিজের নিজের প্রতিবিম্বেই হঠাৎ এক ঝলক তাকে দেখে ফেলে মানুষ? মানে, ‘অ্যানিম্যাল’কে?
অতীত টপকে বর্তমানে আসা যায় না, অতীতকে সঙ্গে নিয়েই আসতে হয়। যে ডালে বসে আছি সেই ডাল কাটার বিরুদ্ধে লড়াইটা যে করা হয়নি, টের পাওয়া যায় তখনই। কিন্তু তখন আর কিছু করার থাকে কি? বন্দুকের নলের বদলে কালো টাকা যদি ক্ষমতার উৎস হয়, কোথায় কী বদলাবে? সেই টাকা থেকেও বন্দুক কেনা হবে তো!
সেই বন্দুকের গুলিতে কি মানুষ মরবে, না পশু? না কি দু’জনই এক সঙ্গে? একটা পরীক্ষায় যাঁরা বসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে তুলনায় কম মেধাবীরা ঘরে থাকতে পারেন তবু; বেশি মেধা যাঁদের, তাঁরা রাস্তায় এক হাজার এক রাত্রি পার করে দিলেন! এ কি প্যারাডক্স নয়? না কি, যা স্বাভাবিক তা-ই প্যারাডক্স এখন? আচ্ছা, ওই রাস্তায় যারা বসে আছে আর রাস্তায় যারা নেই, তারা প্রত্যেকেই কি এক জন করে গফুর? আর সবার স্বপ্নের নামই মহেশ? এই ‘অ্যানিম্যাল ওয়ার্ল্ড’-এ, এই মাইলের পর মাইল ছড়িয়ে থাকা ফুলবেড়ের চটকলে, যার বেঁচে থাকার কোনও রাস্তা নেই?