স্কুলগুলির র‌্যাঙ্কিং সহযোগিতার পরিবেশকে নষ্ট করবে
Students

‘প্রথম’ হওয়াই উদ্দেশ্য?

ছোট ছেলেমেয়েদের স্কুলজীবন তা হলে কেবল একক প্রতিযোগিতার ঘোড়দৌড় নয়, বরং সহযোগিতার, সহকারিতার সহজ পাঠ; সবে-মিলে শেখা ও শেখানোর একটি প্রাণবন্ত স্বপ্ন ও সম্ভাবনা।

Advertisement

মানবী মজুমদার

শেষ আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০২৩ ০৪:২১
Share:

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

আফ্রিকার এক দেশে পশ্চিমের এক গবেষক এসে স্কুলের এক দল ছাত্রকে নিয়ে একটি পরীক্ষা চালালেন— দূরের একটি গাছে ফলভর্তি ঝুড়ি টাঙানো ছিল; তিনি ছাত্রদের বললেন, যে সবচেয়ে তাড়াতাড়ি দৌড়ে পৌঁছে যেতে পারবে সেখানে, সে-ই পাবে ওই লোভনীয় ফলের সম্ভার। দেখা গেল, ছাত্ররা সবাই একে অপরের হাত ধরে এক সঙ্গে দৌড়ল সেই গন্তব্যের দিকে, যাতে সবাই মিলে আনন্দ করে ফল খেতে পারে। এরই পোশাকি নাম হল আফ্রিকার ‘উবুন্টু’ দর্শন, যার সহজ অর্থ করলে দাঁড়ায়— ‘আমরা, তাই আমি’। ছোট ছেলেমেয়েদের স্কুলজীবন তা হলে কেবল একক প্রতিযোগিতার ঘোড়দৌড় নয়, বরং সহযোগিতার, সহকারিতার সহজ পাঠ; সবে-মিলে শেখা ও শেখানোর একটি প্রাণবন্ত স্বপ্ন ও সম্ভাবনা।

Advertisement

তবে এই সম্ভাবনার ভাবনা যেন বারে বারে বিঘ্নিত হচ্ছে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় নানাবিধ নতুন নতুন নীতি ও কর্মসূচির ধাক্কায়। শিক্ষা নিয়ে তাঁর নিজের পরিকল্পনা ও উদ্যোগ পর্বে রবীন্দ্রনাথ বিদ্যালয়ে ‘পরীক্ষা পাশের শনি’-র প্রবেশ নিয়ে বিশেষ উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছিলেন। আর সে দিনের তুলনায় আজকের ছাত্রজীবন তো বহুবিধ পরীক্ষার চক্রে একেবারে ভরপুর ও ভারাক্রান্ত। ফলে ছাত্ররা সফলতার শীর্ষে পৌঁছতে শশব্যস্ত। অমর্ত্য সেনের ভাষায়, আমাদের দেশ তাই ‘ফার্স্ট বয়, ফার্স্ট গার্ল’-দের দেশ।

সম্প্রতি শোনা গেল রাজ্যের সরকারি স্কুলগুলিতে চালু হতে চলেছে র‌্যাঙ্কিং, সফলতার খাড়া সিঁড়িতে একটি বিদ্যালয়ের স্থান হবে উপরে বা নীচে। অর্থাৎ আমরা পৌঁছে যাচ্ছি ‘ফার্স্ট স্কুল’-দের দেশে। সবার নীচে যাদের স্থান হবে— লাস্ট বয়, লাস্ট গার্ল বা লাস্ট স্কুল— তাদের উন্নতির জন্য শিক্ষাব্যবস্থা কতটা সদয় বা সক্রিয় হবে, তা বলা যায় না; আবার স্কুলগুলির ভিতরে স্থান দখলের প্রতিযোগিতার ফলে উৎকর্ষের স্ফুরণ ঘটবে কি না, তাও অনুমান করা কঠিন।

Advertisement

মূল্যায়নের প্রয়োজন, তার বিবিধ উদ্দেশ্য ও ধরন নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে। তা নিয়ে বিশদ ব্যাখ্যায় না গিয়ে ‘র‌্যাঙ্কিং বিস্ফোরণ’ সম্পর্কে দু’একটি আশঙ্কার কথা বলি। বিশেষত ইদানীং বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলি কে কোন স্তরের, তা নিয়ে লাগাতার মাপজোকের আদলে রাজ্যের স্কুলগুলির স্তর-বিন্যাসের যে প্রস্তাব এসেছে, তারই পরিপ্রেক্ষিতে এই দুশ্চিন্তাচ্ছন্ন আলোচনা।

