এই নির্বাচনের মরসুমে কর্মসংস্থান, দুর্নীতি ও আগের নির্বাচনগুলিতে সন্ত্রাস, এই তিনটি বিষয় ছাড়া তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনকালে পশ্চিমবঙ্গ কেমন ভাবে চলল, সে বিষয়ে কার্যত কোনও আলোচনাই হল না।
এই তিনটি বিষয়ের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কিন্তু, এই লেখায় আমি প্রশাসনের অন্য কয়েকটি কম আলোচিত দিক নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই— গত দশ বছরে সেই ক্ষেত্রগুলিতে তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের সাফল্য বা ব্যর্থতা কতখানি, এবং পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকারের সঙ্গে তুলনা করলেই বা ছবিটা কেমন দাঁড়ায়, দেখতে চাই।
রাজ্যের গ্রস ডমেস্টিক প্রডাক্ট বা জিডিপি-র নিরিখে বর্তমান সরকার তার পূর্বসূরির তুলনায় কেমন করল? দুই জমানার আর্থিক বৃদ্ধির হারের মধ্যে সরাসরি তুলনা করা মুশকিল— কারণ, জিডিপি-র হিসাব কষার জন্য যে বেস ইয়ার ব্যবহার করা হয়, ২০১১-১২ সালে তা পরিবর্তিত হয়েছে। হিসাবের নিয়মকানুনও পাল্টেছে। রাজ্য স্তরের পরিসংখ্যানের জন্য ব্যাক সিরিজ়-ও নেই। এই সমস্যাকে পাশ কাটানোর জন্য আমরা দেখব, ভারতের জিডিপি-র অনুপাতে পশ্চিমবঙ্গের জিডিপি কী ভাবে এগিয়েছে। এই প্রসঙ্গে আরও একটা কথা বলে রাখা প্রয়োজন— তৃণমূল আমলে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী বিভিন্ন সময়ে জিডিপি-র যে প্রাথমিক হিসাব পেশ করেছেন, বহু ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে যে, সেটা প্রকৃত সংখ্যার তুলনায় ঢের বেশি। পরবর্তী দু’তিন বছরে সেই প্রাথমিক হিসাব থেকে অনেক কাটছাঁট হয়েছে। এই কারণে পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানকে বিশ্বাস করা কঠিন। এই লেখায় তাই গত দু’বছরের জিডিপি পরিসংখ্যান ধরা হয়নি।
রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার ওয়েবসাইটে থাকা পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, ২০১১-১২ থেকে ২০১৮-১৯ অবধি টানা সাত বছর ভারতের মোট জিডিপি-তে পশ্চিমবঙ্গের অনুপাত কমেছে। ২০১১-১২ সালের মূল্যস্তর ধরে হিসাব করলে সেই বছর দেশের জিডিপি-তে পশ্চিমবঙ্গের অনুপাত ছিল ছয় শতাংশ। সেই একই মূল্যস্তরে ২০১৮-১৯ সালে অনুপাতটি দাঁড়িয়েছে ৫.৩ শতাংশে। অর্থাৎ, যত দূর অবধি নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে, তাতে স্পষ্ট যে, তৃণমূল কংগ্রেসের আমলে পশ্চিমবঙ্গ গোটা দেশের তুলনায় আর্থিক ভাবে খারাপ করেছে।
রাজ্যের জিডিপি তুলনায় কম হলেও কোনও সরকার নাগরিক পরিষেবা প্রদানের কাজে, বা কল্যাণমূলক কর্মসূচিতে ভাল করতে পারে। তবে, এই কাজগুলো করতেও টাকার প্রয়োজন। বামফ্রন্ট আমলের তুলনায় তৃণমূল কংগ্রেসের আমলে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ কেমন ফল করল?
রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া রাজ্যের নিজস্ব কর ও কর-বহির্ভূত রাজস্ব আদায়ের পরিসংখ্যান ব্যবহার করে ২০০৪-০৫ থেকে ২০১০-১১ অবধি ছ’বছর, এবং তার পরবর্তী ছ’বছরের নিজস্ব রাজস্ব আদায়ের হারের তুলনা করে দেখা যাচ্ছে, বৃদ্ধির হার কার্যত অপরিবর্তিত রয়েছে— প্রথম ছ’বছরে রাজস্ব বেড়েছিল বছরে গড়ে ১৮ শতাংশের কাছাকাছি, এবং তার পরের ছ’বছরে বেড়েছিল বছরে গড়ে ১৭ শতাংশ। কিন্তু, তার পরের তিন বছরে রাজস্ব বৃদ্ধির হার হঠাৎ করেই কমে গিয়ে দাঁড়াল বছরে গড়ে ১১ শতাংশে। ২০১৯-২০ সাল অবধি তৃণমূল শাসনের প্রথম ন’বছরের গোটা পরিসংখ্যান দেখলে স্পষ্ট হচ্ছে যে, বাম জমানার শেষ কয়েক বছরের তুলনায় এই জমানায় নিজস্ব রাজস্ব আদায় বেড়েছে অনেক কম গতিতে। সরকারি দাবি অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ থেকে ২০১৯-২০ অবধি পাঁচ বছরে পশ্চিমবঙ্গে টাকার অঙ্কে জিডিপি বৃদ্ধি পেয়েছিল ৭৫ শতাংশ। কিন্তু রাজ্যের নিজস্ব কর ও কর-বহির্ভূত মোট রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বেড়েছে ৫৬ শতাংশ। মদ থেকে, অর্থাৎ আবগারি শুল্ক বাবদ প্রাপ্ত রাজস্বের বৃদ্ধি বাদ দিলে রাজস্ব বৃদ্ধির পরিমাণ আরও কম দেখাবে— মাত্র ৪১ শতাংশ।
আয়ের হিসাব ছেড়ে যদি মানবোন্নয়নের কিছু প্রাথমিক সূচকের দিকে তাকাই, সেখানেও ছবিটা উজ্জ্বল নয়। ২০০২-২০১০ অবধি পশ্চিমবঙ্গে শিশুমৃত্যুর হার কমেছিল ৩৭ শতাংশ; ২০১০ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে সেই হার দাঁড়িয়েছে ২৯ শতাংশে। ২০০৫-২০১১’র মধ্যে প্রসূতি মৃত্যুর হার কমেছিল ১৭ শতাংশ; ২০১১-২০১৭’র মধ্যে তা কমেছে ১৬ শতাংশ। কোনও শিশুর জন্মের সময় তার প্রত্যাশিত গড় আয়ুর বৃদ্ধির পরিসংখ্যানও আশাপ্রদ নয়। ২০০৩-২০১১ সালের মধ্যে প্রত্যাশিত গড় আয়ু বেড়েছিল ৪ শতাংশ; ২০১১-২০১৬ সালে তা বেড়েছে ২.৪ শতাংশ। অর্থাৎ, তৃণমূল জমানার তুলনায় বাম আমলে শিশুমৃত্যু কমেছিল দ্রুততর হারে; প্রসূতি মৃত্যু ও প্রত্যাশিত গড় আয়ু বৃদ্ধির হার উভয় জমানায় কার্যত একই।
এ বারে আসি কন্যাশ্রী-র প্রসঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের বিয়ের হার লজ্জাজনক রকম বেশি ছিল। তৃণমূল কংগ্রেসের বহু-বিজ্ঞাপিত কন্যাশ্রী প্রকল্প সেই হার কমাতে পারল কি না, তা আদৌ স্পষ্ট নয়। স্যাম্পল রেজিস্ট্রেশন
সিস্টেম-এর বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, কন্যাশ্রী প্রকল্পের উপস্থিতি সত্ত্বেও তৃণমূল কংগ্রেসের আমলে রাজ্যে মেয়েদের বিয়ের গড় বয়স দ্রুততর হারে বাড়েনি। ২০০৩ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে এই বয়স বেড়েছিল ৩.৬ শতাংশ; ২০১১-২০১৮ সালের মধ্যে তা বেড়েছে আরও তিন শতাংশ। একই সঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ২০১৫-১৬ সালের ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে (এনএফএইচএস)-র চতুর্থ দফা, এবং ২০১৯-২০ সালের পঞ্চম দফার পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, রাজ্যে ২০-২৪ বছর বয়স্ক মহিলাদের মধ্যে যত জনের বিয়ে ১৮ বছর বয়সের আগে হয়ে গিয়েছিল, সেই অনুপাত অপরিবর্তিত— ৪১.৬%।
তবে, কন্যাশ্রী-র দৌলতে সম্ভবত ১৫-১৭ বছরের মেয়েদের মধ্যে স্কুলে নাম লেখানোর অনুপাত বৃদ্ধি পেয়েছে। এনএফএইচএস-পাঁচ’এর পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, ৬-১৪ বছর বয়সি শিশুদের প্রায় সকলেই— মোট শিশুর ৯৭ শতাংশ— স্কুলে যায়। কিন্তু, ১৫-১৭ বছরের বয়ঃসীমায় এই হারটি কমে দাঁড়াচ্ছে ৭২ শতাংশে। এনএফএইচএস-চার’এ হারটি ছিল ৭০ শতাংশ। হারটি বাড়ল না কেন, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে দেখা যাবে, গত কয়েক বছরে এই বয়ঃসীমার ছেলেদের অনেকেই লেখাপড়া ছেড়ে দিচ্ছে। এনএফএইচএস-চার’এ ১৫-১৭ বছর বয়ঃসীমার স্কুলপড়ুয়াদের মধ্যে ছেলে ও মেয়ের অনুপাতে কোনও ফারাক ছিল না। এনএফএইচএস-পাঁচ’এ দেখা যাচ্ছে, এই বয়ঃসীমার ৭৭ শতাংশ মেয়ে স্কুলে যায়, কিন্তু ছেলেদের মধ্যে স্কুলে যায় মাত্র ৬৭ শতাংশ।
কোনও অঙ্কেই তৃণমূলের শাসনকালকে বাম আমলের শেষ দশ বছরের তুলনায় নির্দ্বিধায় ভাল বলা যাচ্ছে না। কাজেই, অন্তত অর্থনীতির দিক থেকে দেখলে, বিজেপি-বিরোধী ভোটাররা কেন সংযুক্ত মোর্চার পরিবর্তে তৃণমূলকে ভোট দেবেন, তার সন্তোষজনক উত্তর পাওয়া গেল না।
অর্থনীতি বিভাগ, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা