সম্ভাবনা: ‘ভারত জোড়ো’ যাত্রার পথে, রাজধানী দিল্লিতে কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধী। ২৪ ডিসেম্বর, ২০২২। ছবি: পিটিআই।
রাহুল গান্ধীর একটি সাম্প্রতিক মন্তব্য বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। ২৪ ডিসেম্বর ‘ভারত জোড়ো’ যাত্রার পথে দিল্লি পৌঁছে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, “এ পর্যন্ত ২৮০০ কিলোমিটার ঘুরলাম। কোথাও কোনও ঘৃণা দেখিনি, অথচ টিভিতে সারাক্ষণ সেটাই দেখি। এই দেশ অভিন্ন, দেশের মানুষ পরস্পরকে ভালবাসেন।” সেপ্টেম্বরের গোড়ায় অভিযানে নামার পরে তিনি ধারাবাহিক ভাবে ঘৃণার বিরুদ্ধে সম্প্রীতির ডাক দিয়ে এসেছেন, বিভাজনের বিপরীতে ঐক্যের বাণী প্রচার করেছেন। বড়দিনের পূর্বাহ্ণে লালকেল্লাকে পিছনে রেখে মঞ্চরূপেণ সংস্থিত ট্রাকের উপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করতে গিয়ে তাঁর মনে সেই পবিত্র প্রেমের মধুর ভাব হয়তো দ্বিগুণ আবেগে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিল, অমৃতস্য পুত্রকন্যাদের জানাতে চেয়েছিলেন তিনি: আমার চোখে তো সকলই শোভন।
শুনে প্রথমে বিস্ময় জাগে। সাড়ে তিন মাস ধরে রাজ্যে রাজ্যে হাজার হাজার কিলোমিটার ঘুরে কোথাও কোনও ঘৃণার অস্তিত্ব টের পেলেন না? ভূতপূর্ব কংগ্রেস সভাপতির দৃষ্টিশক্তি কি এতটাই ক্ষীণ? তবে অচিরেই বিস্ময় কাটিয়ে উঠে অনুমান করা যায় যে, তাঁর কথাটার একটা অন্য মানে আছে। তিনি নিশ্চয়ই বলতে চেয়েছেন যে, ঘৃণা এই দেশের মানুষের প্রকৃত স্বভাব নয়, তাঁরা একে অপরের প্রতি ভালবাসার মন নিয়েই বাঁচতে চান, কিন্তু দুঃশাসনের কারবারিরা তাঁদের কানে বিষ ঢালে, মনোভূমিতে বপন করে ঘৃণার বীজ, তার পরিণামেই এত বিদ্বেষ, এত হিংস্রতা, তোমার ভুবনে মা গো এত পাপ!
রাহুল গান্ধীর উক্তি আরও এক বার মনে পড়িয়ে দিল আমেরিকান কবি অগডেন ন্যাশ-এর সেই পঙ্ক্তি দু’টি: ‘এনি কিডি ইন স্কুল ক্যান লাভ লাইক আ ফুল/ বাট হেটিং, মাই বয়, ইজ় অ্যান আর্ট’— যে কোনও স্কুলের শিশু একেবারে বোকার মতো ভালবাসতে পারে, কিন্তু ঘৃণা করাটা এক শিল্পকলা, যা রীতিমতো শিখতে হয়। এত চমৎকার করে কম লোকেই বলতে পারে, কিন্তু বক্তব্যটা যথেষ্ট চেনা। বিদ্বেষ নয়, সম্প্রীতিই মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি— এই ধারণা বহুলপ্রচলিত। ধারণাটা কত দূর সত্য, সেই সত্য কতটা দেশকালজয়ী, মানুষের সর্বজনীন এবং সর্বকালীন স্বভাব বলে কিছু হয় কি না, তা নিয়ে পণ্ডিতদের তর্কাতর্কির শেষ নেই। তবে সে-সবের মধ্যে না গিয়েও একটা সোজা কথা সোজা করেই বলা যেতে পারে। এমনি এমনিই হোক আর দুষ্টু লোকের কুমন্ত্রণার ফলেই হোক, আজকাল ঘরে-বাইরে বহু মানুষের চিন্তায় ও আচার-আচরণে প্রায়শই যা ফুটে ওঠে, তাকে ভালবাসার প্রকাশ বলা কঠিন। রাজনীতির মল্লভূমিতে কিংবা টিভি চ্যানেলের সাজানো আসরে তো বটেই, তথাকথিত সমাজমাধ্যমের বারো ঘর এক উঠোনেও যে তীব্র বিদ্বেষ আর তিক্ত অসহিষ্ণুতার মূর্তি দেখি, তাতে আতঙ্কিত হতে হয়।
অনেকেই হয়তো আশ্বাস দেবেন— রাজনীতিক, টেলিভিশন এবং সমাজমাধ্যম দেখে বৃহত্তর ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মন বোঝা যাবে না, তাঁরা আজও ভালবাসার ভুবনেই বাস করেন। কথাটা ঠিকই। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ উচ্ছন্নে গেলে দেশটাও বেঁচেবর্তে থাকতে পারত না। কিন্তু যে বিপন্নতার গহ্বরে আমরা ক্রমশই সেঁধিয়ে যাচ্ছি, সংখ্যাগরিষ্ঠ ভালমানুষের বিচ্ছিন্ন এবং নিষ্ক্রিয় শুভবোধ তা থেকে আমাদের বাঁচাতে পারবে না। পৃথিবীর ইতিহাস সেটা বারংবার প্রমাণ করেছে। এই সত্যটিকে স্বীকার না করে ‘সবাই আসলে খুব ভাল’ বলে পুষ্পের হাসি হাসলে পোশাকি ধর্মগুরুর কারবার চলতে পারে, কিন্তু সমাজ এবং রাজনীতির কঠিন ভূমিতে এক পা-ও এগোনো যাবে না, এক লক্ষ কিলোমিটার যাত্রা করলেও না। ভারত জোড়ার কাজটি যতখানি জরুরি, সেই অনুপাতেই কঠিন। সে জন্য আদিগন্ত বিস্তীর্ণ জমাট অন্ধকার ঠেলে ঘৃণা আর বিদ্বেষের বিরুদ্ধে কঠিন লড়াই করতে হবে। ভাবের ঘরে চুরি না করে রাহুল গান্ধী যদি এই অপ্রিয় বাস্তবকে স্পষ্ট ভাষায় স্বীকার করে বাকি পথটা হাঁটতে পারেন, তবে দেশের উপকার হবে। তাঁর নিজেরও।
তিনি হয়তো বলবেন, কাজটা মোটেও কঠিন নয়। কুমন্ত্রণা দিয়ে অনেক মানুষের মনে যে বিষ ঢোকানো হয়েছে, সুমন্ত্রণা দিয়ে তা নিষ্কাশন করা দরকার। অনেকে মিলে ঠিক কথাগুলো আরও অনেককে বলতে হবে, বিদ্বেষের বিপরীতে সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে, তা হলেই মানুষ বুঝতে পারবে কোনটা ঠিক কোনটা ভুল, কোনটা ভাল কোনটা মন্দ। বুঝতে পেরে তারা বলবে, ‘আমরা ভালর দলে’— হীরক রাজার দেশে এসে গুপী-বাঘা পাহাড়ের গুহায় লুকিয়ে-থাকা উদয়ন পণ্ডিতের কথা শোনার পরে যেমনটি বলেছিল। রাহুল গান্ধী একা নন, আমরা অনেকেই এমনটা ভাবতে ভালবাসি, শুভবুদ্ধি দিয়ে অশুভ শক্তিকে হারিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখি, ভালবাসা দিয়ে ঘৃণা দূর করতে চাই, বিদ্বেষ আর অবিশ্বাসের বহুমুখী অস্ত্রে ক্ষতবিক্ষত ভারতকে জুড়তে চাই সহমর্মিতার বিশল্যকরণী দিয়ে। কিছুক্ষণ এমন ভাবে ভাবতে ভাবতে ‘আমিও ভাল তুমিও ভাল’ মার্কা বিশ্বপ্রেমের ঘোর লেগে যেতে পারে, মনে হতে পারে কাজটা বুঝি সত্যিই সহজ, কেবল সবাই মিলে শুভেচ্ছার প্রচার চালিয়ে গেলেই হবে।
হবে না। সুকঠিন সত্য এই যে, দেশ জুড়ে বহু মানুষের মনে ঘৃণা আর বিদ্বেষ আর বিভাজনের প্রবল আকর্ষণ তৈরি হয়েছে, যে আকর্ষণ অহেতুক নয়, তার পিছনে যুক্তি আছে, কারণ আছে। মানুষ কী রকম ভাবে বেঁচে আছেন, তার মধ্যেই সেই যুক্তি বা কারণগুলোকে খুঁজতে হবে। খুঁজতে হবে বিশেষ করে তাঁদের দৈনন্দিন অনিশ্চয়তায় এবং জীবনযাপনের বিচ্ছিন্নতায়। প্রথমত, আজকের পৃথিবীতে অল্প কিছু সৌভাগ্যবান ছাড়া কার্যত কারও জীবনে নিশ্চয়তা বা নিরাপত্তা বলে কিছুই অবশিষ্ট নেই। আর্থিক অনিশ্চয়তা অবশ্যই তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস; অস্তিত্বের প্রতিটি মাত্রা যত বেশি করে বাজারের অঙ্গ হয়ে উঠছে ততই আর্থিক নিরাপত্তার গুরুত্ব বাড়ছে। কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে চলেছে আমাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, সমাজ, সংস্কৃতি, এমনকি পারিবারিক পরিসরের অনিশ্চয়তাও। প্রসঙ্গত, অর্থনীতিবিদ প্রণব বর্ধন তাঁর আ ওয়ার্ল্ড অব ইনসিকিয়োরিটি গ্রন্থে এই প্রশ্নটিকে কেবল শিরোনামে নয়, বিশ্লেষণের কেন্দ্রে রেখেছেন। খুব বড় প্রশ্ন সেটা।
কিন্তু প্রশ্ন শুধু অনিশ্চয়তার নয়, বিচ্ছিন্নতারও। দুনিয়া জুড়ে মানুষের সঙ্গে মানুষের প্রকৃত সংযোগ ক্রমশই কমছে। ভুবনগ্রাম যত ছোট হচ্ছে, আমাদের পারস্পরিক যোগাযোগ ততই বাজারের লেনদেনের রূপ নিচ্ছে, যে বাজার পুঁজির নির্দেশে চালিত। এমনকি একান্ত পারিবারিক সম্পর্কের পরিসরেও আক্ষরিক অর্থে অহরহ বাজার ঢুকে পড়ছে এবং সেই পরিসরের দখল নিয়ে সম্পর্কগুলোকে চালনা করছে। আমাদের সামাজিকতা এখন বহুলাংশে আমার আপনার বিচ্ছিন্ন অস্তিত্বের বিনিময় বই কিছু নয়। ভুবন জুড়ে কয়েক হাজার কোটি ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ লেনদেনের মাহেন্দ্রক্ষণে আমরা যখন প্রচণ্ড সামাজিক, তখনই বেবাক বিচ্ছিন্ন।
এমন বিচ্ছিন্ন এবং নিশ্চয়তাহীন মানুষের মনে ভীতি জাগিয়ে তোলা সহজ, এক বা একাধিক গোষ্ঠীকে ‘শত্রু’ হিসাবে চিহ্নিত করে সেই ভীতিকে বিরাগ, বিদ্বেষ এবং ঘৃণায় পরিণত করা আরও সহজ। পশ্চিম দুনিয়ার বহু দেশে অভিবাসীদের, বিশেষত অশ্বেতাঙ্গ অভিবাসীদের সম্পর্কে স্থানীয় বাসিন্দাদের একটা বড় অংশের বিরূপ মনোভাব প্রকট হয়েছে, রাজনীতিতেও তার বড় রকমের প্রভাব পড়েছে। আমাদের দেশে এমন মানসিকতার নানা স্তর, নানা পরিসর। জাতপাত, ভাষা, আঞ্চলিকতা— বিভিন্ন দিক থেকে ওরা-আমরা ভাগাভাগি আর বিদ্বেষের লীলা আমাদের বহু কালের ঐতিহ্য। কিন্তু আজকের ভারতে এক নম্বর বিভাজন-রেখাটি অবশ্যই ধর্মপরিচয়ের, যে বিভাজনের প্রথম ও প্রধান নিশানা সংখ্যালঘু মুসলমান। এ দেশে সংখ্যালঘুর প্রতি সংখ্যাগুরু সমাজের বহু লোকের অন্তর-নিহিত বিরূপতায় ইন্ধন দিয়ে এবং তাকে কাজে লাগিয়ে হিন্দুসমাজের নানান অন্তর্দ্বন্দ্ব থেকে এবং হিন্দুত্ববাদী শাসকদের সমস্ত অন্যায় ও অপদার্থতা থেকে সংখ্যাগুরুর নজর সরিয়ে দেওয়া যাচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে ‘ঠিকঠাক’ বহু সহনাগরিকই বলছেন, “সবই মানছি, কিন্তু ওদের বাড়াবাড়িগুলো তো এরা বন্ধ করেছে!” ধর্মনিরপেক্ষতা বা সম্প্রীতির বাণী শুনিয়ে এই মন পাল্টানো যাবে না।
কী ভাবে যাবে? জানি না। কঠিন কাজ। তবে বিচ্ছিন্নতা এবং অনিশ্চয়তার দ্বৈত সমস্যার সঙ্গে লড়াই করা সে-কাজের একটা অপরিহার্য অঙ্গ। দুটো লড়াই আলাদা নয়, সামাজিক সংযোগের মধ্য দিয়েই অনিশ্চয়তার মোকাবিলা জরুরি, এবং সম্ভব। তেমন বহু উদ্যোগ চলছে বিশ্ব জুড়ে। এ দেশেও। পুঁজির আক্রমণের বিরুদ্ধে অথবা তার বলয়ের বাইরে দাঁড়িয়ে শ্রমজীবী মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নিজেদের জীবনটাকে নিজেদের হাতের মুঠোয় আর একটু দৃঢ় করে ধরে বাঁচবার চেষ্টা করছেন। এই সংগ্রামের সঙ্গে নিজেকে মেলানোই প্রতিস্পর্ধী রাজনীতির কাজ। সেটাই সত্যকারের ভারত জোড়ার পথ। রাহুল গান্ধী, তাঁর দল এবং সেই দলের পৃষ্ঠপোষকদের পক্ষে সে-পথ অবশ্য দুর্গম হওয়ারই কথা।