পরীক্ষার প্রতিযোগিতায় সফলতার স্বাদ পেতে কার না ভাল লাগে? যদিও তার কৃতিত্ব হয়তো সফল ছাত্রের একার নয়— স্কুলের, একাধিক গৃহশিক্ষকের, এবং সদা-তৎপর অভিভাবকদেরও। উল্টো দিকে, বিফলতার বড়ি কিন্তু বড়ই তেতো, বিশেষ করে যখন অসফল হওয়ার দায়ভার ছাত্রকে একক ভাবে বহন করতে হয়। স্কুল, অভিকোষ-তুল্য পাঠ্যক্রম, পরীক্ষার নামে শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যেই ছাত্র বহিষ্কারের আয়োজন— যেন ‘দোষ কারও নয় গো মা’।

বেশ কিছু দেশের বিদ্যাশিক্ষার আয়োজনে ছাত্রদের পারস্পরিক প্রতিযোগিতার তুলনায় সহযোগিতা ও সহকারিতার অভ্যাসকেই তাদের মানসিক ও বৌদ্ধিক বিকাশের পক্ষে বেশি প্রয়োজনীয় বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক মূল্যায়নে যে দেশের ছাত্ররা প্রায়ই প্রথম সারির বলে বিবেচিত হয়, সেই ফিনল্যান্ডে স্কুল বা বোর্ড পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয় না; ছাত্ররা জানে না যে, তারা একে অপরের তুলনায় কে কোথায় দাঁড়িয়ে, স্কুলগুলি জানে না সাফল্যের সোপানে তারা কোন স্থান অধিকার করেছে। শিক্ষকরা অবশ্যই ছাত্রদের অগ্রগতি বা শ্লথগতি সযত্নে অনুধাবন করেন, অভিভাবকদের সঙ্গে আলোচনা করেন, শিক্ষা পরিদর্শকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। কিন্তু সবই প্রত্যেক ছাত্রের বিকাশের স্বার্থে, তারা কে কার তুলনায় ঘোড়দৌড়ে এগিয়ে আছে, সর্বসমক্ষে তার তকমা এঁটে দেওয়ার জন্য নয়।

তা ছাড়াও, মূল্যায়নের ন্যায্য মাপকাঠি নিয়ে কি আমরা একেবারে সহমত? রাজ্যের শিক্ষা সংসদের বিবৃতি অনুযায়ী, রাজ্যের স্কুলগুলিকে থাকবন্দি করা হবে স্কুলে পড়াশোনার মান, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফল, ক্লাসের ফলাফল এবং মানোন্নয়নের অন্যান্য পদক্ষেপের নিরিখে। অথচ মূল্যায়নের আগে যে প্রাক্-শর্তগুলি পূরণ করা প্রয়োজন— যেমন, প্রাথমিক পরিকাঠামো, শিক্ষক নিয়োগ ও শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইত্যাদির সুব্যবস্থা— তা তো অনেক ক্ষেত্রেই অমিল বা অপ্রতুল। এ সব ছাড়া স্কুলের র‌্যাঙ্কিং কি ঘোড়ার আগে গাড়ি দাঁড় করিয়ে দেওয়া নয়? সেই ধরনের ‘দুয়োরানি’ স্কুলের শিক্ষকরা ইতিমধ্যেই এ সব প্রশ্ন তুলেছেন।

নিরবচ্ছিন্ন মূল্যায়নের পরিবর্তে পরীক্ষার ফলাফলের উপরে এই মাত্রাতিরিক্ত জোরই বা কেন? ভেবে দেখুন, যে কোনও একটি পরীক্ষা পাঠ্যক্রমের বড় জোর দশ শতাংশ বিষয়ের উপর প্রশ্নপত্র তৈরি করতে পারবে। সেই পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে ছাত্রদের জ্ঞানবুদ্ধির চূড়ান্ত নির্ণয় এবং তারই সূত্র টেনে স্কুলগুলির স্তর-বিন্যাস কতটা আস্থাজনক হতে পারে? অথচ স্কুলের দৈনন্দিন পঠনপাঠনে এই পরীক্ষা-জর্জর মূল্যায়নের প্রভাব সুদূরপ্রসারী হতে পারে, যার প্রমাণ মিলেছে নানা দেশে। পদক ও পুরস্কার লাভের তাড়নায় অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে শিক্ষকরা তুলনায় পিছিয়ে-পড়া ছাত্রদের পরীক্ষাই দিতে দেন না, যাতে ‘ভাল’ ছাত্ররা স্কুলের নাম উজ্জ্বল করে। এ যেন উলট পুরাণ— স্কুল ছাত্রদের জন্য
কিছু করবার বদলে ‘মেধাবী’ ছাত্ররা স্কুলের র‌্যাঙ্কিং-এর জন্য কী করতে পারে, তাই যেন বিচার্য। অন্য দিকে, পিছিয়ে-পড়া স্কুলগুলিকে তিরস্কৃত হতে দেখা গেছে নানা ভাবে— শাস্তিস্বরূপ তাদের আর্থিক বরাদ্দ কমেছে, এমনকি কোথাও কোথাও তাদের অস্তিত্বই বিপন্ন।

প্রথম স্থানাধিকারী হওয়ার জন্য স্কুলে-স্কুলে লাগামছাড়া রেষারেষি হলে পরস্পরের মধ্যে বিদ্যাশিক্ষা নিয়ে আলোচনা ও আদানপ্রদানের মুক্তধারা ক্রমশ রুদ্ধ হয়ে যাবে। শিক্ষার কর্মসূচি প্রণয়ন ও রূপায়ণে তাদের হাত-ধরাধরির পরিবর্তে হাত-ছাড়াছাড়ির সম্ভাবনা প্রবল হবে। অথচ শেখা এবং শেখানো দুই-ই যূথবদ্ধ প্রয়াসের মুখাপেক্ষী। বাস্তবে অনেক ছাত্র এবং অনেক শিক্ষক তাঁদের সহপাঠী বা সহকর্মীর ভাল-মন্দের ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন থাকেন না, একক স্বীকৃতি চান না, বরং অন্যদের প্রয়োজন সম্বন্ধে যথেষ্ট সংবেদনশীল। এই ধরনের স্বতঃস্ফূর্ত যূথমনস্কতা মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতার মধ্যে পড়ে। শিম্পাঞ্জিদের নিয়েও একটি চিত্তাকর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে যে, সঙ্গীদের তুলনায় তাদের বেশি পুরস্কার দিলে তা তারা প্রত্যাখ্যান করে। অতএব প্রতিযোগিতার খরস্রোতে যদি সহযোগিতার ধারাটি একেবারে ক্ষীণ হয়ে পড়ে, তা হলে তো শিক্ষাব্যবস্থায় খরা শুরু হবে।

শেষে সামান্য ছুঁয়ে যাই একটি গভীর বিষয়কে— প্রকৃত শিক্ষার মূল্যায়নের সূচকগুলি ঠিক কী হবে? যদি চেনা প্রশ্নের চেনা উত্তর না খুঁজে এক জন ছাত্র কোনও জটিল প্রশ্নের তল খোঁজার চেষ্টা করে যায় নানা দৃষ্টিকোণ থেকে, তবে তার সেই ‘জানার মাঝে অজানার সন্ধান’-এর মূল্য দিতে, মূল্যায়ন করতে আমরা আগ্রহী হব তো? যদি কোনও স্কুল ছাত্রদের এই রকম মুক্তচিন্তার পরিসর তৈরি করে দেয়, তার কদর আমরা করব তো? এক বার ফিরে তাকাই রবীন্দ্র-দর্শনের দিকে, যার ভিত্তিভূমিতে তিনি গড়ে তুলেছিলেন তাঁর আশ্রম-বিদ্যালয়কে। তাঁর কথায়, “এখানে তোমরা কেবল বই পড়োনি, সংগীতে উৎসবে জীবন এখানে বিচিত্র হয়ে উঠেছে।... এখানকার ছাত্ররা উপাধি নিয়ে চলে যাবে, পরীক্ষা-পাশের মন্ত্রে মার্কামারা হয়ে বেরোবে, এর জন্য এখানে আমি আমার শক্তি নিয়োগ করি নি।... এখানে বিদ্যা ও প্রাণের গভীর যোগসাধনের চেষ্টা হয়েছে।” তিনি ছাত্রদের স্কুলজীবনে যে ‘সমগ্রতার আদর্শ’ আর ‘প্রীতির ধারা’-র কথা বলেছেন, আফ্রিকার সেই ছাত্রদল যেন তারই প্রতিভূ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement